সংবাদ শিরোনাম ::
নারায়ণগঞ্জ ৩ আসন
বিএনপি প্রার্থী মান্নান শ্রমিক থেকে গডফাদার
এ এইচ ইমরান
- আপডেট সময় : ৪৩ বার পড়া হয়েছে
নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের বিএনপি মনোনীত প্রার্থী আজহারুল ইসলাম মান্নানের ক্ষেত্রে দলীয় টিকিট কেনা হয়নি—বরং তা ‘দখল’ করা হয়েছে। রাজনীতির ‘সন্ত্রাসীকরণ’ সোনারগাঁয়ে প্রার্থীর ‘অপরাধ সাম্রাজ্য’ ও গণতান্ত্রিক বিপর্যয়ের শঙ্কা। সরজমিন তদন্ত, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও অর্থনৈতিক তথ্য পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, এই মনোনয়ন শুধু ব্যক্তিগত বিতর্ক নয়, বরং বাংলাদেশের স্থানীয় রাজনীতিতে ‘অপরাধীকরণ’ (Criminalization) প্রক্রিয়ার একটি চরম উদাহরণ। যেখানে একজন শিল্পশ্রমিক থেকে ‘ভূমি সম্রাট’ এবং গডফাদার থেকে ‘সংসদ সদস্য প্রার্থী’ হওয়ার গল্পে লুকিয়ে আছে রাজনৈতিক দলগুলোর নৈতিক অবক্ষয় ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা।
শ্রমিক থেকে গডফাদার:
মান্নানের উত্থান তিন দশকের। স্থানীয় সূত্র জানায়, ১৯৯০-এর দশকে তিনি সোনারগাঁওয়ের একটি বেসরকারি কারখানায় সাধারণ শ্রমিক ছিলেন। তবে তার ‘ভাগ্য’ বদলে যায় যখন তিনি বসুন্ধরা শিল্প গ্রুপের সাথে ‘সখ্যতা’ গড়ে তোলেন। এই ‘সখ্যতা’ কী—তা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে গুঞ্জন রয়েছে। কিন্তু ২০০০ সালের দিকে তিনি সোনারগাঁওয়ে শিল্পায়নের নামে ‘জমি দখল’ নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেন। ঐসময় তিনি
প্রতাপের চর, ঝাউচরে শত শত বিঘা জমি ‘দখল’ করে রাতারাতি কোটি টাকার মালিক হয়ে যায়। কিন্তু শুধু অর্থই নয়, তিনি বুঝেছিলেন—বাংলাদেশে ‘দখল’ টিকিয়ে রাখতে হয় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়। তাই ২০১০-এর সালের দিকে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন এবং নিজস্ব ‘ক্যাডার বাহিনী’ গড়ে তোলেন। নিজেই বনে যান গডফাদার। এরপর আর তাকে পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। তবে তার সবচেয়ে বড় সফলতা—অপরাধ ও রাজনীতির ‘হাইব্রিড মডেল’। তিনি বিএনপি নেতা হয়েও আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে সম্পর্ক রেখে ‘বাধাহীন ভাবে ব্যবসা’ চালিয়েছেন। ৫ আগস্টের পর তিনি তার ছেলে সজীবকে ‘অপারেশন ম্যানেজার’ হিসেবে ব্যবহার করেন। সজীব এখন যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক—কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ, তিনি ‘মান্নান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী’ হিসেবে কাজ করছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদের মতে, “মান্নানের ক্ষেত্রে আমরা দেখি ‘অপরাধ-রাজনীতি নেক্সাস’ (Crime-Politics Nexus) এর ক্লাসিক উদাহরণ। তিনি প্রথমে অর্থশক্তি, তারপর বাহিনী শক্তি এবং সবশেষে রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলেন—যা একটি ‘মাফিয়া স্টেট’ মডেল।
মনোনয়নের আড়ালে হতাশা:
গত শনিবার বিএনপি ঘোষিত মনোনয়ন তালিকায় সোনারগাঁও উপজেলা বিএনপির সভাপতি আজহারুল ইসলাম মান্নানের নাম আসার পর থেকেই নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে তোলপাড় শুরু হয়েছে। দলের স্থানীয় নেতাদের একাংশের দাবি, “মান্নান বিএনপির পোশাকে আওয়ামী লীগের ‘বিচ্ছিন্ন অংশ’ ছিলেন। এখন তিনি নির্বাচনী টিকিট পেয়ে পুরো এলাকায় একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন।” বঞ্চিত মনোনয়নপ্রত্যাশীরা ইতিমধ্যে নিজেদের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য গোপন বৈঠক ও সমাবেশ শুরু করেছেন।
তবে মান্নানের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুধু দলীয় কোন্দলের নয়। স্থানীয় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ৫ আগস্টের পর থেকে সোনারগাঁও পরিণত হয়েছে ‘অরাজকতার নগরীতে’—যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন বিতর্কিত এই প্রার্থী।
চাঁদা বাণিজ্যের ‘ক্যালকুলেটর:
মোগরাপাড়া চৌরাস্তা—সোনারগাঁওয়ের প্রাণকেন্দ্র। এখানে চাঁদাবাজির যে ‘সূক্ষ্ম ব্যবস্থা’ গড়ে তোলা হয়েছে, তা শুধু ভয় দেখানো নয়, একটি সুসংগত আর্থিক মডেল।
