খুন হচ্ছে একের পর এক
- আপডেট সময় : ৪২ বার পড়া হয়েছে
পুরান ঢাকার আদালতপাড়া থেকে হাজিরা শেষে ফেরার পথে গতকাল সোমবার জনসন রোডের ন্যাশনাল হাসপাতালের সামনে গুলিতে নিহত ব্যক্তি শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুন (৫৫)। ভর দুপুরে দিনের আলোয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে মামুনকে উপুর্যপরি গুলিতে হত্যা করা হয় । ঠিক একই ভাবে আদালত পাড়ার আঙ্গিনায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে খুন হয়েছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসীর মশিউর রহমান কচির ছোট ভাই আজাদ। তৎকালিন শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীরের অনুসারী খোরশেদ, গাজী সুমন, ইব্রাহিমসগ ৭ থেকে ৮ জন আজাদকে আদালতের আঙ্গিনায় গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া একই প্রক্রিয়ায় বিকেল সাড়ে তিনটান দিকে আদালতে হাজিরা দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার পথে ইমন, মোল্লা মাসুদ ও সুব্রত বাইনের লোকজন মুরগী মিলনকে গুলি করে হত্যা করে।
অপরদিকে পুরনো ঢাকার ফাইভ স্টার ও সেভেন স্টার গ্রুপের রোষানলে পড়ে আদালতের অদুরে কোর্ট হাউজ ষ্টীটে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় আইনজীবি হাবিবুর রহমান মন্ডলকে। আদালত পাড়ার আশপাশে একই ভাবে খুন, ছিনতাই এবং দুস্যুতা প্রতারণার ঘটনা এখন নিত্য দিনের। একের পর এক মানুশষ খুনের ঘটনায় আদালতপাড়ার নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে আদালত পাড়ায়
আইন শৃংখলার বিষয়ে প্রশাসনের বিশেষ নজর দেয়া উচিত। তা না হলে স্পর্শকাতর হিসেবে আদালতে হাজিরার বিষয়টি আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
আদালতপাড়ার অদুরে দিনের আলোয়ে মামুন হত্যার পরই পুলিশ প্রশাসন নড়ে চড়ে বসে। পুলিশের প্রোফাইলে নিহত মামুন ছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী। জানা গেছে, চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী ও সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই সাঈদ আহমেদ টিপু হত্যা মামলার আসামি ছিলেন নিহত মামুন। শুধু তাই নয়, ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম ঘোষণা করে সরকার। সেই তালিকায় মোল্লা মাসুদ ছিলেন ১৩ নম্বরে। তাঁকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণার পাশাপাশি সারা দেশে ছবিসহ পোস্টার সাঁটানো হয়েছিল। দেশের ইমিগ্রেশনে তাঁর ছবিও টাঙিয়ে দেওয়া হয়। ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে। এরপর মোল্লা মাসুদ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আস্তানা গাড়েন। আবার ফিরে আসেন। সর্বশেষ ২০০৪ সালে ঢাকায় ‘ক্রসফায়ার’ শুরু হলে সুব্রত বাইন আস্তানা গুটিয়ে ভারতে চলে যান। তাঁর সঙ্গে মোল্লা মাসুদও পালিয়ে যান। এরপর থেকে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে মোল্লা মাসুদের উপস্থিতির কথা শোনা যায়নি। তবে ভারতে বসে ঢাকায় চাঁদাবাজির কথা শোনা যেত হরহামেশা।
পুলিশের খাতায় লেখা আছে, মোল্লা মাসুদের আদি নিবাস ঝালকাঠি সদর উপজেলার পোনাবালিয়া ইউনিয়নের সুগন্ধা নদীতীরবর্তী মহদিপুর গ্রামে। শহর থেকে সুগন্ধা নদী পাড়ি দিয়ে সেখানে যেতে হয়। মোল্লা মাসুদের বাবার নাম আমজাদ হোসেন। কিন্তু তাঁর জীবন শুরু হয় মাদ্রাসায় পড়তে আসার পর। রমনার মীরবাগে একটি মাদ্রাসা থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন সিদ্ধেশ্বরী কলেজে। সেই কলেজে থাকার সময় জড়িয়ে পড়েন অপরাধ কর্মকান্ডে। সে সময় সারা দিন মাথায় টুপি দিয়ে ঘুরে বেড়াতেন বলে তাঁর নাম হয়ে যায় ‘মোল্লা মাসুদ’।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মগবাজারের বিশাল সেন্টারে ছিল তাঁদের আস্তানা। বিশাল সেন্টারের একটি দোকান নিয়ে মুরাদ নামের এক যুবক খুন হন। এই খুনই ছিল মোল্লা মাসুদের হাতেখড়ি। এরপর একে একে খুনে জড়িয়ে পড়েন মোল্লা মাসুদ। সর্বশেষ তাঁর বিরুদ্ধে ৩০টির বেশি মামলা ছিল। এগুলোর মধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদারের ভাগনে মামুন হত্যা, পুরান ঢাকায় মুরগি মিলন হত্যা। এ ছাড়া খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ায় আসিফসহ ট্রিপল মার্ডার নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছিল। মোল্লা মাসুদের বিরুদ্ধে কত জিডি ছিল, তার হিসাব নেই।
