মেট্রোরেলে পোয়াবারো
![](https://dailyganomukti.com/wp-content/uploads/2024/01/logo-by-iocn-min.png)
- আপডেট সময় : ১২:২৩:৩৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ৩৭ বার পড়া হয়েছে
স্বপ্নের মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর থেকেই রাজধানীর বৃহত্তর মিরপুরের বাড়িওয়ালাদের পোয়াবারো। বাসা বাড়ির ভাড়া পরিমানের দ্বিগুনেরও বেশি টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন। যা রাজধানীর মিরপুরে বসবাসরত অস্থায়ী বাসিন্দা বা ভাড়াটিয়াদের উপর খড়গ। শুধু তাই নয়, বছর না ঘুরতেই রাজধানীর বাড়িওয়ালারা নিজেদেও খেয়াল খুশি মতো বাড়ি ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। এহেন কাজের জন্য বিষয়টি অমানবিক বলে দাবি করেছেন ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার।
অভিযোগ রয়েছে, রাজধানীতে প্রতি বছর কোনো কারণ ছাড়াই বাড়ি ভাড়া বাড়ানো যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। আইনি বাধ্যবাধকতার তোয়াক্কা না করে নিজ নিয়মে ভাড়া বাড়িয়ে চলেছেন বাড়িওয়ালারা। লাগামহীন বাসা ভাড়া নিয়ন্ত্রণে সরকারের হস্তক্ষেপ চান ভাড়াটিয়ারা। মিরপুর ১০ নম্বর এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, ক্যালেন্ডারের পাতা ঘুরে জানুয়ারি এলেই যেমন বেড়ে যায় বাসা ভাড়া তেমনি সরকারের টাকায় মেট্রোরেল নির্মিত হলেও বাড়ির মালিকের যেন পোয়াবারো। যে কারণে মেট্রোরেল চালুর পর থেকে হু হু করে বেড়েছে মিরপুরের বাসা ভাড়া।
তিনি বলেন, এলাকা ভেদে যেখানে অনেক সচ্ছল মানুষও হিমশিম খাচ্ছে বাড়তি ভাড়া নিয়ে, সেখানে মধ্য ও স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে এটা এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে রাজধানী ঢাকা। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, ৩০৬ বর্গ কিলোমিটারের এই শহরের বর্তমান জনসংখ্যা ২ কোটির বেশি। জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বাসা ভাড়া। বাসা ভাড়ার জন্য মোট আয়ের ৩০ শতাংশ নির্ধারিত থাকলেও এলাকা ভেদে তা দ্বিগুণ হয়। একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অন্যদিকে বছর বছর বর্ধিত বাড়ি ভাড়ায় নাভিশ্বাস উঠেছে কর্মজীবীদের। ভাড়া নিয়ন্ত্রণে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে ১৯৯১ সালে। প্রায় তিন যুগ পেরলেও গঠিত হয়নি স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রক সংস্থা। নজরদারির জন্যও নেই কোনো মনিটরিং সেল।
সাত বছর ধরে ধানমন্ডিতে বসবাস করছেন চম্পা আক্তার নামে এক নারী। আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে খুঁজতে বেরিয়েছেন বাসা। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান, বাড়িওয়ালার মনমত ভাড়া বলে। ভাড়ার সঙ্গে সার্ভিস চার্জ সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে পছন্দের বাসায় উঠতে বাজেট ছাড়িয়ে যায়। আইনি বাধ্যবাধকতার তোয়াক্কা না করে রাজধানীতে প্রতিবছরই নিয়ম করে বাড়ছে বাসা ভাড়া। এ খবরে দিশেহারা ভাড়াটিয়ারা। ভাড়া কিছুটা কম বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করলেও তা কাজে আসছে না। উল্টো বাড়তি ভাড়া দিতে না পারায় বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিচ্ছেন। এলাকার প্রভাবশালীদের দিয়ে বাসা ছাড়তে চাপ দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বাড়ি ভাড়া সূচকে পাকা, আধা-পাকা এবং কাঁচা ও ঝুপড়ি ঘর- তিন ধরনের বাড়ির ভাড়া বেড়েছে বলে জানানো হয়েছে। কাঁচাঘরের ভাড়া সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ক্রমবর্ধমান বাড়ি ভাড়া নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। চলমান মূল্যস্ফীতির সঙ্গে এটি বাড়তি চাপ তৈরি করছে। এই বাড়তি খরচ কম আয়ের পরিবারগুলোর বোঝা দ্বিগুণ করে দেয়।
