ফেনীর ছাএ আন্দোলনের শহীদ শিহাব হত্যা মামলা এখন রাজনৈতিক হয়রানীমূলক মামলা
- আপডেট সময় : ৩২ বার পড়া হয়েছে
- পুএ হত্যা মামলার বাদী নিজেও জানে তার মামলার বর্তমান হাল হকিকত
- গ্রেফতার কৃত আসামীদের ১৬৪ ধারায় মূলক জবানবন্ধী প্রদান
- পুলিশের তদন্তে ১৫১ জনের নামে চার্জসিট প্রদানের পরেও
২৪ শের বৈষম্য বিরোধী ছাএদের জুলাই আন্দোলনের ৪ঠা আগষ্ট ২০২৪ ইং ফেনী মহিপালে সংঘটিত এবং ঘটনাস্হলে নিহত আহমেদ শিহাব। ফ্যাসীবাদীদের গুলিতে শহীদ হন তিনি। আওয়ামী সশস্ত্র ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ক্যাডারদের প্রকাশ্যে করা উপর্যুপরি গুলি লাগে তার পিঠে। এবং পরবর্তীতে তাকে ধরে এনে তার কপালে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যার ঘটনায় করা ফেনীর আদালতে শিহাবের মাতা বাদী হয়ে করা মামলা এখন রাজনৈতিক হয়রানি মামলা তালিকায় নথিবদ্ধ ফেনীর জেলা প্রশাষনে ।
গতবছর চার আগস্ট ফেনীর মহিপালে জুলাই আন্দোলন সুএে বৈষম্য বিরোধী ছাএ আন্দোলনের সমাবেশ হচ্ছিল ফেনীর মহিপালে । সেই সমাবেশে আওয়ামী ও ফ্যাসীবাদী আগ্রাসনের দোষরদের সংমিশ্রণে চালানো হামলায় সমাবেশ স্থলে শিহাবসহ শহীদ হন ৭ জন। এ ব্যাপারে ফেনীতে প্রত্যেকটি হত্যার ঘটনায় আলাদা আলাদা মামলা হয়। কিন্তু জুলাই শহীদ শিহাব হত্যা মামলা নিয়ে কোণ এক অদৃশ্য শক্তির নির্দেশনায় ঘটে অকল্পনীয়, অসম্ভব এক বিশাল প্রতারণা।
দেশের বিচার বিভাগের রেকর্ডে এ পর্যন্ত এমন ঘটনা কোথায় ঘটেনি। ঘটবেও না। কিন্তু ফেনীতে যা ঘটেছে তা শুনলে জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ার মতো অবস্থা। বাদী জানেন না। বাদীপক্ষের আইনজীবীও জানেন না। বিগত সরকারের রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারে জেলা পর্যায়ে কমিটি করে অন্তর্বর্তী সরকার। এ কমিটি যাচাই-বাছাই করে প্রত্যাহারযোগ্য মামলাগুলো কমিটির সদস্য সরকারি পাবলিক প্রসিকিউটরের স্বাক্ষরে আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা বলা হয়। ফেনী থেকে এমন ৫৮০টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করে পাঠানো হয় মন্ত্রণালয়ে। এর মধ্যে রহস্যজনকভাবে তালিকায় দেয়া হয় জুলাই শহীদ শিহাবের মামলাটিও। এজন্য করা হয় নানা কৌশল।
শিহাব হত্যার ঘটনায় গত বছর ২০শে আগস্ট ফেনী সদর মডেল থানায় মামলা করেন তার মা মাহফুজা আক্তার। মামলা নম্বর- ১৪, জিআর-৩৭২/২০২৪। এতে প্রধান আসামি করা হয় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীকে। অন্য আসামির মধ্যে রয়েছেন ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহম্মেদ নাসিম, ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী। এরইমধ্যে শিহাব হত্যা মামলায় ১৫১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে পুলিশ।
মামলাটিতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে আটক আসামিরা। এ মামলা কীভাবে কেন বিগত সরকারের হয়রানিমূলক মামলার অন্তর্ভুক্ত হলো? এ নিয়ে নানা প্রশ্ন সর্বত্র। জেলা প্রশাসন কর্তৃক গঠিত মামলা প্রত্যাহার সংক্রান্ত কমিটির যাচাই-বাছাইক্রমে জেলা আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মেছবাহ উদ্দীন খানের সুপারিশটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় চলতি বছরের ২৩শে র্মাচ। এতে নির্দিষ্ট ফরমে উল্লেখ করা হয়, সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলী আদালত ফেনী সদর-এ মামলাটি তদন্তাধীন। ঘটনার স্থান হিসেবে ফেনী থানাধীন তথ্য দিয়ে এফআইআর অনুযায়ী মামলার নিচের দিকের দুই আসামির নাম উল্লেখ করা হয়। নামের ক্রমিক নং উল্লেখ করা হয় আবদুল্লাহ আল মহসিন ও আবুল কালাম ওরফে ছালাম উল্যাহর নাম। সুপারিশপত্রে ফেনী থানার মামলা নম্বর দেখানো হয়েছে ২৫, তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১১/২৪, আর জিআর ৩৭২/২৪। প্রকৃত পক্ষে শিহাব হত্যায় ফেনী থানায় মামলা নম্বর-১৪, জিআর-৩৭২/২০২৪। এখানে প্রধান আসামিসহ তিন সাবেক এমপি’র কারও নাম দেখানো হয়নি কৌশলে। তাদের নাম দিলে বিষয়টি খোলাসা হয়ে যাবে। আর সমস্যায় পড়বে জেলা কমিটি। এভাবেই আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের তালিকায় জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত শিহাবের মামলাটি তালিকায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়। অথচ মন্ত্রণালয় থেকে তালিকা চাওয়া হয় ৫ই আগস্টের আগে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের রাজনৈতিক হয়রানি মামলার তালিকা। সে তালিকা তৈরির জন্য জেলা পর্যায় ও মন্ত্রণালয়ে দু’টি কমিঠি গঠন করা হয়। জেলা পর্যায়ের কমিটিতে রয়েছেন- জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার. চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা ও দায়রা জজের একজন করে প্রতিনিধি এবং পিপি এ কমিটির সদস্য। এ কমিটি জনগণের কাছে হয়রানিমূলক মামলার নির্দিষ্ট কিছু কাগজপত্রসহ আবেদন চায়। বিভিন্ন মাধ্যমে আবেদন যাচাই-বাছাই করে এ কমিটি ৫৮০টি মামলা প্রত্যাহারের জন্য গত বছর ১৬ই ডিসেম্বর সুপারিশ পাঠায় মন্ত্রণালয়ে। প্রতিটি মামলায় পিপি নিজে স্বাক্ষর করে তা পাঠানো হয়। এ সব মামলা থেকে ইতিমধ্যে ২৩১টি মামলা প্রত্যাহার করতে চলতি বছর ৩০শে জুন জেলা পিপি’র কাছে চিঠি পাঠায় মন্ত্রণালয়। বাকিগুলো পর্যালোচনার জন্য রাখা হয়। তবে জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত শিহাবের মামলাটি প্রত্যাহারের সুপারিশে পিপি স্বাক্ষর ও মামলাটি প্রত্যাহারযোগ্য সিল দেয়া হয়। তারিখ দেন ২৩/৩/২০২৫ ইং। প্রশ্ন ওঠে কত কৌশল খাটানো হয়েছে এ মামলা প্রত্যাহারের চেষ্টায়। মামলাটির থানার নম্বর ও তারিখ সুকৌশলে গোপন করে প্রকৃত মামলাটি প্রত্যাহারের অপচেষ্টা বলে মনে করছেন এক আইনজীবী।
শহীদ শিহাবের মামলার আইনজীবী মেজবাহ উদ্দিন ভূঞার কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বিষয়টি শুনে অবাক হন। তিনি বলেন, বাদী শত প্রতিকূলতার মাঝেও পুত্র হত্যার বিচারের অপেক্ষায় দিন গুনছেন। আমার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রক্ষা করছেন। এছাড়া প্রশাসন ও আদালত সর্বাত্মক সহযোগিতা করছেন জুলাই অভ্যুত্থানের মামলার বিচার নিশ্চিতে। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করার কথাও জানান তিনি।
মেজবাহ উদ্দিন ভূঁঞা বলেন, শিহাব যেদিন মারা যায় সেদিন শেষ বক্তা ছিলাম আমি। আমার বক্তব্য দেয়ার মাঝেই ছাত্রলীগ যুবলীগের নেতাকর্মীরা সশস্ত্র হামলা চালায়। সেখানে ৭ জন নিহত হয়। এই ৭টি মামলার দায়িত্বই আমি নিয়েছি। বিনা-পয়সায় এ মামলাগুলো আমি চালাবো প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। যেখানে মামলার বিচারের জন্য শহীদ পরিবারগুলো গুমরে কাঁদছে সেখানে শিহাবের মামলা প্রত্যাহারের আবেদন খুবই রহস্যজনক।