১৯৯৭ সালের দিকে মোল্লা মাসুদ, সুব্রত বাইন, জয়, টিক্কা, আসিফ, জন ও চঞ্চল জোট করেন। পরে দ্বন্দ্বের কারণে সেটি ভেঙে যায়। এরপরই খিলগাঁও এলাকার একটি বাসায় পাঁচ খুনের ঘটনা ঘটে। নিহতদের মধ্যে জন ও আসিফ ছিলেন।
এই দলকে সামাল দিতে লিয়াকত-মুরগি মিলন নেপথ্যে থেকে রাজা, অপু, আনোয়ার, মশিউর রহমান কচিকে নিয়ে আলাদা একটি জোট করেন। তাঁদের একমাত্র কাজ ছিল ঢাকা সিটি করপোরেশনের ঠিকাদারি কাজের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। পরে সেই দ্বন্দ্বের জের ধরে কচির ভাই আজাদ, মুরগি মিলন, আসিফ, জনসহ বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটে। মুরগি মিলন হত্যাকান্ডে মোল্লা মাসুদও জড়িত বলে অভিযোগ ছিল। ১৯৯৯ সালের দিকে সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদের গ্রুপের সদস্যরা যুবলীগ নেতা লিয়াকতের গাড়িতে হামলা করেছিলেন। এ ঘটনায় অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান লিয়াকত। পরবর্তীতে ইস্কাটন থেকে লিয়াকত অপহরনের পর নিখোঁজ হয়ে যায়। অদ্যাবধি তাকে জীবিত বা মৃত পাওয়া যায়নি।
অনুসন্থানে আরো জানা যায়, ২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি চালায় একদল সন্ত্রাসী। সেই গুলি লেগেছিল মোটরসাইকেল আরোহী ভুবন চন্দ্র শীলের মাথায়। পরে ২৫ সেপ্টেম্বর ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে ভুবন চন্দ্র শীল মারা যান।
ঘটনার পর পুলিশ বলেছিল, শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়েছিলেন কারাবন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমনের লোকজন। ওই গুলি লেগেছিল ভুবনের মাথায়। কয়েক মাস আগে শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন জামিনে মুক্ত হন।
শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন ও তারিক সাইফ মামুন একসময় ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও এলাকার আতঙ্ক ছিলেন। তাদের গড়ে তোলা বাহিনীর নাম ছিল ‘ইমন-মামুন’ বাহিনী। তারা দুজনই চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী ও সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই সাঈদ আহমেদ টিপু হত্যা মামলার আসামি।
এদিকে সাড়ে ১১টার দিকে তারিক সাইফ মামুনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ বলছে, দুর্বৃত্তরা খুব কাছ থেকে ওই ব্যক্তিকে গুলি করেছে। ওই ব্যক্তির কাছ থেকে পরিচয়পত্র পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। প্রাথমিকভাবে পুলিশ জানিয়েছে ওই ব্যক্তির নাম তারিক সাইফ মামুন। তার বাড়ি লক্ষ্মীপুরে।
জানতে চাইলে ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মল্লিক আহসান উদ্দিন সামী জানান, নিহত ব্যক্তি শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন। এ বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন। কোতোয়ালি থানায় পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. ইয়াসিন বলেন, গুলির শব্দ শুনতে পেয়ে ন্যাশনাল হাসপাতালের সামনে এসে দেখি অজ্ঞাত এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছেন। খুব কাছ থেকে তাকে গুলি করা হয়েছে।
পুলিশ বলেছে, বিকেল পাচটায় এরিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মামুন নিহতের ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এদিকে মামুনের লাশ উদ্ধার এবং ময়না তদন্তের জন্য মিটফোর্ড হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।



















