স্বৈরশাষক হাসিনার পলায়নের ৫ মাস
- আপডেট সময় : ১১:২৮:১৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৬ জানুয়ারী ২০২৫ ৬০ বার পড়া হয়েছে
২০১৪ এবং ২০১৮ সালে বিতর্কিত নির্বাচনে সরকার গঠনের পর ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি আরেকটি বিতর্কিত ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে ফের ক্ষমতার মসনদে বসেন শেখ হাসিনা।
নির্বাচন নয়, লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে অনেকটা চর দখলের কায়দায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন শেখ হাসিনা, এটাই সাধারণের ভাষ্য।
জানুয়ারিতে সরকার গঠনের পর থেকে বড় ধরনের কোনো আন্দোলন বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পড়তে হয়নি শেখ হাসিনাকে।
ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতন ও শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের পাঁচ মাস পূর্ণ হয়েছে ৫ জানুয়ারি। এই পাঁচ মাসে কল রেকর্ড ফাঁস, চট করে দেশে ঢুকে পড়াসহ হাসিনার নানান চটকদার বক্তব্য পাওয়া গেছে।
২০২৪ সালের শুরুতে ডামি নির্বাচনে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার মাত্র ৭ মাসের মাথায় তীব্র জনরোষে গত ৫ আগস্ট গদি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন টানা চারবারের প্রধানমন্ত্রী।
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরির নিয়োগে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগ সরকারের গ্রিন সিগনাল অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৫ জুন সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল করার রায় দেন হাইকোর্ট। কোটা সংস্কারের দাবিতে আবারও শুরু হয় আন্দোলন।
ধীরে ধীরে তীব্র রূপ নেয় আন্দোলন। শুরুতে আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। গত ১৪ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। তার এই বিস্ফোরক মন্তব্যে আন্দোলন তীব্র রূপ নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দাবানলের মতো আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন।
বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের দাবানলে আরেক দফা ঘি ঢালেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, তৎকালীন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, কোটা বিরোধী আন্দোলন ঠেকাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট। আওয়ামী লীগে সাধারণ সম্পাদকের উস্কানিতে ছাত্রলীগ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর দানবিয় কায়দায় হামলা চালায়।
ছাত্রলীগ আর পুলিশ দুই পেটুয়াবাহীনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর সরাসরি হামলা, গুলি চালায়। তাতে একে একে শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়।
ছাত্রলীগ বহিরাগতদের নিয়ে আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর হামলার পর দেশজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনের বারুদ ছড়িয়ে পড়ে। এক রাতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
১৬ জুলাই স্বৈরচার শাষকের পেটুয়াবাহিনী পুলিশ রংপুরে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে সরাসরি গুলি চালিয়ে হত্যা করে। দুই হাত উঁচু করে ঢাল হয়ে রাজপথে দাঁড়িয়ে ছিলেন আবু সাঈদ। তার মৃত্যুর দৃশ্য মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। তীব্রতা বাড়তে থাকে আন্দোলনের। ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে যুক্ত হয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। লাশের মিছিল বাড়তে থাকে, সেই সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতাও বাড়তে থাকে।
পরবর্তী কয়েকদিন দেশজুড়ে ব্যাপক সহিংসতা দেখা দেয়। কারফিউ জারি, কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট, ছররা গুলির পাশাপাশি তাজা গুলি ব্যবহার করে পুলিশ। হেলিকপ্টার থেকেও গুলি করা হয় আন্দোলনকারীদের ওপর। পুলিশ, র্যাব, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে শত শত ছাত্র-জনতা প্রাণ হারায়।
ব্যাপক প্রাণহানি ও নৃশংসতার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার আন্দোলন কিছুটা দমন করতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে আদালত কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি পুনর্বহালের পরিবর্তে সংস্কার করে। ৫৬ শতাংশ থেকে কোটা ১০ শতাংশে নেমে আসে।
ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনায় কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন পরিণত হয় সরকার পতনের আন্দোলনে। এক পর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের গোয়েন্দা কার্যালয়ে বসিয়ে ভাত খাওয়ানো এবং সেই ছবি-ভিডিও প্রচার করা, তাদের দিয়ে জোর করে বিবৃতি আদায় করা হয় ইত্যাদি নাটক করে পুলিশ। কিন্তু মানুষ এতে আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ফের রাস্তায় নেমে আসে।
সরকার আরও কঠোর হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ৪ আগস্ট মাঠে নামানো হয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সন্ত্রাসীদের। তীব্র জনরোষে ময়দানে টিকতে পারেনি আওয়ামী লীগ। সেনাবাহিনীকে ছাত্র-জনতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার সবশেষ চেষ্টা চালায় হাসিনা। কিন্তু সেনাবাহিনীর বড় অংশ ছাত্র-জনতাকে গুলি করতে অস্বীকৃতি জানায়। চাপে পড়ে সেনাবাহিনীর হাইকমান্ড, ছাত্র-জনতার বুকে গুলি না করার সিদ্ধান্ত নেন সেনাসদস্যরা।
৫ আগস্ট সকাল থেকে কার্ফিউ উপেক্ষা করে ঢাকাসহ সারাদেশে ছাত্র-জনতার ঢল নামে। ঢাকার আশপাশের মানুষ শেখ হাসিনাকে গদি থেকে উৎখাতের জন্য গণভবনের দিকে ছুটতে থাকেন। শেখ হাসিনা গণভবন থেকে পালানোর জন্য মাত্র ৪৫ মিনিট সময় পান।
তীব্র জনরোষ থেকে কোনোরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী।
৮ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আমন্ত্রণে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার।
পাবলিক টয়লেট
৪ আগস্টেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছিল নেতাকর্মীদের আনাগোনায় সরগরম। হাসিনার পলায়নের পর থেকে কোন নেতাকর্মীকে দেখা যায় না। ৫ আগস্ট বিক্ষুদ্ধ ছাত্র-জনতার হামলা-ভাঙচুরে পরিত্যক্ত ভবনে পরিণত হয় আওয়ামী লীগের অফিস। ভবনটিকে এখন গণশৌচাগার হিসেবে ব্যবহর করছে ছিন্নমূল মানুষ।
৫ আগস্ট পতনের পর শেখ হাসিনাসহ দলটির অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতা ছাড়াও জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মীও ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যায়। যারা দেশ ছাড়তে পারেননি তারাও চলে যায় আত্মগোপনে।
৫ আগস্ট পালানোর পর এক ধাক্কায় আওয়ামী লীগ পুরো দেশ থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ১৫ আগস্টকে কেন্দ্র করে প্রথম উসকানি দেন। সাধারণ নেতাকর্মীদের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানান।
শেখ হাসিনা ও জয়ের আহ্বান সোশ্যাল মিডিয়ার গুজব ও উসকানিতে বিভ্রান্ত হয়ে ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে এসে গণপিটুনির শিকার হন কয়েকজন নেতাকর্মী।
দ্বিতীয় দফায় ১০ নভেম্বরে নূর হোসেন দিবস উপলক্ষে আবারও নেতাকর্মীদের উসকানি দিয়ে গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে সমবেত করার চেষ্টা করেন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা।
সেদিনও ২০/৩০ জন নেতাকর্মী সেখানে জড়ো হন, যাদের কয়েকজনকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা।