ঢাকা ০৭:০০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫

অশান্ত পাহাড় নেপথ্যে…

ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি
  • আপডেট সময় : ১২:৩৮:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২৫ ৮৭ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

*  কুকি চিনের চাঁদাবাজির পাশাপাশি রয়েছে অস্ত্র ব্যবসাও। সারা দেশের অনেক সশস্ত্র সংগঠন বা ব্যক্তি এই এলাকা থেকে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র কিনে থাকে। এরা অস্ত্র সংগ্রহ করে প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলোর কাছ থেকে

*  পার্বত্য শান্তিচুক্তির সঠিক বাস্তবায়ন না হলে পাহাড়ের এই সংকট সহজে কাটবে না। যদিও পার্বত্য অঞ্চলের একটি বাঙালি সংগঠন পাহাড় অশান্ত হওয়ার পেছনে অন্য রাজনৈতিক কারণ থাকতে পারে বলে দাবি করেছে। এ নিয়ে স্থানীয় আদিবাসীদের ভিন্নমতও রয়েছে

খুন অপহরণ, সহিংসতা, অগ্নিসংযোগের ঘটনা অশান্ত করে তোলে পাহাড়কে। কুকি চিনের চাঁদাবাজির পাশাপাশি রয়েছে অস্ত্র ব্যবসাও। সারা দেশের অনেক সশস্ত্র সংগঠন বা ব্যক্তি এই এলাকা থেকে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র কিনে থাকে। এরা অস্ত্র সংগ্রহ করে প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলোর কাছ থেকে। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা এবং আরাকান আর্মির কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহের কথা জানা যায়। এ ছাড়া নিজেদেরও আছে অস্ত্র তৈরির কারখানা।

কুকি-চিনের সন্ত্রাসী তৎপরতা প্রায়ই ভয়ানক হয়ে ওঠে। গত বছরের এপ্রিলে দুই দিনে বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলার কৃষি ও সোনালী ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা চালায় সশস্ত্র লোকজন। তারা টাকা লুট করে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মারধর করে, একজন ব্যাংক ব্যবস্থাপককে অপহরণ করে নিয়ে যায়। লুট করে বেশ কিছু অস্ত্র ও গুলি। ২ এপ্রিল সন্ধ্যায় রুমায় সোনালী ব্যাংকের অর্থ লুট করে ম্যানেজারকে অপহরণ করা হয়। ৩ এপ্রিল প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করতে করতে সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে ঢুকে লুটতরাজ চালায় তারা। ৪ এপ্রিল প্রায় শতাধিক কুকি-চিন সশস্ত্র সদস্য থানচি থানা দখলের চেষ্টা করে। তিন পার্বত্য জেলার প্রশাসন, একাধিক গোয়েন্দা সূত্র ও সেখানকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
একাধিক সূত্র জানায়, পার্বত্য এলাকায় বাধ্য হয়ে যারা চাঁদা দেয় তাদের বেশিরভাগই সীমিত আয়ের মানুষ। তাদের যৎসামান্য উপার্জনেই ভাগ বসায় দুর্বৃত্তরা। বিভিন্ন লেক এলাকার লঞ্চ ও বোট মালিক, নৌকার মাঝি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, মুদিসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকানদার, ব্যবসায়ী সমিতি, মাছ, গরু বা সবজি বিক্রেতা, হোটেল-রেস্টুরেন্টের মালিক, সাধারণ চাষি অথবা ফলবাগানের মালিক, চাঁদের গাড়ির মালিক এ-রকম নানা শ্রেণি-পেশার প্রায় সবাই নিয়মিত চাঁদাবাজির শিকার। এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যাদেরকে টিকে থাকার জন্য চাঁদা দিতে হয় না। বিভিন্ন পাড়ার পরিবারগুলোকেও সেখানে বসবাস করার জন্য এই দুর্বৃত্তদের মাসোহারা দিতে হয়। এসব নিয়ে সবার মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও প্রতিকারের উপায় খুঁজে পান না তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছরের জুনের মাঝামাঝি রুমায় বিশুদ্ধ পানি ও খাওয়ার স্যালাইন বিতরণ করতে গিয়ে কুকি-চিনের পুঁতে রাখা বোমা (আইইডি) বিস্ফোরণে নিহত হন সেনাবাহিনীর মোন্নাফ হোসেন নামে এক সদস্য। আহত হন রেজাউল নামে আরেক সৈনিক। এই ঘটনার আগে রুমার ছিলোপিপাড়া এলাকায় আরেক বিস্ফোরণে তুজাম নামে সেনাবাহিনীর আরেক সৈনিকের মৃত্যু হয়। গত বছর মার্চে বান্দরবানে আইইডি বিস্ফোরণ ও অতর্কিত গুলিতে সেনাবাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন নিহত হন। আহত হন আরও দুই সৈনিক। এরপর ১৬ মে রুমায় এই সন্ত্রাসীদের হামলায় সেনাবাহিনীর দুজন সৈনিক নিহত ও দুই অফিসার আহত হন। সব মিলিয়ে গত দুই বছরে অন্তত ৯টি বড় ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়েছে কেএনএফ। গত বছর তাদের চারটি হামলার ঘটনায় পাঁচ সেনা সদস্য নিহত হন। আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) সঙ্গে কেএনএফের সংঘর্ষে গত বছর রোয়াংছড়িতে আটজন এবং রুমায় একজন নিহত হন। গত বছরের ৮ মে রোয়াংছড়িতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাসহ বম জনগোষ্ঠীর তিনজন এবং ২২ মার্চ একই উপজেলার রামথারপাড়ায় থংচুল বম নামের এক কারবারিকে (পাড়াপ্রধান) গুলি করে হত্যা করে কুকি-চিন। ২০২২ সালের ২১ জুন রাঙামাটির বিলাইছড়িতে তিন ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে এই সংগঠনের সন্ত্রাসীরা।

স্থানীয় প্রশাসন বলেছে,তিন পার্বত্য এলাকার শীর্ষস্থানীয় পেশাদার চাঁদাবাজদের মধ্যে স্থানীয় প্রশাসনের তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তারা হলেনÑ নাথান বম, ফ্লেমিং, চেওসিম বম ও রোয়ান লিন বম, বিপ্লব চাকমা ও গরান্টু চাকমা, সমাজ প্রিয় চাকমা বা প্রসিত চাকমা, গমেজ চাকমা, ইথু চাকমা, রবি চাকমা, সমির চাকমা বা তরেন চাকমা, অগ্রসর চাকমা, চোসেন্দ্র বা রিমিত চাকমা, গোয়েন্তা চাকমা, শ্রাবণ চাকমা, তারুম বা বিলাম চাকমা, সমন ত্রিপুরা, এগন্তন চাকমা, জলাইয়া, উজ্জ্বল, বিজয়, আদিরঞ্জন। এদের মধ্যে কে কার বা কোন গোষ্ঠীর লোক তা বোঝা মুশকিল। এ ছাড়া তারা খুব ঘন ঘন এলাকা ও নিজেদের নাম পরিবর্তন করে থাকেন।
সূত্র মতে, পার্বত্য শান্তিচুক্তির সঠিক বাস্তবায়ন না হলে পাহাড়ের এই সংকট সহজে কাটবে না। যদিও পার্বত্য অঞ্চলের একটি বাঙালি সংগঠন পাহাড় অশান্ত হওয়ার পেছনে অন্য রাজনৈতিক কারণ থাকতে পারে বলে দাবি করেছে। এ নিয়ে স্থানীয় আদিবাসীদের ভিন্নমতও রয়েছে। মূলত আদর্শগত কোনো লড়াই নয়, নিজেদের অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজি, মুক্তিপণ আদায় নিয়ে আধিপত্যের জেরেই এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে নানান সহিংস কর্মকা- ঘটে। এলাকা এক, গোষ্ঠী ছয়টি। সব সূত্র থেকে সবাই চাঁদা আদায় করতে চায়Ñ এমন অবস্থায় বিরোধ তো অনিবার্য হয়েই ওঠে।

পাহাড়ি সংগঠনগুলোর মধ্যে দৃশ্যমান ঐক্য দেখতে চায় না বিশেষ একটি মহল। তারাই ছোটখাটো ইস্যু নিয়ে অস্থিতিশীলতা ঘটায়। পাহাড়িরা ঐক্যবদ্ধ থাকুক এটা তারা চায় না। তাদের মধ্যে যাতে বিভেদ জিইয়ে রাখা যায়, সেই চেষ্টা সব সময় অব্যাহত থাকে। অনেকে আবার মনে করেন, পাহাড়কে অশান্ত করে তোলার পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রও কাজ করে থাকতে পারে। ইউপিডিএফের সেকেন্ড ইন কমান্ড মাইকেল চাকমা বলেন, তিনি টানা ৫ বছর আয়নাঘরে বন্দি ছিলেন। র‌্যাবও তাকে অস্ত্র উদ্ধারের নাটক সাজিয়ে গ্রেপ্তার করেছিল। তাদের সংগঠন কোনো ধরনের চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। তারা নিজেরাই নানান ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। অনেকে চাকরি করেন। দলের স্বার্থে নিজেদের আয়ের অর্থ দিয়েই সংগঠন পরিচালনা করেন।
মাইকেল চাকমা আরও বলেন, ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তিতে ভূমি ব্যবস্থাপনার রূপরেখা দেওয়া ছিল। তবে এখনও তা বাস্তবায়ন হয়নি। তাই নতুন শান্তিচুক্তি করা জরুরি। স্বায়ত্তশাসন বিষয়টা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত নেই। নতুন চুক্তির মাধ্যমে সেখানে আলাদা শাসনব্যবস্থা সংবিধানে স্বীকৃত হতে হবে। সেটলার সমস্যা মানে ভূমি সমস্যা, ভূমি সমস্যা মানে সেটলার সমস্যা। সেটলার বাঙালিদের সঙ্গে আমাদের কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না, এখনও নেই।
কুকি-চিনের বান্দরবানের আঞ্চলিক নেতা মিতিল বম বলেন, দল টিকিয়ে রাখার জন্য যেটুকু র্কর্মকা- চালানো দরকার, তারা সেটাই করছেন। গত ৫ বছরে তাদের অর্ধশতাধিক সদস্য মারা গেছেন। নিহতদের পরিবারগুলোকে তাদের চালাতে হচ্ছে। তাদের সশস্ত্র উইংয়ে তিন হাজারের বেশি সদস্য রয়েছেন।

পার্বত্য তিন জেলাতেই তাদের কমবেশি কর্মী আছে। তবে বেশি আছে বান্দরবানে। রুমার কেওক্রাডং পর্বতের কাছাকাছি তাদের গোপন আস্তানা রয়েছে। নিজেদের তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দা মনে করেন। একই সঙ্গে তারা চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীকে বার্মিজ ও ভারতীয় জাতিভুক্ত এবং বহিরাগত মনে করেন। আর এ কারণেই জেএসএস ও ইউপিডিএফের প্রতি তাদের বৈরী মনোভাব রয়েছে। এসব বিষয় নিয়েই তাদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। তারা কোনো প্রকার চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন বলেও জোর দিয়ে দাবি করেন মিতিল বম। পাহাড়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ স্বীকার করে অন্তবর্তী সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বলেন, পাহাড়ে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং চাঁদাবাজি বন্ধ হওয়া দরকার। আমরা চেষ্টা করছি, চলমান সমস্যাগুলো নিরসন করে মানুষের জীবনে সুখ-শান্তি ফিরিয়ে আনতে। পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় পাহাড়ের ছেলেমেয়েরা সমতলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। এই অঞ্চলের মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নও জরুরি। একটা ভালো ও সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ পুনর্গঠন করা হবে বলে তিনি জানান।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

