ঢাকা ০৭:০৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫

মুক্তিযোদ্ধার ভূয়া সনদে লক্ষাধিক চাকুরি

হালিম মোহাম্মদ
  • আপডেট সময় : ১২২৪ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি
  • ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ও ভুয়া সন্তানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে প্রশাসন

  • ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিতে আপিল বিভাগের সমন্বিত নির্দেশনার জন্য আদালতের আদালতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার

  • অন্যের সন্তানদের নিজ সস্তান বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারের বিভিন্ন সেক্টরে চাকরি দেয়ার ঘটনা তদন্ত হচ্ছে

পতিত সরকারের আমলে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদে সরকারি চাকরি পেয়েছে ৯০ হাজারেরও বেশী। দলীয় স্বার্থ বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয়ে চাকরি পাওয়া এইসব সরকারি চাকরিজীবীদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। একইভাবে মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সন্তানদের সংখ্যাও এক লাখেরও বেশি হবে। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয় থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
গত সরকারের আমলে আদালতের মাধ্যমে অনেক অমুক্তিযোদ্ধাকে সনদ দেওয়া হয়েছে। আদালত এসব নির্দেশনা জারি করেন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মতো প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও। মুক্তিযোদ্ধা সনদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সকল অপকর্ম করেছেন বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার ক্ষিতারেরপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম। শুধু রফিকুল ইসলাম নয়, সারাদেশে এ রকম অনৈতিক কাজের হোতা আরো বহু মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিতে আপিল বিভাগের সমন্বিত নির্দেশনার জন্য আদালতের স্বরনাপন্ন হচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয়ে চাকরি পাওয়াদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে চাকরি নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে নেয়া হবে আইনগত ব্যবস্থা। এমনটাই বলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম। গত ৪ আগস্ট ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এক আলোচনা সভায় এ কথা বলেন উপদেষ্টা। বিগত সরকারের সময় অনেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ গ্রহণ করে নানা সুবিধা নিয়েছেন।
তিনি বলেন, ৯০ হাজার সরকারি চাকরিজীবী আছেন, যারা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয়ে চাকরি পেয়েছেন। তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। বিশেষ করে আদালতের মাধ্যমে অনেক অমুক্তিযোদ্ধাকে সনদ দেয়া হয়েছে। আদালত এসব নির্দেশনা জারি করেন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মতো প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও। অন্তর্বর্তী সরকার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিতে আপিল বিভাগের সমন্বিত নির্দেশনার জন্য আদালতের স্বরনাপন্ন হচ্ছেন।