বাংলাদেশ ভাড়াটিয়া পরিষদের তথ্য বলছে, গেল ১০ বছরে রাজধানীতে ভাড়া বেড়েছে পাঁচ গুণ। ভাড়াটিয়াদের পক্ষে কথা বলা এ সংগঠন বাড়তি ভাড়ার যৌক্তিকতা চ্যালেঞ্জ করে একাধিক সরকারি দফতরের দ্বারস্থ হলেও আসেনি কোনো সমাধান। বাড়িওয়ালাদের বেশির ভাগই ভাড়া পরিশোধের রসিদ দেন না। অনেকে রসিদ দিলেও তাতে প্রকৃত ভাড়ার চেয়ে কম দেখানো হয়। এখন অনেক বাড়িওয়ালা বিকাশ বা নগদে ভাড়া নিচ্ছেন। ঠিক কত ভাড়া দিচ্ছেন তার প্রমাণ হিসেবে রসিদ না থাকায় অনেক ভাড়াটিয়া আইনের আশ্রয় নিতে পারছেন না।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজীম আল ইসলাম বলেন, বছরের শুরুতেই বিবেকহীনভাবে ভাড়া বাড়ানোর ঘটনা বেশি ঘটে। অনেক ভাড়াটিয়া আইনি জটিলতায় বাড়িওয়ালার স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেন না। অথচ বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী বাড়িওয়ালা যখন-তখন ভাড়া বাড়াতে পারবেন না। মালিক ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে আপসে ভাড়া ঠিক করতে হবে। দুই বছরের আগে বাড়ি ভাড়া বাড়ানো যাবে না।
আইন অনুযায়ী, বাড়িওয়ালা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য অতিরিক্ত আদায়কৃত টাকার দ্বিগুণ পর্যন্ত অর্থদ-ে দ-িত হবেন এবং পরবর্তী সময়ে প্রতিবার অপরাধের জন্য ওই অতিরিক্ত টাকার তিন গুণ দ-িত হবেন। বাড়িওয়ালা এক মাসের বেশি ভাড়া অগ্রিম হিসেবে নিতে পারবেন না। বাড়ি ভাড়া নিতে গেলে লিখিত চুক্তি করে নিতে হবে। বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়াকে ভাড়া গ্রহণের লিখিত রসিদ প্রদানে বাধ্য থাকবেন। চুক্তি অনুযায়ী ভাড়া পরিশোধ করে থাকলে ভাড়াটিয়াকে হঠাৎ করে উচ্ছেদ করা যায় না। ভাড়াটিয়া প্রয়োজন মনে করলে আদালতের আশ্রয় নিতে পারবেন। আইনের ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, একটি নির্দিষ্ট এলাকায় একজন নিয়ন্ত্রক ও উপনিয়ন্ত্রক থাকবেন। তাদের ভাড়া নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া আছে। ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার বলেন, বাসার বাড়তি ভাড়া নিয়ে আমরা বার বার কথা বলছি। কিন্তু কর্ণপাতও করছে না বাড়িওয়ালারা। সরকার তো কোনো কথাই বলে না। ভাড়া নৈরাজ্য নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলও কথা বলতে রাজি নয়। কারণ তাদের মধ্যেই ঢাকার অনেক বাসার মালিক রয়েছেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, নিরাপদ আবাসন নাগরিকের মৌলিক অধিকার। কিন্তু ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সরকার। তিনি আরও বলেন, ভাড়াটিয়ারা সরাসরি ভাড়া দিলে যত আইনই করুক না কেন বাড়িওয়ালাদের ভাড়া বাড়ানো নিয়ে আটকানো যাবে না। ভাড়ার বিষয়ে সরকার যদি কোনো একটা সংস্থা তৈরি করে, সেখানে যদি ভাড়াটিয়ারা ভাড়া দেয় তাহলে নিয়ন্ত্রণে থাকবে। পাশাপাশি সরকারও একটা রাজস্ব পাবে। বিশ্বের অনেক দেশেই এমনটা চালু রয়েছে।