ছাত্র-জনতার লাশ পোড়ানো নব্য হিটলার পুলিশ ইন্সপেক্টর আরাফাত গ্রেপ্তার
- আপডেট সময় : ০২:৩৬:৩৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৭৫ বার পড়া হয়েছে
গুলিবিদ্ধ মরদেহ গুনে গুনে ভ্যানে তুলছেন পুলিশ সদস্যরা। পরিত্যক্ত ব্যানার দিয়ে সেগুলো ঢেকে দেওয়া হয়। পুলিশের ভেস্ট আর হেলমেট পরা সদস্যদের একজন ঢাকা উত্তরের গোয়েন্দা পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা নব্য হিটলার আরাফাত হোসেন। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পরে আত্মগোপনে চলে যান তিনি
ছাত্র-জনতার আন্দোলন তখন চূড়ান্ত নিশায় পৌছে গেছে। এই আন্দোলনে শ’ শ’ মানুষকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করেছে হাসিনা পুলিশ। হাসিনার পতন তখন দ্বারপ্রান্তে। সময়টা ৫ই আগস্ট।
এদিন ঢাকার আশুলিয়া থানার সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত ছাত্র-জনতার লাশ একটি স্তুপাকারে রেখে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় পুলিশের ইন্সপেক্টর আরাফাত হোসেন। নাব্য হিটলার সেই আরাফাতকে ঢাকার আফতাবনগর থেকে বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) রাতে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
র্যাব-৩ শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) খুদে বার্তায় গ্রেপ্তারের তথ্য জানায়।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ঘুরছে ১ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের গা শিউরে ওঠা এক ভিডিও। গুলিবিদ্ধ মরদেহ গুনে গুনে ভ্যানে তুলছেন পুলিশ সদস্যরা। পরে একটি পরিত্যক্ত ব্যানার দিয়ে সেগুলো ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। ভিডিওতে পুলিশের ভেস্ট আর হেলমেট পরা যাদের দেখা গেছে, তাদের মধ্যে একজন ঢাকা উত্তরের গোয়েন্দা পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা নব্য হিটলার আরাফাত হোসেন। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পরে আত্মগোপনে চলে যান তিনি।
সেদিন কার নির্দেশে ডিবির টিম আশুলিয়ায় দায়িত্বে ছিল জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর (ডিবি) পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ঢাকা জেলা পুলিশের এসপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত আব্দুল্লাহিল কাফীর নির্দেশে সেদিন তারা আশুলিয়ায় যায়।
নিহতের স্বজনরা হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। এক নিহতের স্বজন মো. শাহিন বলেন, লাশ পুড়ে যাওয়ার কারণে চিনতে পারিনি। পরে ভিডিও বের হওয়ার পর পোশাক দেখে চিনতে পেরেছি। এ ঘটনার বিচার চাই।
আশুলিয়ায় ঘটনার মূল কারিগর সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সুপার নিউমারারি পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আব্দুল্লাহিল কাফীকে বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) পাঁচ দিনের রিমান্ডের নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত। গত ২ সেপ্টেম্বর বিমানবন্দর থেকে কাফীকে আটক করে ডিবি পুলিশ।
নব্য হিটলার পুলিশ ইন্সপেক্টর আরাফাত
ঘটনার বর্ণনা
গত ৫ আগস্ট সাভারের আশুলিয়া থানার সামনে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছুড়ে হত্যার রাজত্ব কায়েম করে পুলিশ। ভয়ংকর সেই দিন আর কী কী ঘটেছিল তার রোমহর্ষক বর্ণনা দেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