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তদন্তে গিয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার তালিকা লস্বা হচ্ছে। শুধু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সরকারের সকল সুবিধা নিচ্ছে তা নয়, তার ভুয়া সন্তান বানিয়ে সুবিধা নেয়াসহ কোটায় ওই সকল সন্তানদের চাকুরি দেয়া হয়েছে। বছরের পর বছর ভোগ করছেন সরকারের সকল সুযোগ সুবিধা। এমনই এক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্ধান মিলেছে। তিনি হলেন বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার ক্ষিতারেরপাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম। তার বদৌলতে ৭ ভুয়া সন্তানের কোটায় চাকরি পেলেন ৫ ভুয়া সন্তান। অনুসন্ধানে গিয়ে সবার সামনে এসেছে এক বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবার বিরল পিতৃত্বের ঘটনা।
জানা গেছে, বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার ক্ষিতারের পাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের ঔরসজাত সন্তান দু’জন হলেও আরো সাতজনের পিতৃত্ব গ্রহণ করে তাদের মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি ও অন্যান্য সুবিধা দিয়ে অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। রফিকুল ইসলাম সোনাতলা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার। এরইমধ্যে ভুয়া সনদে চাকরি নিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে রফিকুল ইসলাম ও তার তিন কথিত সন্তানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা মেলায় সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন তিনজন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম ও রেবেকা সুলতানা দম্পতির সন্তান রাশেদা আক্তার ও মোর্শেদা আক্তার দু’জনই গৃহিণী। তবে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তির সন্তানকে নিজের দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি ও অন্যান্য সুবিধা দিয়েছেন রফিকুল। এ জন্য সুবিধাপ্রাপ্তদের কাছ থেকে নেন মোটা অঙ্কের টাকা। এভাবে অন্তত অর্ধকোটি টাকা হাতিয়েছেন রফিকুল। শুধু তাই নয়, সামনে আসা সাত সন্তানের বাইরেও তার সনদ ব্যবহার করে কয়েকজন সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি করছেন।
আরও জানা গেছে, রফিকুলের ভুয়া সাত সন্তান হলেন, দুই ভাই আহসান হাবিব হান্নান ও জিয়াউর রহমান, বেলাল হোসেন, ফরহাদ হোসেন, সালেক উদ্দিন, রাকিব হাসান ও মৌসুমী আক্তার। তাদের মধ্যে হান্নান ও জিয়াউরের প্রকৃত বাবা সোনাতলার দক্ষিণ রানীরপাড়ার জাফর আলী। হান্নান চলতি বছর রফিকুলের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহার করে চাকরি পান এবং বর্তমানে গাইবান্ধা জেলা পুলিশের রিজার্ভ ফোর্সে কর্মরত (মামলার পর সাময়িক বরখাস্ত)। আর সনদের মাধ্যমে জিয়াউরকে সারের ডিলারসহ নানা ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছেন রফিকুল।
বেলালের আসল বাবা প্রয়াত জবেদ আলীর বাড়ি উপজেলার ক্ষিতারেরপাড়ায়। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তিনি কনস্টেবলের চাকরি পান ২০০১ সালে। ঢাকা মহানগর পুলিশের শাহবাগ ট্রাফিক জোনের এটিএসআই বেলালকে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সাময়িক বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। ফরহাদ হোসেনের প্রকৃত বাবা সোনাতলার ক্ষিতারেরপাড়ার জাহিদুল ইসলাম। তিনি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে চাকরি করছেন ফায়ার সার্ভিসে। অভিযোগের পর গাইবান্ধার ফুলছড়ি ফায়ার সার্ভিস থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
