ঢাকা ০৩:৫৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫

ঝালকাঠিতে জমে উঠেছে ভাসমান পেয়ারার হাট

শত কোটি টাকার পেয়ারা বাণিজ্যে চাঙ্গা ৫৫ গ্রামের অর্থনীতি

ঝালকাঠি অফিস
  • আপডেট সময় : ৪১ বার পড়া হয়েছে

oplus_0

দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র এ তিন মাস পাকা পেয়ারার মৌসুম। এ মৌসূমে পাকা পেয়ারার মৌ মৌ ঘ্রাণ নিতে এবং সবুজের সমারোহ দেখতে আসেন দেশ ও বিদেশের অনেক মানুষ। বাড়তি বিনোদনের জন্য রয়েছে একাধিক পিকনিক স্পট। এটা ভিয়েতনাম বা পৃথিবীর অন্য কোন দেশের কোথাও নয়। বাংলাদেশের দক্ষিণে উপকূলীয় জেলা ঝালকাঠির ভীমরুলী গ্রামে। সদর উপজেলার উত্তরদিকে অবস্থিত ভীমরুলী গ্রাম। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি, বরিশালের বানারীপাড়া এবং ঝালকাঠি সদর উপজেলার সীমান্তবর্তি এ গ্রামটিতে সবচেয়ে বড় মোকামে প্রতিদিন কয়েকলাখ টাকার পেয়ারা ক্রয়-বিক্রয় হয়। বরিশাল জেলার বানারীপাড়া, ঝালকাঠি জেলার সদর উপজেলা ও পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি ঘিরেই মূলত পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষ হয়। বানারীপাড়ার ১৬ গ্রামের ৯৩৭হেক্টর, ঝালকাঠি সদরের ১৩ গ্রামের ৩৫০হেক্টর, স্বরূপকাঠির ২৬গ্রামের ৬৪৫হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হয়। পেয়ারা চাষে এসব গ্রামের কয়েক হাজার পরিবারের দিনবদল হয়েছে।