বাসস্ট্যান্ডের আধা কিলোমিটার রাস্তার দু’পাশে ৭০০-এর বেশি ভ্রাম্যমাণ দোকান। প্রতিটি থেকে দৈনিক ৩৫০ টাকা—মাসে ৭৩ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। বাস কাউন্টার ১০০টি হলে প্রতিদিন ৫০,০০০ টাকা—মাসে ১৫ লক্ষ টাকা। সিএনজি ও অটোরিকশা থেকে দৈনিক অন্তত ২০,০০০ টাকা—মাসে ৬ লক্ষ টাকা। শুধু এই চারটি খাত থেকেই মান্নান বাহিনীর মাসিক আয় প্রায় কোটি টাকার উপরে। বাদ যায় না ট্রাক ও পিকআপ স্ট্যান্ডও। সেখান থেকে গাড়িপ্রতি ১০০ থেকে ২০০ টাকা চাঁদা নেয়া হয়। মোগরাপাড়া বাসস্ট্যান্ডের উত্তর পাশে সড়ক ও জনপদের প্রায় ৪ একর জমি আছে। ওই জমি দখল করে দেড় শতাধিক দোকান বসানো হয়েছে। সেখানে দোকানপ্রতি মাসে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া তোলা হচ্ছে। আগে এই দোকানগুলোর ভাড়া তুলতো সাবেক এমপি’র লোকজন। এখন তাদের সঙ্গে মান্নানের লোকজন মিলে ভাগবাটোয়ারা করে ভাড়া তুলছেন। স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধুমাত্র মোগরাপাড়া চৌরাস্তা থেকেই দৈনিক ১০ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এই টাকার সিংহভাগ চলে যায় মান্নানের কাছে। তবে স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, “এই হিসাব শুধু মোগরাপাড়ার। শিল্পনগরীর বর্জ্য ব্যবসা, টেন্ডার, পরিবহন, নদী ভরাট, বালুমহালসহ মোট আয় মাসে শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।”
অভিযোগ রয়েছে, এই চাঁদাবাজির টাকা সংগ্রহের দায়িত্বে রয়েছেন মান্নানের সহযোগী আতাউর রহমান। গত ২৯ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করলেও তিনি জামিনে মুক্তি পান এবং পুনরায় কার্যক্রম শুরু করেন। এমনকি গ্রেপ্তারের পরও চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি বলে স্থানীয়রা জানান।
সরকারি সম্পদ দখলের ‘মাস্টারপ্ল্যান:
গুরুতর অভিযোগ—মেঘনা সেতুর টোল প্লাজা দখল। ৫ আগস্ট দুপুরে টোল প্লাজার কর্মকর্তারা পালিয়ে গেলে বিকালেই মান্নান বাহিনী নিয়ন্ত্রণ নেয়। নারায়ণগঞ্জ সওজের আগস্ট মাসের টোল আদায়ের রেকর্ডে ৫-১১ আগস্ট পর্যন্ত সাত দিনের তথ্য নেই—যেখানে অন্য দিনগুলোর পূর্ণাঙ্গ হিসাব রয়েছে। টোল প্লাজায় কর্মরত এক কর্মকর্তা বলেন, “বিকাল থেকে যুবদল নেতা সজীবের লোকজন টোল প্লাজায় বসে টোল আদায় করে। প্রতিদিন সেতুতে প্রায় ১ কোটি টাকা টোল আদায় হয়। পাঁচ দিনে ৫ কোটি টাকা তোলার এই ঘটনাকে স্থানীয়রা ‘রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ’ হিসেবে দেখছেন। তবে মান্নান এটি অস্বীকার করে বলেছেন, “টোল প্লাজার জমি আমার বাপ-দাদার। তারাই টোল তুলেছে।
শতাধিক বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাট:
অভিযোগ রয়েছে, ৫ আগস্ট থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত মান্নানের নেতৃত্বে তার সমর্থকরা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় শত শত ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও জায়গা জমি দখল এবং ভাঙচুর করে। নেতৃত্ব দেন তার ছেলে সজীব। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-
সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সোহাগ রনির টিপুরদী এলাকার কারখানায় অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট। পৌরসভার হাতকোপায় ৭নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি আবুল কাশেম মোল্লার বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট। সাদিপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ নেতা সালাউদ্দিন মাসুমের বাড়িতে হামলা। পাকুন্ডা গ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা শাদত আলীসহ ১৭টি বাড়িঘর ভাঙচুর। জামপুর ইউনিয়নে পল্লী চিকিৎসক বসুর দোকান ভাঙচুর ও দুটি গরু লুট।
জমি ও সম্পত্তি দখল: শুধু মোগরাপাড়ায় নয়, জামপুর, সাদিপুর, পৌরসভায় ‘জোরপূর্বক জমি দখল’ করে বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। ভুক্তভোগী মমতাজ বেগমের ক্ষেত্রে মান্নান দাবি করেন, “আদালতের রায়ে জমি ফেরত পেয়েছি”—কিন্তু স্থানীয় আইনজীবীরা বলছেন, ওই মামলায় ‘বন্দোবস্তি’ ছিল না, ছিল ‘জোরজবরদস্তি’।
প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রহীনতায় কি এমন মনোনয়ন। তা না হলে বিএনপি কেন এমন বিতর্কিত ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিলো?