এ ছাড়া রফিকুলের সনদ নিয়ে উপজেলার ক্ষিতারেরপাড়ার নায়েব আলীর ছেলে সালেক কনস্টেবল হন ২০০৫ সালে। সোনাতলার পাশের জুমারবাড়ী এলাকার মৌমিনুল ইসলামের ছেলে রাকিব চাকরি করছেন সমাজসেবা অধিদপ্তরে। আর ভাই শহীদুল ইসলামের মেয়ে মৌসুমী আক্তারকে নিজের মেয়ে সাজিয়ে তিন বছর আগে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি আজিজুল হক কলেজে ভর্তি করেন রফিকুল।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, রফিকুলের সন্তান সাজিয়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার কারবার বেশ পুরোনো। মুক্তিযোদ্ধার সাইনবোর্ডের আড়ালে তিনি নানা অপকর্মে লিপ্ত। এসব দেখে ২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ দেন উপজেলার রানীরপাড়ার কেল্লাগাড়ী গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন ও নিমেরপাড়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার। অভিযোগে বলা হয়, এক স্ত্রী ও দুই মেয়ে রফিকুলের। অথচ তিনি অন্তত সাতজনকে সন্তান সাজিয়ে চাকরি পেতে সহায়তা করেছেন।
স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন ও আবদুস সাত্তার জানান, রফিকুল প্রতারক। অন্যের সন্তানকে নিজের দেখিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে চাকরি পেতে সহায়তা করেন। রফিকুল ও তার সনদে যারা চাকরি পেয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দাবি জানান তারা।
অভিযোগের পর মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান শুরু করে। দু’বছরে ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় দুদক বগুড়ার সহকারী পরিচালক জাহিদ হাসান গত ৩০ জানুয়ারি রফিকুল ও তার তিন ভুয়া সন্তানের বিরুদ্ধে পৃথক মামলা করেন।
এক এজাহারে বলা হয়, রফিকুল ও বেলাল যোগসাজশে মুক্তিযোদ্ধার সনদে চাকরি নিয়ে এ পর্যন্ত ৫০ লাখ ১৮ হাজার টাকার বেশি সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। অন্য দুই মামলায় একইভাবে হান্নানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ৫০ লাখ ১৮ হাজার ও ফরহাদের বিরুদ্ধে ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়।
দুদকের সহকারী পরিচালক বলেন, অনুসন্ধানে রফিকুল ও তিনজনের জালিয়াতির সত্যতা পাওয়া গেছে। অন্যদের বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে। এক সন্তান ফরহাদের বাবা জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘জন্মের পর আমার ছেলেকে দত্তক নেন রফিকুল। লেখাপড়া ও ভরণপোষণ দিয়ে তিনি বড় করে মুক্তিযোদ্ধার কোটায় চাকরি পেতে সহায়তা করেছেন। এতে দোষের কী আছে?
মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল বলেন, পালক হলেও তারা আমার নিজের সন্তানের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আমি তাদের মানুষ করেছি। পরে চাকরি পেতে সহায়তা করেছি। মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, আদালতে মোকাবিলা করব। এ নিয়ে বিচলিত নই।
এবিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয়ে চাকরি পাওয়াদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে চাকরি নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে আইনগত ব্যবস্থা। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তদন্ত পূর্বক তালিকা তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে তদন্তে সারাদেশে ৯০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্ধান পাওয়া গেছে। এ সকল ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা তাদের এবং অন্য মানুষের সন্তানদের নিজের সস্তান বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বিভিন্ন সরকারী সেক্টরে চাকুরি দিয়েছেন। তাদের বিষয়েও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