এসব এলাকার মধ্যে ঝালকাঠির কীর্তিপাশা, ভিমরুলী, শতদশকাঠী, খাজুরিয়া, ডুমুরিয়া, কাপুড়াকাঠি, জগদীশপুর, মীরকাঠি, শাখা গাছির, হিমানন্দকাঠি, আদাকাঠি, রামপুর, শিমুলেশ্বর গ্রামের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারার চাষ হয়। স্বরূপকাঠির গ্রামগুলোর মধ্যে রয়েছে সঙ্গীতকাঠি, খায়েরকাঠি, ভদ্রানন্দ, বাচ্চুকাঠি, ভাংগুরা, আদাবাড়ি, রাজাপুর, ব্রাহ্মণকাঠি, ধলহার, জিন্দাকাঠি, আটঘর, কুড়িয়ানা, পূর্ব জলাবাড়ি, ইদিলকাঠি, আরামকাঠি, মাদ্রা, গণপতিকাঠি, আতাকাঠি, জামুয়া, জৈলশার, সোহাগদল, আদমকাঠি, অশ্বত্থকাঠি, সমীত, সেহাংগল ও আন্দারকুল। বানারীপাড়া উপজেলার মধ্যে রয়েছে তেতলা, সৈয়দকাঠি, মালিকান্দা, ব্রাহ্মণবাড়ি, বোয়ালিয়া, জম্বুদ্বীপ, বিশারকান্দি, মরিচবুনিয়া, মুরার বাড়ি, উমরের পাড়, লবণ সড়া, ইন্দির হাওলা, রাজ্জাকপুর, হলতা ও চুয়ারিপাড়।
এত্ত পেয়ারা! পেয়ারার রাজ্য! তাও আবার জলে ভেসে ভেসে ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় পণ্য নিয়ে ক্রয়-বিক্রয় চলে। পানির ওপর জলজ্যান্ত একটি হাট। পদ্মা সেতু হবার পরে সড়ক পথে দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা ট্রলার, ট্রাক, মিনিট্রাক ও পিকআপ নিয়ে আসেন। তারা সকাল ৯টা থেকে শুরু করে দুপুরের ১২টার মধ্যে ক্রয়ের পালা শেষ করে পেয়ারা আপলোড করে ছুটে চলে গন্তব্যে।
ঝালকাঠি সদর উপজেলার অন্তর্ভুক্ত ভীমরুলী গ্রামে এ ভাসমান জলবাজারের প্রধান পণ্য পেয়ারা। সারি সারি নৌকার ওপর কাঁচা-পাকা সবুজ-হলুদ পেয়ারা। এর ভারেই নৌকাও ডুবেছে দুই-তৃতীয়াংশ। হাটুরেদের হাঁকডাকে গম গম পুরো এলাকা। এক কথায় খালের ওপর এ এক আজব-অবাক করা বাজার।
স্থানীয়দের কাছে জানা গেল, এ অঞ্চলের ‘সবচেয়ে বড়’ ভাসমান হাট এটি; যা পুরো বাংলাদেশেই অনন্য। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড়! তাহলে কি আরো আছে এমন বাজার? হ্যাঁ, আছে তো- পাশের পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির (নেছারাবাদ) কুড়িয়ানা, আটঘর, আতা, ঝালকাঠির মাদ্রা। আরো অবাক করা বিষয় হলো, এসবই পিরোজপুর সন্ধ্যা নদী থেকে বয়ে আসা একই খালপাড়ে। ভীমরুলী জলে ভাসা হাটে পেয়ারা বোঝাই ডিঙি নৌকাগুলো একবার এপাশ, একবার ওপাশ, চাষিদের ভালো দামের আশায় এমন নড়চড়। খালের দু’পাশে আড়ৎ ব্যবসায়ীদের আড়ৎ। তারাই কিনবেন। বাংলাদেশের সিংহভাগ পেয়ারা উৎপাদনকারী অঞ্চলের চাষিরা ডিঙিতে বসে বিকিকিনিতে মগ্ন।

তাই দক্ষিণাঞ্চলের হাট-বাজার আর বাগান এলাকা জুড়ে পাকা পেয়ারার মৌ-মৌ ঘ্রাণ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। পাইকার এবং পেয়ারা চাষিদের বেচা কেনার ধূম চলছে পেয়ারার মোকাম (হাট-বাজার) গুলোতে। এ পেয়ারা বাগানে প্রায় ৩১ হাজার একর জমির উপর এ পেয়ারার রাজ্য। বাংলার আপেল খ্যাত পেয়ারার ভর মৌসুম শুরু হয়েছে।
এশিয়ার বিখ্যাত এ পেয়ারাকে স্থানীয় ভাষায় গৈয়া কিংবা সবরী বলা হয়। তবে জাতীয় ভাবে এটি পেয়ারা নামে পরিচিত। আর পুষ্টিমানের দিক থেকে একটি পেয়ারা ৪টি আপেলের সমতুল্য বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছে। তাই পেয়ারাকে ভালবেসে ‘বাংলার আপেল’ আবার কেউ ‘গরিবের আপেল’ হিসাবে গণ্য করে।
এখানে প্রতিবছর পেয়ারার মৌসুমে বিপুল পরিমানে সুস্বাদু পেয়ারা ফল উৎপাদন হয়ে থাকে। বাংলার আপেল নামে খ্যাত এ পেয়ারা এখানে প্রচুর উৎপাদন হলেও সংরক্ষণের অভাবে চাষীদের লোকসানের মুখে পড়তে হয় প্রতিবছরই। কারণ পেয়ারা দ্রুত পেকে যায়। তাই দ্রুত বিক্রি না করতে পারলে চাষিদের পড়তে হয় লোকসানের মুখে।

সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ থাকলে মৌসুমী এ ফল পেয়ারা বছর জুড়ে ভোক্তাদের চাহিদা মিটিয়ে চাষীরাও আর্থিকভাবে লাভবান হতো।
কিন্তু দীর্ঘদিনেও উদ্যোক্তার অভাবে হিমাগারসহ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে না উঠায় এবং উৎপাদন খরচ দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় চাষীরা পেয়ারা চাষাবাদে আগ্রহ হারাচ্ছে।
পেয়ারা চাষ ও ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এসব এলাকায় গড়ে উঠেছে ২০টিরও বেশি ছোট-বড় মৌসূমী ব্যবসা কেন্দ্র। স্থানীয়ভাবে বলা হয় পেয়ারার মোকাম। প্রতিদিন সকালে এসব মোকামে চাষিরা ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় সরাসরি বাগান থেকে পেয়ারা নিয়ে আসে পাইকারদের কাছে। তা কিনে ট্রলার যোগে নৌ পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও আবাসিক জেলায়।
এ বছর ফাল্গুনে পেয়ারা গাছে ফুল ধরার পর অতিরিক্ত খড়ায় পানির অভাব দেখা দেয়ায় ফুল ঝড়ার পাশাপাশি অনেক গাছও মারা যায়। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে পেয়ারা চাষিরা গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত সার এবং মাটি দিতে পারেনি। এসব কারণে পেয়ারার উৎপাদন কম হলেও দাম ভালো পাচ্ছেন চাষীরা। তবুও তাঁদের হতাশা কাটেনি। ১০বিঘার বাগান থেকে প্রতিদিন ১০মন পেয়ারা নামার কথা থাকলেও ৩থেকে ৫মন পেয়ারা নামছে। পেয়ারার সাইজ ও মান ভেদে একহাজার থেকে শুরু করে ১২শ টাকা বিক্রি হচ্ছে প্রতিমন।
ঝালকাঠির ভীমরুলী গ্রামের পেয়ারা চাষী ফনি ভুষন দাস জানান, খড়া এবং রোদের তাপের কারণে পেয়ারার মুকূল ও কচি পেয়ারা পুড়ে গেছে। একারণে এবছর উৎপাদন কম। প্রতিবছরের চেয়ে দাম ভালো হলেও উৎপাদন কম হওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী উপার্জন করতে পারছি না।
কাঁচাবালিয়া গ্রামের পেয়ারা চাষী জাহিদ মিয়া জানান, আমাদের ভাগ্য ভালো খড়ার কারণে ফলন ভালো না হওয়ার ভয় ছিলো। উপরওয়ালা সহায় থাকায় পেয়ারার ফলন এবার তবুও যা হয়েছে, ভালই হয়েছে। এইবার মৌসুমের শুরুতেই ২৫থেকে ৩০টাকা কেজি দরে প্রতি মন পেয়ারা ৮শ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে পেয়ারার দাম কমে গেছে। প্রতি মণ একহাজার থেকে ১২শ টাকা দরে বিক্রি করতে পারছি।
প্রতিবছর পেয়ারার মৌসূমে বিভিন্ন স্থান থেকে নৌ পথে পেয়ারা বাগানে আসে পর্যটকরা। পেয়ারা বাগানে এসে দেখে মুগ্ধ হয়ে এখান থেকে পেয়ারা কিনেও নিচ্ছেন পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য। বছরের পর বছর ধরে পেয়ারা উৎপাদিত এসব এলাকার চাষিদের একমাত্র সমস্যা হিমাগার ও সড়ক পথে যোগাযোগের যথোপযোগী ব্যবস্থা না থাকা।
এ ব্যাপারে ঝালকাঠির জগদীশপুর গ্রামের পেয়ারা চাষী বিমল মিস্ত্রি জানান, প্রতি বছর হিমাগারের অভাবে এসব এলাকার কয়েক কোটি টাকার পেয়ারা নষ্ট হয়ে যায়। কারণ পেয়ারা পচনশীল ফল। তাই দ্রুত পেকে যাওয়ায় তা সংরক্ষণ করে রাখার কোন ব্যবস্থা নেই।
আড়তদার লিটন হালদার বলেন, মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার মন পেয়ারা বিক্রি হয়। ভিমরুলী মোকাম থেকে সড়ক ও নৌ পথে খুলনা, ফেনী, ঢাকা, সিলেট, পটুয়াখালি, ভোলা, মাদারিপুর, নাটোর, বরিশাল হাজার হাজার মন পেয়ারা যাচ্ছে।
পেয়ারা এলাকার প্রায় ৭থেকে ৮ হাজার শ্রমজীবী মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থেকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।
পেয়ারা চাষী বিশ্বজিৎ চৌধুরী জানান, সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে বড় সাইজের পেয়ারা প্রসেসিং করে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। হেক্টর প্রতি ৫থেকে ৬মে. টন উৎপাদিত পেয়ারা থেকে বছরে প্রায় আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা আয় হয়।

