ফোর্দোর ইউরেনিয়াম গেল কোথায়?

- আপডেট সময় : ০৮:৫৫:০৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫ ১১ বার পড়া হয়েছে
পারমাণবিক উত্তেজনার খেলায় সম্প্রতি ইরানের মূল পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার পর এখন প্রশ্ন উঠছে এই হামলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মূলত কী অর্জন পেরেছে? হামলার পরদিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ‘সম্পূর্ণ ও নিঃশেষভাবে ধ্বংস’ করা হয়েছে। কিন্তু গত রোববার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ এবং জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান ড্যান কেইন প্রেসিডেন্টের এই দাবিকে পাশ কাটিয়ে যান। তারা বলেন, বিমান বাহিনীর বি-২ বোমারু বিমান এবং নৌবাহিনীর টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলার ফলে তিনটি স্থাপনায় ‘গুরুতর ক্ষতি’ হয়েছে। তবে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ইরানের ইউরেনিয়ামের মজুত কোথায় গেছে, তা কেউ জানে না।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল ইরানের ফোর্দো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের এক ডজন ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমার আঘাতে সেখানে একাধিক গভীর গর্ত তৈরি হয়েছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী, স্থাপনাটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। এই বোমাগুলোর উচ্চ ধ্বংসাত্মক সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, ফোর্দোর মতো লক্ষ্য ধ্বংস করতে বাস্তবে কতটা কার্যকর, তা এখনো প্রমাণিত নয়। এই বাঙ্কার-বাস্টার বা এমওপি বোমা উন্নত জিপিএস/আইএনএসের মতো নেভিগেশন সিস্টেম দ্বারা পরিচালিত হয়, যা লক্ষ্যবস্তু থেকে কয়েক মিটারের মধ্যেই আঘাত হানতে সক্ষম। এর লার্জ পেনেট্রেটর স্মার্ট ফিউজ (এলপিএসএফ) মাটির গভীরে বিস্ফোরণের সুবিধা দেয়, যার ফলে বাঙ্কারের ফাঁকা অংশ শনাক্ত করে বিস্ফোরণের সর্বোচ্চ প্রভাব তৈরি করা যায়। এই বোমা ৫০০০ পিএসআই কংক্রিটে ৬০ মিটার, শক্ত পাথরে ৪০ মিটার আর ১০০০০ পিএসআই অতিরিক্ত শক্ত কংক্রিটে ৮ মিটার পর্যন্ত ভেদ করতে পারে। পিএসআই বা ‘পাউন্ড পার স্কয়ার ইঞ্চি’ হলো কংক্রিটের সংকোচন প্রতিরোধ ক্ষমতার একটি একক। এটি বোঝায় প্রতি বর্গইঞ্চিতে কত পাউন্ড বল প্রয়োগ করলে কংক্রিট ভেঙে যাবে বা ফেটে যাবে।
ভূমিকম্প এবং সামরিক হামলার নিয়মিত হুমকির প্রেক্ষাপটে ইরান শক্তিশালী নির্মাণ উপাদান তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বহু বছর ধরেই। ইরান অন্তত এক দশক আগে থেকেই ‘আল্ট্রা হাই পারফরম্যান্স কংক্রিট’ (ইউএইচপিসি) উৎপাদন করতে সক্ষম— যা সাধারণ উচ্চ-ক্ষমতার কংক্রিটের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ও নমনীয়। এটি তৈরি হয় সাধারণ কংক্রিটে কোয়ার্টজ কণিকা (স্ফটিকাকার খনিজ) ও বিশেষ পলিমার মিশিয়ে। ইউএইচপিসি সাধারণ কংক্রিটের মতো বোমার আঘাতে চূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে না। ফলে স্প্লিন্টার আঘাতের ঝুঁকি কমে যায় এবং এটি বাঙ্কার নির্মাণের জন্য আদর্শ।
অস্ট্রেলিয়ান পরীক্ষায় দেখা গেছে, ৬ টন ট্রাইনাইট্রোটলুইনের (টিএনটি) বিস্ফোরণেও ইউএইচপিসি কেবল ফাটে, ধ্বংস হয় না। সামরিক ব্যবহার ছাড়াও এটি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় নিরাপদ ও টেকসই ভবন নির্মাণে ব্যবহৃত হয়।