মুক্তিযোদ্ধার ভূয়া সনদে লক্ষাধিক চাকুরি

আপডেট সময় :
  • ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ও ভুয়া সন্তানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে প্রশাসন

  • ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিতে আপিল বিভাগের সমন্বিত নির্দেশনার জন্য আদালতের আদালতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার

  • অন্যের সন্তানদের নিজ সস্তান বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারের বিভিন্ন সেক্টরে চাকরি দেয়ার ঘটনা তদন্ত হচ্ছে

পতিত সরকারের আমলে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদে সরকারি চাকরি পেয়েছে ৯০ হাজারেরও বেশী। দলীয় স্বার্থ বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয়ে চাকরি পাওয়া এইসব সরকারি চাকরিজীবীদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। একইভাবে মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সন্তানদের সংখ্যাও এক লাখেরও বেশি হবে। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয় থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
গত সরকারের আমলে আদালতের মাধ্যমে অনেক অমুক্তিযোদ্ধাকে সনদ দেওয়া হয়েছে। আদালত এসব নির্দেশনা জারি করেন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মতো প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও। মুক্তিযোদ্ধা সনদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সকল অপকর্ম করেছেন বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার ক্ষিতারেরপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম। শুধু রফিকুল ইসলাম নয়, সারাদেশে এ রকম অনৈতিক কাজের হোতা আরো বহু মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিতে আপিল বিভাগের সমন্বিত নির্দেশনার জন্য আদালতের স্বরনাপন্ন হচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয়ে চাকরি পাওয়াদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে চাকরি নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে নেয়া হবে আইনগত ব্যবস্থা। এমনটাই বলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম। গত ৪ আগস্ট ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এক আলোচনা সভায় এ কথা বলেন উপদেষ্টা। বিগত সরকারের সময় অনেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ গ্রহণ করে নানা সুবিধা নিয়েছেন।
তিনি বলেন, ৯০ হাজার সরকারি চাকরিজীবী আছেন, যারা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয়ে চাকরি পেয়েছেন। তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। বিশেষ করে আদালতের মাধ্যমে অনেক অমুক্তিযোদ্ধাকে সনদ দেয়া হয়েছে। আদালত এসব নির্দেশনা জারি করেন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মতো প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও। অন্তর্বর্তী সরকার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিতে আপিল বিভাগের সমন্বিত নির্দেশনার জন্য আদালতের স্বরনাপন্ন হচ্ছেন।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তদন্তে গিয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার তালিকা লস্বা হচ্ছে। শুধু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সরকারের সকল সুবিধা নিচ্ছে তা নয়, তার ভুয়া সন্তান বানিয়ে সুবিধা নেয়াসহ কোটায় ওই সকল সন্তানদের চাকুরি দেয়া হয়েছে। বছরের পর বছর ভোগ করছেন সরকারের সকল সুযোগ সুবিধা। এমনই এক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্ধান মিলেছে। তিনি হলেন বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার ক্ষিতারেরপাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম। তার বদৌলতে ৭ ভুয়া সন্তানের কোটায় চাকরি পেলেন ৫ ভুয়া সন্তান। অনুসন্ধানে গিয়ে সবার সামনে এসেছে এক বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবার বিরল পিতৃত্বের ঘটনা।
জানা গেছে, বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার ক্ষিতারের পাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের ঔরসজাত সন্তান দু’জন হলেও আরো সাতজনের পিতৃত্ব গ্রহণ করে তাদের মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি ও অন্যান্য সুবিধা দিয়ে অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। রফিকুল ইসলাম সোনাতলা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার। এরইমধ্যে ভুয়া সনদে চাকরি নিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে রফিকুল ইসলাম ও তার তিন কথিত সন্তানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা মেলায় সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন তিনজন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম ও রেবেকা সুলতানা দম্পতির সন্তান রাশেদা আক্তার ও মোর্শেদা আক্তার দু’জনই গৃহিণী। তবে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তির সন্তানকে নিজের দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি ও অন্যান্য সুবিধা দিয়েছেন রফিকুল। এ জন্য সুবিধাপ্রাপ্তদের কাছ থেকে নেন মোটা অঙ্কের টাকা। এভাবে অন্তত অর্ধকোটি টাকা হাতিয়েছেন রফিকুল। শুধু তাই নয়, সামনে আসা সাত সন্তানের বাইরেও তার সনদ ব্যবহার করে কয়েকজন সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি করছেন।