থানার সামনের বিল্ডিং থেকে পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রনি আহমেদ নামের এক ব্যক্তি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, বিকেলে থানা ফটকের সামনে উত্তেজিত জনতার ওপর পুলিশ গুলি ছোড়া হয়। এতে থানার গেটের সামনেই ১০ থেকে ১২ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান। কয়েক মিনিট ধরে ওখানে গোলাগুলি চলে। পরে জীবিত কয়েকজনকে নিচু হয়ে এসে ছাত্ররা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যান। তারপরেও ৬ থেকে ৭ জন ওখানে পড়েছিল। তখন আশপাশের সব অলিগলি জনগণ ঘিরে ফেলে। রাস্তা থেকেও লোকজন থানার দিকে রওনা হয়। পরে থানা থেকে সব পুলিশ সশস্ত্র হয়ে একযোগে বেরিয়ে আসেন। তারা গুলি করতে করতে বেরিয়ে আসেন।
তিনি আরও জানান, ভ্যানে লাশের স্তুপ করা জায়গাটি পলিমারস অ্যান্ড প্লাস্টিসাইজারস লিমিটেডের অফিসার ফ্যামিলি কোয়াটারের গেটে। গেইটের অপরপাশে সাদিয়া রাজশাহী কনফেকশনারী এন্ড মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিক ফাহিমা আক্তার গণমাধ্যমকে বলেন, ঘটনাটি আমার দোকানের সামনেই ঘটেছে।
৫ আগস্ট বিকালে সাড়ে ৪টা হবে। সেদিন গুলি খেয়ে থানার সামনে পড়ে থাকা মরদেহগুলো ভ্যানে তুলছিলেন পুলিশ। আমাদের চোখের সামনেই তুলেছে। প্রথমে লাশগুলো তুলে ব্যানার দিয়ে ঢেকে থানার সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সেই ঘটনা এখনো চোখের সামনে ভাসে।
সেদিন নিহতের স্বজন ও হাসপাতাল এবং সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্ট সকাল ৯টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের গুলিতে অন্তত ৩১ জন নিহত হন। পরদিন গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ১৫ জন মারা যান। এতে ঘটনায় মোট নিহতের সংখ্যা ৪৬ জন। গুলিবিদ্ধ হয়ে ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, আশুলিয়ার নারী ও শিশু হাসপাতাল, আশুলিয়ার হাবিব ক্লিনিক, গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক হাসপাতাল, এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সাভারের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নেন প্রায় দেড় হাজারের বেশি মানুষ।
পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় গত বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৭০ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় ভুক্তভোগীর পরিবারের পক্ষে অ্যাডভোকেট হুজ্জাতুল ইসলাম আল ফেসানী পৃথক দুটি অভিযোগ করেন।
মামলার আসামিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সালমান এফ রহমান, আজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন, ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহিল কাফী, বেক্সিমকো লিমিটেডের সিকিউরিটি ইনচার্জ মেজর (অব.) আরিফ, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ২ নস্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মনতাজউদ্দিন মণ্ডল, কাশিমপুর থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শরীফ ব্যাপারী, কাশিমপুর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাক আহমদ। কাশিমপুর থানা ছাত্রলীগের সাবের আহমেদ সজীব, সাবেক এমপি সাইদুল ইসলাম, মো. নাদিম হোসেন।
আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এএফএম সায়েদ, আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাসুদুর রহমান, আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (অপারেশন) নির্মল কুমার দাস, আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (ইন্টেলিজেন্স) মিজানুর রহমান মিজান, আশুলিয়া থানার এএসআই বিশ্বজিত রায়, আশুলিয়া থানার কনস্টেবল মুকুল, ঢাকা উত্তরের ডিবির পুলিশ পরিদর্শক আরাফাত হোসেন, ঢাকা উত্তরের ডিবির এসআই মালেক, ঢাকা উত্তরের ডিবির এসআই মো. রকিবুল, ঢাকা উত্তরের ডিবির এসআই আবুল হাসান, ঢাকা উত্তরের ডিবির এসআই হামিদুর রহমান, ঢাকা উত্তরের ডিবির এসআই নাসির উদ্দিন, ঢাকা উত্তরের ডিবির এসআই আবদুল মালেক, ঢাকা উত্তরের ডিবির এসআই জলিল এবং ঢাকা উত্তরের ডিবির এএসআই সুমন চন্দ্র গাইন।