অশান্ত পাহাড় নেপথ্যে…

আপডেট সময় : ১২:৩৮:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২৫

*  কুকি চিনের চাঁদাবাজির পাশাপাশি রয়েছে অস্ত্র ব্যবসাও। সারা দেশের অনেক সশস্ত্র সংগঠন বা ব্যক্তি এই এলাকা থেকে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র কিনে থাকে। এরা অস্ত্র সংগ্রহ করে প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলোর কাছ থেকে

*  পার্বত্য শান্তিচুক্তির সঠিক বাস্তবায়ন না হলে পাহাড়ের এই সংকট সহজে কাটবে না। যদিও পার্বত্য অঞ্চলের একটি বাঙালি সংগঠন পাহাড় অশান্ত হওয়ার পেছনে অন্য রাজনৈতিক কারণ থাকতে পারে বলে দাবি করেছে। এ নিয়ে স্থানীয় আদিবাসীদের ভিন্নমতও রয়েছে

খুন অপহরণ, সহিংসতা, অগ্নিসংযোগের ঘটনা অশান্ত করে তোলে পাহাড়কে। কুকি চিনের চাঁদাবাজির পাশাপাশি রয়েছে অস্ত্র ব্যবসাও। সারা দেশের অনেক সশস্ত্র সংগঠন বা ব্যক্তি এই এলাকা থেকে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র কিনে থাকে। এরা অস্ত্র সংগ্রহ করে প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলোর কাছ থেকে। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা এবং আরাকান আর্মির কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহের কথা জানা যায়। এ ছাড়া নিজেদেরও আছে অস্ত্র তৈরির কারখানা।

কুকি-চিনের সন্ত্রাসী তৎপরতা প্রায়ই ভয়ানক হয়ে ওঠে। গত বছরের এপ্রিলে দুই দিনে বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলার কৃষি ও সোনালী ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা চালায় সশস্ত্র লোকজন। তারা টাকা লুট করে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মারধর করে, একজন ব্যাংক ব্যবস্থাপককে অপহরণ করে নিয়ে যায়। লুট করে বেশ কিছু অস্ত্র ও গুলি। ২ এপ্রিল সন্ধ্যায় রুমায় সোনালী ব্যাংকের অর্থ লুট করে ম্যানেজারকে অপহরণ করা হয়। ৩ এপ্রিল প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করতে করতে সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে ঢুকে লুটতরাজ চালায় তারা। ৪ এপ্রিল প্রায় শতাধিক কুকি-চিন সশস্ত্র সদস্য থানচি থানা দখলের চেষ্টা করে। তিন পার্বত্য জেলার প্রশাসন, একাধিক গোয়েন্দা সূত্র ও সেখানকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
একাধিক সূত্র জানায়, পার্বত্য এলাকায় বাধ্য হয়ে যারা চাঁদা দেয় তাদের বেশিরভাগই সীমিত আয়ের মানুষ। তাদের যৎসামান্য উপার্জনেই ভাগ বসায় দুর্বৃত্তরা। বিভিন্ন লেক এলাকার লঞ্চ ও বোট মালিক, নৌকার মাঝি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, মুদিসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকানদার, ব্যবসায়ী সমিতি, মাছ, গরু বা সবজি বিক্রেতা, হোটেল-রেস্টুরেন্টের মালিক, সাধারণ চাষি অথবা ফলবাগানের মালিক, চাঁদের গাড়ির মালিক এ-রকম নানা শ্রেণি-পেশার প্রায় সবাই নিয়মিত চাঁদাবাজির শিকার। এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যাদেরকে টিকে থাকার জন্য চাঁদা দিতে হয় না। বিভিন্ন পাড়ার পরিবারগুলোকেও সেখানে বসবাস করার জন্য এই দুর্বৃত্তদের মাসোহারা দিতে হয়। এসব নিয়ে সবার মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও প্রতিকারের উপায় খুঁজে পান না তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছরের জুনের মাঝামাঝি রুমায় বিশুদ্ধ পানি ও খাওয়ার স্যালাইন বিতরণ করতে গিয়ে কুকি-চিনের পুঁতে রাখা বোমা (আইইডি) বিস্ফোরণে নিহত হন সেনাবাহিনীর মোন্নাফ হোসেন নামে এক সদস্য। আহত হন রেজাউল নামে আরেক সৈনিক। এই ঘটনার আগে রুমার ছিলোপিপাড়া এলাকায় আরেক বিস্ফোরণে তুজাম নামে সেনাবাহিনীর আরেক সৈনিকের মৃত্যু হয়। গত বছর মার্চে বান্দরবানে আইইডি বিস্ফোরণ ও অতর্কিত গুলিতে সেনাবাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন নিহত হন। আহত হন আরও দুই সৈনিক। এরপর ১৬ মে রুমায় এই সন্ত্রাসীদের হামলায় সেনাবাহিনীর দুজন সৈনিক নিহত ও দুই অফিসার আহত হন। সব মিলিয়ে গত দুই বছরে অন্তত ৯টি বড় ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়েছে কেএনএফ। গত বছর তাদের চারটি হামলার ঘটনায় পাঁচ সেনা সদস্য নিহত হন। আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) সঙ্গে কেএনএফের সংঘর্ষে গত বছর রোয়াংছড়িতে আটজন এবং রুমায় একজন নিহত হন। গত বছরের ৮ মে রোয়াংছড়িতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাসহ বম জনগোষ্ঠীর তিনজন এবং ২২ মার্চ একই উপজেলার রামথারপাড়ায় থংচুল বম নামের এক কারবারিকে (পাড়াপ্রধান) গুলি করে হত্যা করে কুকি-চিন। ২০২২ সালের ২১ জুন রাঙামাটির বিলাইছড়িতে তিন ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে এই সংগঠনের সন্ত্রাসীরা।

