হোটেল চালিয়েও থেমে নেই নাসরিনের শিক্ষা জীবণ, স্বপ্ন বুনছেন ডাক্তার হবার
- আপডেট সময় : ৭৩ বার পড়া হয়েছে
প্রায় ৫ বছর ধরে কাজ করেন খাবার হোটেলে। আবার চালিয়ে যাচ্ছেন পড়া লেখাও। অনেক খাবার হোটেলের ভিড়ে মনের অজান্তেই চোখ যেন থেমে যায় ছোট্ট একটি হোটেলে, যেখানে কাজ করেন ১৮ বছরের কলেজ পড়ুয়া এক মেধাবী শিক্ষার্থী নাসনির আক্তার তার নামেই হোটেলটির নামকরণ করা হয়েছে ‘নাসরিন হোটেল’। আজ থেকে প্রায় ১২ বছর আগে হোটেলটি চালু করেন তার বাবা মোকাব্বর মণ্ডল। বাবার সাথে খুবই ছোট্ট পরিসরে এই হোটেল চালাচ্ছেন কলেজ পড়ুয়া।
জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার বৈরাগীহাট মোড়ে গেলেই চোখে পড়ে নাসরিন হোটেল। এই হোটেল চালিয়েই সংসার ও পড়াশোনার খরচ চালান নাসরিন। এসএসসি পরীক্ষায় এ+ পেয়ে তিনি বর্তমানে উপজেলার কালাই সরকারি মহিলা কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত। তার স্বপ্ন উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো ফলাফল করে মেডিকেলে পড়াশোনা করার।
সরেজমিন দেখা যায়, শত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও এই শিক্ষার্থী বাবার সাথে চালিয়ে যাচ্ছেন খাবার হোটেলের কাজ। বর্তমান আধুনিকতার আদলে চাকচিক্যময় হোটেলের ভিড়ে নিজের হোটেলটি টিকিয়ে রাখতে রীতিমতো ঘাম ঝড়াচ্ছেন তিনি।এলাকাবাসী ও বিভিন্ন মানুষের কটু কথা শুনেও থামিয়ে যাননি এই সংগ্রামী কলেজ শিক্ষার্থী। নিজেই নিপুণ হাতেই তৈরি করছেন পুঁড়ি, পিঁয়াজু, সিংগারা, সামুচা, মোগলাই, চানাচুরসহ বাহারী খাবার। রান্না করেন ভাত, মাছ, মাংসসহ হরেক রকমের সবজী। আবার পরিবেশন ও করছেন নিজের ।
স্বল্প মূল্যে সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করায় এলাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাস্টমাররা ছুটে আসে তার হোটেলে। খাবার খেতে আসা কাস্টমরা বলছেন এই হোটেলের খাবার দামে কম হলেও মানে অনেক ভালো ও সুস্বাদু।
হোটেল এ খেতে আসা ট্রাকচালক হাফিজুল ইসলাম বলেন, আমার বাড়ি বগুড়া। আমি এই এলাকায় আসি কারণ গাড়ি চালাই। আমি এখানে আসছি গাড়ি লোড করতে। এই হোটেলের খাবারের মান অনেক ভালো।
খাবার খাচ্ছিলেন মোখলেছুর রহমান নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, আমার বাসা দিনাজপুর। আমি এই দিকে হরেক মালের ব্যবসা করি। বাড়ির মতো রান্নার স্বাদ পাওয়ায় এ হোটেলে খাওয়া দাওয়া করি। সকালে খিচুড়ি খেয়েছি, দুপুরে ডিম ভাজি, ডাল, ভর্তা দিয়ে ভাত খেলাম। একই বিষযে পাশের মুদি দোকানি জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমার পাশেই নাসরিন হোটেল। তাদের হোটেলে আর্থিক সমস্যার কারণে তারা কোন কারিগর বা মেসিয়ার রাখতে পারেনা। এ কারণে মেয়ে হয়েও সে তার বাবার হোটেলের যাবতীয় কাজে সাহায্য করে থাকনে। পাশাপাশি আবার সে পড়াশোনাও করেন। সে একজন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। এসএসসিতে এ+ পেয়েছে।
কলেজ শিক্ষার্থী নাসরিন আক্তার বলেন, আমরা গরিব মানুষ। আমাদের হোটেলটি খুব ছোট। টাকার অভাবে হোটেলে কারিগর রাখা হয়না। কারিগর রাখতে হলে তাকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে হয়। যেটা আমার বাবা দিতে পারবে না। তাই আমি নিজেই এ কাজগুলো করি। আমি স্কুলে পড়াশোনার সময় তখনকার কারিগরের কাছে কাজগুলো শিখেছি। কালাই সরকারি মহিলা কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করছি। আমি ভোর ৫টা-৮টা পর্যন্ত কাজ করে কলেজে যাই। এরপর কলেজ ছুটি দিলে ৩টার দিকে বাড়িতে আসি। তারপর বিকাল ৪টা-রাত ১০টা পর্যন্ত হোটেলে মা-বাবার কাজে সাহায্য করি। দিনে ৩-৪ হাজার টাকা বেচাকেনা হয়।
নাসরিন আক্তারের বাবা মোকাব্বর মণ্ডল বলেন, আমার মেয়ে কালাই সরকারি মহিলা কলেজ পড়াশোনা করছে। সকালে কাজ শেষ করে কলেজে যায় আবার কলেজ থেকে ফিরে এসে বিকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করে। আমার মেয়েই আমাকে সব কাজে সহযোগিতা করে। মেয়ে হয়েও আমাকে একজন ছেলের মতোই কাজে সহযোগিতা করে এতে আমি গর্বিত।
কালাই সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ নাজিম উদ্দিন বলেন, সে ব্যবসা করে লেখাপড়া চালায় এবং কস্টের মধ্যে দিয়ে লেখাপড়া করেই এসএসসি পাস করে এখানে ভর্তি হয়েছে। শুনে আমি খুব অবাক বিস্ময়ে তাকালাম, এই মেয়েটা তো খুব মেধাবী। এই মেয়েটাকে সহযোগিতা করা হলে কাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
কালাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামিমা আক্তার জাহান বলেন, বৈরাগীর মোড়ে নাসরিন হোটেলে নাসরিন আক্তার পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার সাথে বাবার হোটেলে কাজ করছে এটা একটা চমৎকার উদ্যোগ। তবে, এ কাজটি করতে গিয়ে তার পড়াশোনার যেন ক্ষতি না হয়, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। তাকে যতটুকু আর্থিক সহযোগিতা করা যায় উপজেলা প্রশাসন থেকে প্রয়োজনে সেটা আমরা অবশ্যই করব।
ছোট্ট হোটেলের চুলার আগুন আর খাতার পাতার অক্ষরের মাঝেই যেন নাসরিন স্বপ্ন বুনে চলেছেন তাঁর ।পরিবারকে ভরসা দেওয়ার পাশাপাশি দেশের জন্যও সম্পদ হয়ে ওঠার প্রতিজ্ঞা তাঁর। সংগ্রামী এই কলেজছাত্রী বিশ্বাস করেন, একদিন মেডিকেলে ভর্তি হয়ে তিনি ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন।

