আরও জানা গেছে, রফিকুলের ভুয়া সাত সন্তান হলেন, দুই ভাই আহসান হাবিব হান্নান ও জিয়াউর রহমান, বেলাল হোসেন, ফরহাদ হোসেন, সালেক উদ্দিন, রাকিব হাসান ও মৌসুমী আক্তার। তাদের মধ্যে হান্নান ও জিয়াউরের প্রকৃত বাবা সোনাতলার দক্ষিণ রানীরপাড়ার জাফর আলী। হান্নান চলতি বছর রফিকুলের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহার করে চাকরি পান এবং বর্তমানে গাইবান্ধা জেলা পুলিশের রিজার্ভ ফোর্সে কর্মরত (মামলার পর সাময়িক বরখাস্ত)। আর সনদের মাধ্যমে জিয়াউরকে সারের ডিলারসহ নানা ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছেন রফিকুল।
বেলালের আসল বাবা প্রয়াত জবেদ আলীর বাড়ি উপজেলার ক্ষিতারেরপাড়ায়। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তিনি কনস্টেবলের চাকরি পান ২০০১ সালে। ঢাকা মহানগর পুলিশের শাহবাগ ট্রাফিক জোনের এটিএসআই বেলালকে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সাময়িক বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। ফরহাদ হোসেনের প্রকৃত বাবা সোনাতলার ক্ষিতারেরপাড়ার জাহিদুল ইসলাম। তিনি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে চাকরি করছেন ফায়ার সার্ভিসে। অভিযোগের পর গাইবান্ধার ফুলছড়ি ফায়ার সার্ভিস থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
এ ছাড়া রফিকুলের সনদ নিয়ে উপজেলার ক্ষিতারেরপাড়ার নায়েব আলীর ছেলে সালেক কনস্টেবল হন ২০০৫ সালে। সোনাতলার পাশের জুমারবাড়ী এলাকার মৌমিনুল ইসলামের ছেলে রাকিব চাকরি করছেন সমাজসেবা অধিদপ্তরে। আর ভাই শহীদুল ইসলামের মেয়ে মৌসুমী আক্তারকে নিজের মেয়ে সাজিয়ে তিন বছর আগে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি আজিজুল হক কলেজে ভর্তি করেন রফিকুল।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, রফিকুলের সন্তান সাজিয়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার কারবার বেশ পুরোনো। মুক্তিযোদ্ধার সাইনবোর্ডের আড়ালে তিনি নানা অপকর্মে লিপ্ত। এসব দেখে ২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ দেন উপজেলার রানীরপাড়ার কেল্লাগাড়ী গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন ও নিমেরপাড়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার। অভিযোগে বলা হয়, এক স্ত্রী ও দুই মেয়ে রফিকুলের। অথচ তিনি অন্তত সাতজনকে সন্তান সাজিয়ে চাকরি পেতে সহায়তা করেছেন।
স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন ও আবদুস সাত্তার জানান, রফিকুল প্রতারক। অন্যের সন্তানকে নিজের দেখিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে চাকরি পেতে সহায়তা করেন। রফিকুল ও তার সনদে যারা চাকরি পেয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দাবি জানান তারা।
অভিযোগের পর মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান শুরু করে। দু’বছরে ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় দুদক বগুড়ার সহকারী পরিচালক জাহিদ হাসান গত ৩০ জানুয়ারি রফিকুল ও তার তিন ভুয়া সন্তানের বিরুদ্ধে পৃথক মামলা করেন।
এক এজাহারে বলা হয়, রফিকুল ও বেলাল যোগসাজশে মুক্তিযোদ্ধার সনদে চাকরি নিয়ে এ পর্যন্ত ৫০ লাখ ১৮ হাজার টাকার বেশি সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। অন্য দুই মামলায় একইভাবে হান্নানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ৫০ লাখ ১৮ হাজার ও ফরহাদের বিরুদ্ধে ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়।
দুদকের সহকারী পরিচালক বলেন, অনুসন্ধানে রফিকুল ও তিনজনের জালিয়াতির সত্যতা পাওয়া গেছে। অন্যদের বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে। এক সন্তান ফরহাদের বাবা জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘জন্মের পর আমার ছেলেকে দত্তক নেন রফিকুল। লেখাপড়া ও ভরণপোষণ দিয়ে তিনি বড় করে মুক্তিযোদ্ধার কোটায় চাকরি পেতে সহায়তা করেছেন। এতে দোষের কী আছে?
মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল বলেন, পালক হলেও তারা আমার নিজের সন্তানের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আমি তাদের মানুষ করেছি। পরে চাকরি পেতে সহায়তা করেছি। মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, আদালতে মোকাবিলা করব। এ নিয়ে বিচলিত নই।
এবিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয়ে চাকরি পাওয়াদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে চাকরি নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে আইনগত ব্যবস্থা। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তদন্ত পূর্বক তালিকা তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে তদন্তে সারাদেশে ৯০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্ধান পাওয়া গেছে। এ সকল ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা তাদের এবং অন্য মানুষের সন্তানদের নিজের সস্তান বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বিভিন্ন সরকারী সেক্টরে চাকুরি দিয়েছেন। তাদের বিষয়েও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।