তিনি বলেন, এছাড়াও পরদিন ৫ই আগস্ট শহরের বড় মসজিদের সামনে গুলিতে নিহত হন একজন। এ মামলাটিও আমি আইনজীবী হিসাবে লড়ছি।
এ ব্যাপারে শিহাবের পরিবারও কিছু জানেন না। তারা নিশ্চিত আইন-প্রশাসন আর আইনজীবী মিলে সবাই মামলা নিয়ে একাট্টা।
ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ কাশিমপুর গ্রামে শহীদ শিহাবের বাড়ি। শিহাবের বাবা সিরাজুল ইসলাম সিরাজ থাকেন সৌদি আরব। পুত্রের মুত্যু সংবাদ শুনে তিনি দেশে আসেন। মা মাহফুজা আক্তার। তিনিই শিহাব হত্যা মামলার বাদী। শিহাবের মা মাহফুজা আক্তার তুলে ধরেন তার ছেলে হত্যার ঘটনা, মামলা ও মামলা পরবর্তী অবস্থা।
জানান শত চেষ্টা করেও ছেলেকে হাসিনা সরকার বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়া থেকে বিরত রাখা যায়নি। ৪ঠা আগস্ট চার থেকে পাঁচবার বাড়ি থেকে মহিপাল আন্দোলনে অংশ নেন শিহাব। সবশেষ মাকে বলে আসেন হাসিনার পতন ঘটিয়েই বাড়ি ফিরবেন। আর বন্ধুদের আগের রাতে বলেছিলো এ আন্দোলনে যদি শহীদ হওয়া যেতো! মাহফুজা বলেন, তার এই চাওয়া যে আল্লাহ্ কবুল করে নেবেন কে জানতো? মাহফুজা বেগম বলেন, সন্তান শহীদের মর্যাদা পেয়েছে। এখন আমার দাবি হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি- মৃত্যুদণ্ড।
শিহাবের মা ও বাবা জানান- কয়েকদিনে অন্তত ৫ জনের মাধ্যমে মামলা থেকে আসামির নাম বাদ দেয়ার প্রস্তাব এসেছে। বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকার অফার এসেছে। সবশেষ ২৬শে সেপ্টেম্বর তিনজনকে মামলা থেকে বাদ দিলে তিন লাখ টাকার প্রস্তাব দেয়া হয়। মাহফুজা বলেন, ছেলে হারিয়েছি। আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির প্রত্যাশায় আদালত থেকে থানা, পুলিশ ও আইনজীবী পর্যন্ত তীক্ষ্ণ নজর রাখছি।
তিনি বলেন- কোটি টাকা পেলেও ছেলে আর ফিরবে না, তাই বিচারে কোনো আপস করা হবে না। মামলাটি আইনজীবী মেজবাহ উদ্দিন ভূঞা বিনা খরচে পরিচালনা করছেন বলেও জানান- মাহফুজা।
এ ব্যাপারে জেলা আদালতের পাবলিক প্রসিকিটউর (পিপি) মেছবাহ উদ্দীন খান বলেন, এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। বিষয়টি আমার নলেজে নেই।
শহীদ শিহাবের মামলা প্রত্যাহারের তালিকায় যাওয়ার কোনো কারণ নেই। শিহাবের মামলা তো চার্জশিট হয়েছে। সেটা তো প্রত্যাহার হওয়ার কারণ নেই। এমনও হতে পারে কম্পিউটার মিসটেক হতে পারে। তিনি বলেন, আমরা এ পর্যন্ত যেসব মামলা প্রত্যাহার করার জন্য সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি এরমধ্যে ২৩১টি এ পর্যন্ত প্রত্যাহার হয়েছে।
শিহাবের মামলার বিষয়টি অফিস খুললে নথি দেখে বলতে পারবো। সাত শহীদের মামলা প্রত্যাহার করে রেখেছি। মামলা না ৮ টি? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, আসলে ৮ জন নয়, সাতজন শহীদ হন। একটি মামলা হয়েছিল গুলি করে ছাত্রলীগের ছেলেরা যাওয়ার সময় ট্রেনের ধাক্কায় মারা যায়। সেটি শহীদ হিসাবে মামলা হয়েছিল। সেটি বাদ দেয়া হয়েছে। আসলে মামলা ৭টি। মামলা প্রত্যাহারে কৌশল করা হয়েছে।
যেমন এক নম্বর আসামি মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, তারপর রয়েছেন আলাউদ্দিন নাসিম, নিজাম হাজারী প্রত্যাহারের তালিকায় তাদের নাম না দিয়ে নিচের দিকের দুইজনের নাম দেয়া হয়েছে। যার জিআর নং ৩৭২/২৪। পিপি বলেন, আসলে আমি এ মুহূর্তে আপনাকে কোনোটাই শিউর করে বলতে পারছি না। কাগজপত্র দেখে বলতে হবে।





