ইউএইচপিসির সংকোচন প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রায় ৩০০০০ পিএসআই, যেখানে সাধারণ কংক্রিটের ৪০০০৫০০০ পিএসআই। টান সহ্য করার ক্ষমতাও সাধারণ কংক্রিটের তুলনায় অনেক বেশি। সাধারণ কংক্রিট যেখানে ৪০০ পিএসআই টান সহ্য করতে পারে, সেখানে ইউএইচপিসির ক্ষমতা ১০০০ পিএসআই। যা শক্তিশালী প্রতিরক্ষা কাঠামোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরীক্ষায় দেখা গেছে, ১৩ টনের বাঙ্কার-বাস্টার বোমা সাধারণ কংক্রিটে ১৮০ ফুট পর্যন্ত ঢুকে যেতে পারে, কিন্তু দ্বিগুণ শক্তিশালী কংক্রিটে মাত্র ২৫ ফুট যেতে পারে। সুতরাং ইউএইচপিসি, যা সাধারণ কংক্রিটের সাত গুণ শক্তিশালী, সেখানে এই বোমা হয়তো কেবল আঁচড়ই ফেলতে পারবে। তাছাড়া ইউএইচপিসি সাধারণ কংক্রিটের তুলনায় লবণসহ অন্যান্য রাসায়নিক প্রতিরোধে ১০০ গুণ বেশি কার্যকর। এতে ব্যবহৃত স্টিল বা পলিমার ফাইবার কংক্রিটের ভেতরে মাইক্রো ফাটল ছড়িয়ে পড়া ঠেকায়। সাধারণ কংক্রিটে এই ফাটলগুলো বড় হয়ে কাঠামো দুর্বল করে ফেলে। ফাইবারগুলো প্রচলিত রডের বিকল্প হিসেবেও ব্যবহারযোগ্য। ইউএইচপিসি-তে ব্যবহৃত সিলিকা ফিউম নামে পরিচিত অতিক্ষুদ্র সিলিকা গুঁড়ো দুটি স্তরে কাজ করে। রাসায়নিকভাবে এটি সিমেন্ট থেকে নির্গত ক্যালসিয়াম হাইড্রোঅক্সাইডের সঙ্গে বিক্রিয়া করে শক্ত বন্ধনে পরিণত হয়। আর শারীরিকভাবে কোয়ার্টজ ফ্লাওয়ার ও সিলিকা একত্রে সিমেন্টের দানা ও অন্যান্য উপাদানের মাঝে ফাঁকা জায়গা পূরণ করে দেয়, যার ফলে পানি বা রাসায়নিক ঢুকতে পারে না। ধারণা করা হয়, ইরান ফোর্দো স্থাপনায় সেন্ট্রিফিউজ কক্ষগুলোকে অতিপ্রতিরোধী কংক্রিট (ইউএইচপিসি) দিয়ে মজবুত করেছে। এই বাস্তবতায় পাহাড়ের গভীরে নির্মিত, ভূমির প্রায় ২৬০ থেকে ৩০০ ফুট নিচে অবস্থিত ফোর্দো ফুয়েল এনরিচমেন্ট প্ল্যান্ট ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে ট্রাম্পের দাবি অতিরঞ্জন বলেই প্রতীয়মান। ফোর্দোতে হামলার কারিগরি জটিলতা বিবেচনায় নিয়ে মার্কিন সামরিক কর্তৃপক্ষ হামলা পরবর্তী মূল্যায়ন ‘সম্পূর্ণ ধ্বংস’ থেকে ‘গুরুতর ক্ষতি’-তে নামিয়ে এনেছে। সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা এখনো রয়ে গেছে ইরানের ইউরেনিয়াম মজুতের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা নিয়ে। কেউ জানে না কীভাবে ৪০০ কেজি ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়াম সরিয়ে ফেলা হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের হামলার ঠিক আগের দুদিন কিছু ট্রাকে ওই ইউরেনিয়াম সরিয়ে নেওয়ার সম্ভাব্য ছবি পাওয়া গেছে। যদিও নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না যে, সেগুলো সত্যিই সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম বহন করছিল কি না। দুই ইসরায়েলি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফোর্দো প্ল্যান্ট থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ প্রায় ৪০০ কেজি ইউরেনিয়াম আগেই সরিয়ে ফেলা হয়। সেই সঙ্গে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতিও সরানো হয়েছিল, সম্ভবত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাম্প্রতিক হুমকির প্রতিক্রিয়ায় এটা করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জানান, এই ইউরেনিয়াম বিষয়ে ইসরায়েলের কাছে ‘গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য’ আছে। তবে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি। নেতানিয়াহু বলেন, এটি (ইউরেনিয়াম) একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যদিও এককভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে, যা আমি এখন প্রকাশ করতে পারছি না। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) প্রধান রাফায়েল গ্রোসি সিএনএনকে জানিয়েছেন, ইরানের ইউরেনিয়াম মজুতগুলো সর্বশেষ দেখা গেছে হামলার এক সপ্তাহ আগে। এরপর থেকে ইউরেনিয়ামের অবস্থান এখন অজানা। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ফোর্দোতে থাকা ইউরেনিয়াম নিয়ে এই অনিশ্চয়তা পারমাণবিক উপাদান শনাক্ত করার ক্ষেত্রে যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতা এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি দুই-ই উসকে দিচ্ছে। তাছাড়া হামলায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হলেও ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুত এবং পরমাণু সক্ষমতা ধ্বংস করার লক্ষ্য পূরণ হয়নি বলে ধারণা করছে আন্তর্জাতিক মহল।