ভীমরুলীর ভাসমান এ পেয়ারা হাট দেখতে আসা পর্যটক মো. ফারুক খান বলেন, অদ্ভুত সুন্দর ভাসমান এ হাট ও তার আশপাশের প্রকৃতি যে কতটা নজরকাড়া হতে পারে, এটি এখানে না এলে বোঝার উপায় নেই! প্রতিবছর শত শত দেশি বিদেশি পর্যটক এ স্থানে ভিড় জমান পুরো পেয়ারা মৌসুম জুড়েই। বাংলাদেশিদের জন্যও যা হতে পারে অপূর্ব ভ্রমণকেন্দ্র।

ঝালকাঠি জেলা প্রসাশক আশরাফুর রহমান জানান, সংরক্ষণসহ কৃষি ভিত্তিক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠলে চাষীরা আর্থিকভাবে লাভবান হতো। যুগ যুগ ধরে পেয়ারা চাষাবাদ করে আসলেও উদ্যোক্তার অভাবে হিমাগারসহ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে না ওঠায় দিন দিন চাষাবাদে আগ্রহ হারাচ্ছে পেয়ারা চাষীরা।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ঝালকাঠিতে জমে উঠেছে ভাসমান পেয়ারার হাট

শত কোটি টাকার পেয়ারা বাণিজ্যে চাঙ্গা ৫৫ গ্রামের অর্থনীতি

আপডেট সময় :

আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র এ তিন মাস পাকা পেয়ারার মৌসুম। এ মৌসূমে পাকা পেয়ারার মৌ মৌ ঘ্রাণ নিতে এবং সবুজের সমারোহ দেখতে আসেন দেশ ও বিদেশের অনেক মানুষ। বাড়তি বিনোদনের জন্য রয়েছে একাধিক পিকনিক স্পট। এটা ভিয়েতনাম বা পৃথিবীর অন্য কোন দেশের কোথাও নয়। বাংলাদেশের দক্ষিণে উপকূলীয় জেলা ঝালকাঠির ভীমরুলী গ্রামে। সদর উপজেলার উত্তরদিকে অবস্থিত ভীমরুলী গ্রাম। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি, বরিশালের বানারীপাড়া এবং ঝালকাঠি সদর উপজেলার সীমান্তবর্তি এ গ্রামটিতে সবচেয়ে বড় মোকামে প্রতিদিন কয়েকলাখ টাকার পেয়ারা ক্রয়-বিক্রয় হয়। বরিশাল জেলার বানারীপাড়া, ঝালকাঠি জেলার সদর উপজেলা ও পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি ঘিরেই মূলত পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষ হয়। বানারীপাড়ার ১৬ গ্রামের ৯৩৭হেক্টর, ঝালকাঠি সদরের ১৩ গ্রামের ৩৫০হেক্টর, স্বরূপকাঠির ২৬গ্রামের ৬৪৫হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হয়। পেয়ারা চাষে এসব গ্রামের কয়েক হাজার পরিবারের দিনবদল হয়েছে।

