সীমান্ত হত্যা কোন সভ্যদেশ সমর্থন করে না
- আপডেট সময় : ১০:১৬:৫৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৯৯ বার পড়া হয়েছে
বিশেষ প্রতিনিধি
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ( বিএসএফ) সদস্যরা ফেলানী খাতুন নামের এক কিশোরীকে গুলি করে হত্যা করে। কাঁটাতারের বেড়ায় ফেলানীর ঝুলন্ত লাশের ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ফেলানী হত্যাকান্ডের বিষয়ে নিন্দার ঝড় আছড়ে পড়ে গোটা দুনিয়ায়। ফেলানীর লাশ পাঁচ ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলে থাকা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের চিত্র। এ ঘটনায় বিএসএফ নিজস্ব আদালতে দায়ী সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত হত্যা মানবাধিকারের কোন মাফকাঠিতে পড়ে না। বিএসএফের গুলিতে মানুষ হত্যা কতটা মর্মান্তিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘন হতে পারে তার প্রমাণ ফেলানি হত্যাকান্ড। সীমান্ত হত্যাকান্ড হলেই কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানীর লাশ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এই দুঃস্বপ্ন যখন মানুষ কিছুটা ভোলার চেষ্টা করে, তখন একটা সীমান্তের একটা হত্যাকণ্ড ফেলানীর চিত্র সামনে ভেসে ওঠে।
গতকাল সোমবার ভোর রাত তিনটা নাগাদ ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীর ধনতালা ইউনিয়নের কান্তিভিটা সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে জয়ন্ত কুমার সিংহ (১৫) নামের এক বাংলাদেশি কিশোর নিহত হয়েছে। বাবা মহাদেব কুমার সিংহসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে ভারতে যাচ্ছিল জয়ন্ত। তারা ধনতালা বিজিবি সীমান্তের মেইন পিলার ৩৯৩ এর পাশ দিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশ করে। এসময় ভারতের ডিংগাপাড়া ক্যামের বিএসএফ তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালালে কিশোর জয়ন্ত ঘটনা স্থলেই মারা যায়। বিএসএফ তার মরদেহ নিয়ে যায়। এসময় জয়ন্তর বাবা মহাদেব কুমার সিংহ ও নিটালডোবা গ্রামের দরবার আলীর ছেলে বাংঠু মোহাম্মাদ আহত হয়। তারা বাংলাদেশে ফিরে রংপুরে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
বিএসএফের গুলিতে নিহত জয়ন্ত কুমার সিংহ
স্থানীয় লোকজনের বরাত দিয়ে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ধনতলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সমর কুমার চট্টোপাধ্যায় সংবাদমাধ্যমকে জানান, রোববার দিবাগত রাত তিনটার দিকে ধনতলা সীমান্ত এলাকার ৩৯৩ নম্বর মেইন পিলার এলাকা দিয়ে একদল লোক স্থানীয় দালালের সহযোগিতায় ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ভারতের কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার সময় বিএসএফের ডিঙ্গাপাড়া ক্যাম্পের সদস্যরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়লে জয়ন্ত ঘটনাস্থলে মারা যায়। বিএসএফের সদস্যরা তার লাশ নিয়ে যায়। গুলিতে জয়ন্তের বাবা মহাদেব কুমার সিংহ ও দরবার আলীও আহত হন। তারা দুজন বাংলাদেশ সীমান্তে চলে আসেন। পরে স্বজনেরা তাদের হাসপাতালে নিয়ে যান। সমর কুমার চট্টোপাধ্যায় আরও বলেন, সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে যাওয়ার সময় ভারতের অভ্যন্তরে ১৬ জন বাংলাদেশি বিএসএফ সদস্যের হাতে আটক হয়েছেন বলেও জানতে পেে ছেন তিনি।
সীমান্ত হত্যা নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব বিশিষ্ট আইনজীবী এডভোকেট গোবিন্দ চন্দ্র প্রমাণিক সীমান্তে সরাসরি গুলি করে মানুষ হত্যার নিন্দা জানিয়ে বলেন, এমন হত্যাকান্ড মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং এটা কোন সভ্যদেশ সমর্থন করে না। সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি প্রতিহত করতে আন্তর্জাতিক আইনের সহায়তা নেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন এডভোকেট গোবিন্দ চন্দ্র প্রমাণিক। গোবিন্দ চন্দ্র প্রমাণিক বলেন, ঠাকুরগাওয়ের সীমান্তে কিশোর হত্যা ছাড়াও মৌলভী বাজারে স্বর্ণা দাসকে গুলি করে হত্যা করেছে বিএসএফ। তিনি এর নিন্দা জানান।
বালিয়াডাঙ্গী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ কবীর সংবাদমাধ্যমকে জানান, বালিয়াডাঙ্গীর ধনতলা সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশের একদল লোক ভারতের ওপারে যাওয়ার সময় বিএসএফ সদস্যরা গুলি চালান। এতে এক কিশোর নিহত ও দুজন ব্যক্তি আহত হয়েছেন। এ বিষয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ঠাকুরগাঁও ৫০ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানজির আহমদ বলেন, সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে হতাহতের খবর শুনেছি। এটি যাচাই করতে আমাদের টিম কাজ করছে। এ রকম ঘটনা ঘটলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঠাকুরগাঁও ৫০ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. তানজির আহমদ বলেন, এমন একটি ঘটনা ঘটেছে শুনেছি। আমরা অনুসন্ধান চালাচ্ছি। এর আগে রোববার (১ সেপ্টেম্বর) রাতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী স্বর্ণা দাস (১৬) নিহত হয়। প্রায় ৪৫ ঘণ্টা পর মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) রাতে চাতলাপুর চেকপোস্ট দিয়ে তার মরদেহ হস্তান্তর করে বিএসএফ। নিহত স্বর্ণা মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের কালনীগড় গ্রামের পরেন্দ্র দাসের মেয়ে। পরেন্দ্র দাস জানান, ভারতের ত্রিপুরায় তার বড় ছেলে থাকেন। তাকে দেখার জন্য ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে স্থানীয় দুই দালাল ধরে স্বর্ণা ও তার মা রোববার রাতে লালারচক সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কাঁটাতারের বেড়ার কাছে পৌঁছালে বিএসএফ তাদের লক্ষ্য করে গুলি করে। এতে স্বর্ণা ঘটনাস্থলেই মারা যায়। স্বর্ণার মাসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। সোমবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত মরদেহ ঘটনাস্থলেই পড়ে ছিল। পরে রাতে বিজিবির একটি দল বাড়িতে এসে জানায় স্বর্ণার মরদেহ বিএসএফ নিয়ে গেছে। এছাড়া ১১ আগস্ট রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার ওয়াহেদপুর সীমান্তের ওপারে ভারতীয় অংশে বিএসএফের গুলিতে মো. আব্দুল্লাহ (৩৫) নামে এক বাংলাদেশি যুবক নিহত হন।
সীমান্ত অনুপ্রবেশ বর্তমানে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে একটা বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর কয়েক হাজার মানুষ নানা কারণে অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার হয়ে থাকে। চোরাচালানের ক্ষেত্রে ভারতের চোরাকারবারীদের শক্ত নেটওয়ার্ক রয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে আইন-শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে ক্রমশঃ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।