দলীয় সূত্রে জানা যায়, মাস্ক ভোট ব্যাংক- মান্নানের ছেলে সজীবের নেতৃত্বে ৮০% নেতাকর্মীকে ‘ভয়ভীতি দেখিয়ে নিজের দলে ভেড়ানো’—যা ভোটের হিসাবে ‘শক্তি’ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
অর্থের শক্তি হিসেবে অভিযোগ রয়েছে, মান্নান তার মনোনয়ন নিশ্চিত করতে ঢাকার একটি শিল্প গ্রুপের মাধ্যমে দলে মোটা অঙ্কের ‘অর্থদান করেছেন।
এছাড়া আওয়ামী লীগের ‘বিচ্ছিন্ন অংশ’ এর সমর্থন। স্থানীয় বিএনপি নেতারা দাবি করেন, মান্নান আওয়ামী লীগের কিছু ‘ক্ষমতাচ্যুত’ নেতার সাথে যোগসাজশে কাজ করেন। ফলে তার ‘জয়ের সম্ভাবনা’ বেশি বলে দলকে ভুল বোঝানো হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের মতে, “বিএনপি এখনও ‘অর্থ ও বাহিনীনির্ভর’ প্রার্থী বাছাই করে। গেলো ১৫ বছরে দলটি গণতান্ত্রিকভাবে প্রার্থী নির্বাচনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলেনি। মান্নানের মনোনয়ন তারই প্রমাণ।”
বিশেষজ্ঞদের মতামত: গণতন্ত্রের জন্য হুমকি
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠানের গবেষক ড. নাসরীন সুলতানা বলেন, “মান্নানের মতো ব্যক্তিদের মনোনয়ন মানে—রাজনৈতিক দলগুলো এখনও ‘অপরাধীদের পুনর্বাসন কেন্দ্র’। এই প্রবণতা যদি না থামে, তাহলে আগামী দশকে আমরা ‘গণতন্ত্রের পরিবর্তে মাফিয়া রাষ্ট্র’ পাবো।”
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাখাওয়াত হোসেন বলেন, “নির্বাচন কমিশনের উচিত প্রার্থীদের ‘অপরাধ রেকর্ড’ যাচাই করা। কিন্তু আমাদের আইনে এই সুযোগ নেই। ফলে অপরাধীরাও নির্বাচিত হতে পারেন।”
নির্বাচনের আগে সংঘাত?
বিএনপির ভেতরে ‘বিদ্রোহ’ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। বঞ্চিত মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নিজেদের পক্ষে সমর্থন জোগাড় করছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই আসনে বিএনপির জয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল—কিন্তু মান্নানের মতো প্রার্থীর বিজয় মানে হবে “গণতন্ত্রের পরাজয়”।
এসব বিষয়ে, মান্নান অভিযোগগুলোকে “মিথ্যা ও অপপ্রচার” বলে অস্বীকার করেছেন। তিনি চাঁদাবাজি-দখলবাজির অভিযোগ অস্বীকার করে এবং নিজের জমি আদালতের রায়ে ফিরে পেয়েছেন বলে দাবি করেন। তিনি টোল প্লাজার টাকা তোলার অভিযোগ অস্বীকার, টোল প্লাজার জমি তার বাপ-দাদার বলে দাবি করেন। তিনি নিজ যোগ্যতায় মনোনয়ন পেয়েছেন বলে জানান।

