এসব এলাকার মধ্যে ঝালকাঠির কীর্তিপাশা, ভিমরুলী, শতদশকাঠী, খাজুরিয়া, ডুমুরিয়া, কাপুড়াকাঠি, জগদীশপুর, মীরকাঠি, শাখা গাছির, হিমানন্দকাঠি, আদাকাঠি, রামপুর, শিমুলেশ্বর গ্রামের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারার চাষ হয়। স্বরূপকাঠির গ্রামগুলোর মধ্যে রয়েছে সঙ্গীতকাঠি, খায়েরকাঠি, ভদ্রানন্দ, বাচ্চুকাঠি, ভাংগুরা, আদাবাড়ি, রাজাপুর, ব্রাহ্মণকাঠি, ধলহার, জিন্দাকাঠি, আটঘর, কুড়িয়ানা, পূর্ব জলাবাড়ি, ইদিলকাঠি, আরামকাঠি, মাদ্রা, গণপতিকাঠি, আতাকাঠি, জামুয়া, জৈলশার, সোহাগদল, আদমকাঠি, অশ্বত্থকাঠি, সমীত, সেহাংগল ও আন্দারকুল। বানারীপাড়া উপজেলার মধ্যে রয়েছে তেতলা, সৈয়দকাঠি, মালিকান্দা, ব্রাহ্মণবাড়ি, বোয়ালিয়া, জম্বুদ্বীপ, বিশারকান্দি, মরিচবুনিয়া, মুরার বাড়ি, উমরের পাড়, লবণ সড়া, ইন্দির হাওলা, রাজ্জাকপুর, হলতা ও চুয়ারিপাড়।
এত্ত পেয়ারা! পেয়ারার রাজ্য! তাও আবার জলে ভেসে ভেসে ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় পণ্য নিয়ে ক্রয়-বিক্রয় চলে। পানির ওপর জলজ্যান্ত একটি হাট। পদ্মা সেতু হবার পরে সড়ক পথে দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা ট্রলার, ট্রাক, মিনিট্রাক ও পিকআপ নিয়ে আসেন। তারা সকাল ৯টা থেকে শুরু করে দুপুরের ১২টার মধ্যে ক্রয়ের পালা শেষ করে পেয়ারা আপলোড করে ছুটে চলে গন্তব্যে।
ঝালকাঠি সদর উপজেলার অন্তর্ভুক্ত ভীমরুলী গ্রামে এ ভাসমান জলবাজারের প্রধান পণ্য পেয়ারা। সারি সারি নৌকার ওপর কাঁচা-পাকা সবুজ-হলুদ পেয়ারা। এর ভারেই নৌকাও ডুবেছে দুই-তৃতীয়াংশ। হাটুরেদের হাঁকডাকে গম গম পুরো এলাকা। এক কথায় খালের ওপর এ এক আজব-অবাক করা বাজার।
স্থানীয়দের কাছে জানা গেল, এ অঞ্চলের ‘সবচেয়ে বড়’ ভাসমান হাট এটি; যা পুরো বাংলাদেশেই অনন্য। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড়! তাহলে কি আরো আছে এমন বাজার? হ্যাঁ, আছে তো- পাশের পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির (নেছারাবাদ) কুড়িয়ানা, আটঘর, আতা, ঝালকাঠির মাদ্রা। আরো অবাক করা বিষয় হলো, এসবই পিরোজপুর সন্ধ্যা নদী থেকে বয়ে আসা একই খালপাড়ে। ভীমরুলী জলে ভাসা হাটে পেয়ারা বোঝাই ডিঙি নৌকাগুলো একবার এপাশ, একবার ওপাশ, চাষিদের ভালো দামের আশায় এমন নড়চড়। খালের দু’পাশে আড়ৎ ব্যবসায়ীদের আড়ৎ। তারাই কিনবেন। বাংলাদেশের সিংহভাগ পেয়ারা উৎপাদনকারী অঞ্চলের চাষিরা ডিঙিতে বসে বিকিকিনিতে মগ্ন।