স্থানীয় প্রশাসন বলেছে,তিন পার্বত্য এলাকার শীর্ষস্থানীয় পেশাদার চাঁদাবাজদের মধ্যে স্থানীয় প্রশাসনের তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তারা হলেনÑ নাথান বম, ফ্লেমিং, চেওসিম বম ও রোয়ান লিন বম, বিপ্লব চাকমা ও গরান্টু চাকমা, সমাজ প্রিয় চাকমা বা প্রসিত চাকমা, গমেজ চাকমা, ইথু চাকমা, রবি চাকমা, সমির চাকমা বা তরেন চাকমা, অগ্রসর চাকমা, চোসেন্দ্র বা রিমিত চাকমা, গোয়েন্তা চাকমা, শ্রাবণ চাকমা, তারুম বা বিলাম চাকমা, সমন ত্রিপুরা, এগন্তন চাকমা, জলাইয়া, উজ্জ্বল, বিজয়, আদিরঞ্জন। এদের মধ্যে কে কার বা কোন গোষ্ঠীর লোক তা বোঝা মুশকিল। এ ছাড়া তারা খুব ঘন ঘন এলাকা ও নিজেদের নাম পরিবর্তন করে থাকেন।
সূত্র মতে, পার্বত্য শান্তিচুক্তির সঠিক বাস্তবায়ন না হলে পাহাড়ের এই সংকট সহজে কাটবে না। যদিও পার্বত্য অঞ্চলের একটি বাঙালি সংগঠন পাহাড় অশান্ত হওয়ার পেছনে অন্য রাজনৈতিক কারণ থাকতে পারে বলে দাবি করেছে। এ নিয়ে স্থানীয় আদিবাসীদের ভিন্নমতও রয়েছে। মূলত আদর্শগত কোনো লড়াই নয়, নিজেদের অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজি, মুক্তিপণ আদায় নিয়ে আধিপত্যের জেরেই এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে নানান সহিংস কর্মকা- ঘটে। এলাকা এক, গোষ্ঠী ছয়টি। সব সূত্র থেকে সবাই চাঁদা আদায় করতে চায়Ñ এমন অবস্থায় বিরোধ তো অনিবার্য হয়েই ওঠে।