তাই দক্ষিণাঞ্চলের হাট-বাজার আর বাগান এলাকা জুড়ে পাকা পেয়ারার মৌ-মৌ ঘ্রাণ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। পাইকার এবং পেয়ারা চাষিদের বেচা কেনার ধূম চলছে পেয়ারার মোকাম (হাট-বাজার) গুলোতে। এ পেয়ারা বাগানে প্রায় ৩১ হাজার একর জমির উপর এ পেয়ারার রাজ্য। বাংলার আপেল খ্যাত পেয়ারার ভর মৌসুম শুরু হয়েছে।
এশিয়ার বিখ্যাত এ পেয়ারাকে স্থানীয় ভাষায় গৈয়া কিংবা সবরী বলা হয়। তবে জাতীয় ভাবে এটি পেয়ারা নামে পরিচিত। আর পুষ্টিমানের দিক থেকে একটি পেয়ারা ৪টি আপেলের সমতুল্য বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছে। তাই পেয়ারাকে ভালবেসে ‘বাংলার আপেল’ আবার কেউ ‘গরিবের আপেল’ হিসাবে গণ্য করে।
এখানে প্রতিবছর পেয়ারার মৌসুমে বিপুল পরিমানে সুস্বাদু পেয়ারা ফল উৎপাদন হয়ে থাকে। বাংলার আপেল নামে খ্যাত এ পেয়ারা এখানে প্রচুর উৎপাদন হলেও সংরক্ষণের অভাবে চাষীদের লোকসানের মুখে পড়তে হয় প্রতিবছরই। কারণ পেয়ারা দ্রুত পেকে যায়। তাই দ্রুত বিক্রি না করতে পারলে চাষিদের পড়তে হয় লোকসানের মুখে।

সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ থাকলে মৌসুমী এ ফল পেয়ারা বছর জুড়ে ভোক্তাদের চাহিদা মিটিয়ে চাষীরাও আর্থিকভাবে লাভবান হতো।
কিন্তু দীর্ঘদিনেও উদ্যোক্তার অভাবে হিমাগারসহ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে না উঠায় এবং উৎপাদন খরচ দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় চাষীরা পেয়ারা চাষাবাদে আগ্রহ হারাচ্ছে।
পেয়ারা চাষ ও ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এসব এলাকায় গড়ে উঠেছে ২০টিরও বেশি ছোট-বড় মৌসূমী ব্যবসা কেন্দ্র। স্থানীয়ভাবে বলা হয় পেয়ারার মোকাম। প্রতিদিন সকালে এসব মোকামে চাষিরা ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় সরাসরি বাগান থেকে পেয়ারা নিয়ে আসে পাইকারদের কাছে। তা কিনে ট্রলার যোগে নৌ পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও আবাসিক জেলায়।
এ বছর ফাল্গুনে পেয়ারা গাছে ফুল ধরার পর অতিরিক্ত খড়ায় পানির অভাব দেখা দেয়ায় ফুল ঝড়ার পাশাপাশি অনেক গাছও মারা যায়। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে পেয়ারা চাষিরা গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত সার এবং মাটি দিতে পারেনি। এসব কারণে পেয়ারার উৎপাদন কম হলেও দাম ভালো পাচ্ছেন চাষীরা। তবুও তাঁদের হতাশা কাটেনি। ১০বিঘার বাগান থেকে প্রতিদিন ১০মন পেয়ারা নামার কথা থাকলেও ৩থেকে ৫মন পেয়ারা নামছে। পেয়ারার সাইজ ও মান ভেদে একহাজার থেকে শুরু করে ১২শ টাকা বিক্রি হচ্ছে প্রতিমন।
ঝালকাঠির ভীমরুলী গ্রামের পেয়ারা চাষী ফনি ভুষন দাস জানান, খড়া এবং রোদের তাপের কারণে পেয়ারার মুকূল ও কচি পেয়ারা পুড়ে গেছে। একারণে এবছর উৎপাদন কম। প্রতিবছরের চেয়ে দাম ভালো হলেও উৎপাদন কম হওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী উপার্জন করতে পারছি না।
কাঁচাবালিয়া গ্রামের পেয়ারা চাষী জাহিদ মিয়া জানান, আমাদের ভাগ্য ভালো খড়ার কারণে ফলন ভালো না হওয়ার ভয় ছিলো। উপরওয়ালা সহায় থাকায় পেয়ারার ফলন এবার তবুও যা হয়েছে, ভালই হয়েছে। এইবার মৌসুমের শুরুতেই ২৫থেকে ৩০টাকা কেজি দরে প্রতি মন পেয়ারা ৮শ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে পেয়ারার দাম কমে গেছে। প্রতি মণ একহাজার থেকে ১২শ টাকা দরে বিক্রি করতে পারছি।
প্রতিবছর পেয়ারার মৌসূমে বিভিন্ন স্থান থেকে নৌ পথে পেয়ারা বাগানে আসে পর্যটকরা। পেয়ারা বাগানে এসে দেখে মুগ্ধ হয়ে এখান থেকে পেয়ারা কিনেও নিচ্ছেন পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য। বছরের পর বছর ধরে পেয়ারা উৎপাদিত এসব এলাকার চাষিদের একমাত্র সমস্যা হিমাগার ও সড়ক পথে যোগাযোগের যথোপযোগী ব্যবস্থা না থাকা।
এ ব্যাপারে ঝালকাঠির জগদীশপুর গ্রামের পেয়ারা চাষী বিমল মিস্ত্রি জানান, প্রতি বছর হিমাগারের অভাবে এসব এলাকার কয়েক কোটি টাকার পেয়ারা নষ্ট হয়ে যায়। কারণ পেয়ারা পচনশীল ফল। তাই দ্রুত পেকে যাওয়ায় তা সংরক্ষণ করে রাখার কোন ব্যবস্থা নেই।
আড়তদার লিটন হালদার বলেন, মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার মন পেয়ারা বিক্রি হয়। ভিমরুলী মোকাম থেকে সড়ক ও নৌ পথে খুলনা, ফেনী, ঢাকা, সিলেট, পটুয়াখালি, ভোলা, মাদারিপুর, নাটোর, বরিশাল হাজার হাজার মন পেয়ারা যাচ্ছে।
পেয়ারা এলাকার প্রায় ৭থেকে ৮ হাজার শ্রমজীবী মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থেকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।
পেয়ারা চাষী বিশ্বজিৎ চৌধুরী জানান, সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে বড় সাইজের পেয়ারা প্রসেসিং করে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। হেক্টর প্রতি ৫থেকে ৬মে. টন উৎপাদিত পেয়ারা থেকে বছরে প্রায় আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা আয় হয়।

ভীমরুলীর ভাসমান এ পেয়ারা হাট দেখতে আসা পর্যটক মো. ফারুক খান বলেন, অদ্ভুত সুন্দর ভাসমান এ হাট ও তার আশপাশের প্রকৃতি যে কতটা নজরকাড়া হতে পারে, এটি এখানে না এলে বোঝার উপায় নেই! প্রতিবছর শত শত দেশি বিদেশি পর্যটক এ স্থানে ভিড় জমান পুরো পেয়ারা মৌসুম জুড়েই। বাংলাদেশিদের জন্যও যা হতে পারে অপূর্ব ভ্রমণকেন্দ্র।

ঝালকাঠি জেলা প্রসাশক আশরাফুর রহমান জানান, সংরক্ষণসহ কৃষি ভিত্তিক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠলে চাষীরা আর্থিকভাবে লাভবান হতো। যুগ যুগ ধরে পেয়ারা চাষাবাদ করে আসলেও উদ্যোক্তার অভাবে হিমাগারসহ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে না ওঠায় দিন দিন চাষাবাদে আগ্রহ হারাচ্ছে পেয়ারা চাষীরা।