পাহাড়ি সংগঠনগুলোর মধ্যে দৃশ্যমান ঐক্য দেখতে চায় না বিশেষ একটি মহল। তারাই ছোটখাটো ইস্যু নিয়ে অস্থিতিশীলতা ঘটায়। পাহাড়িরা ঐক্যবদ্ধ থাকুক এটা তারা চায় না। তাদের মধ্যে যাতে বিভেদ জিইয়ে রাখা যায়, সেই চেষ্টা সব সময় অব্যাহত থাকে। অনেকে আবার মনে করেন, পাহাড়কে অশান্ত করে তোলার পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রও কাজ করে থাকতে পারে। ইউপিডিএফের সেকেন্ড ইন কমান্ড মাইকেল চাকমা বলেন, তিনি টানা ৫ বছর আয়নাঘরে বন্দি ছিলেন। র‌্যাবও তাকে অস্ত্র উদ্ধারের নাটক সাজিয়ে গ্রেপ্তার করেছিল। তাদের সংগঠন কোনো ধরনের চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। তারা নিজেরাই নানান ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। অনেকে চাকরি করেন। দলের স্বার্থে নিজেদের আয়ের অর্থ দিয়েই সংগঠন পরিচালনা করেন।
মাইকেল চাকমা আরও বলেন, ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তিতে ভূমি ব্যবস্থাপনার রূপরেখা দেওয়া ছিল। তবে এখনও তা বাস্তবায়ন হয়নি। তাই নতুন শান্তিচুক্তি করা জরুরি। স্বায়ত্তশাসন বিষয়টা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত নেই। নতুন চুক্তির মাধ্যমে সেখানে আলাদা শাসনব্যবস্থা সংবিধানে স্বীকৃত হতে হবে। সেটলার সমস্যা মানে ভূমি সমস্যা, ভূমি সমস্যা মানে সেটলার সমস্যা। সেটলার বাঙালিদের সঙ্গে আমাদের কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না, এখনও নেই।
কুকি-চিনের বান্দরবানের আঞ্চলিক নেতা মিতিল বম বলেন, দল টিকিয়ে রাখার জন্য যেটুকু র্কর্মকা- চালানো দরকার, তারা সেটাই করছেন। গত ৫ বছরে তাদের অর্ধশতাধিক সদস্য মারা গেছেন। নিহতদের পরিবারগুলোকে তাদের চালাতে হচ্ছে। তাদের সশস্ত্র উইংয়ে তিন হাজারের বেশি সদস্য রয়েছেন।

পার্বত্য তিন জেলাতেই তাদের কমবেশি কর্মী আছে। তবে বেশি আছে বান্দরবানে। রুমার কেওক্রাডং পর্বতের কাছাকাছি তাদের গোপন আস্তানা রয়েছে। নিজেদের তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দা মনে করেন। একই সঙ্গে তারা চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীকে বার্মিজ ও ভারতীয় জাতিভুক্ত এবং বহিরাগত মনে করেন। আর এ কারণেই জেএসএস ও ইউপিডিএফের প্রতি তাদের বৈরী মনোভাব রয়েছে। এসব বিষয় নিয়েই তাদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। তারা কোনো প্রকার চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন বলেও জোর দিয়ে দাবি করেন মিতিল বম। পাহাড়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ স্বীকার করে অন্তবর্তী সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বলেন, পাহাড়ে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং চাঁদাবাজি বন্ধ হওয়া দরকার। আমরা চেষ্টা করছি, চলমান সমস্যাগুলো নিরসন করে মানুষের জীবনে সুখ-শান্তি ফিরিয়ে আনতে। পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় পাহাড়ের ছেলেমেয়েরা সমতলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। এই অঞ্চলের মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নও জরুরি। একটা ভালো ও সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ পুনর্গঠন করা হবে বলে তিনি জানান।