ঢাকা ০৬:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০১ এপ্রিল ২০২৫

ঈদ আনন্দ নেই জুলাই শহীদ পরিবারে

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৫:১৫:৫০ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩০ মার্চ ২০২৫ ৪০ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

শোক কাটিয়ে উঠার চেষ্টায় স্বজনরা
আনন্দের পরিবর্তে স্বজনহারা শূন্যতা

জুলাই আন্দোলনে শহীদদের পরিবারে এখনো শোকের ছায়া। নেই ঈদের অনন্দ। কেউ হারিয়েছেন বাবা, কেউবা সন্তান। পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশাহারা অবস্থায় অনেক পরিবার। তাদের এ শোক কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। সরকার পর্যাপ্ত সহায়তা দিলেও স্বজনহারা কষ্ট মন থেকে যাবে না কথনও। জুলাইয়ে শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে তাদের শূন্যতার চিত্র তুলে ধরা হলো।
একদিন পরই ঈদ। দরজায় কড়া নাড়ছে ঈদুল ফিতর। তবে সেই আনন্দের লেশমাত্র নেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানে স্বজন হারানো পরিবারগুলোর মাঝে। আট মাস পেরিয়ে গেলেও শোক কাটিয়ে উঠতে পারছেন না তারা। তাদের পরিবাওে নেই ঈদ আনন্দ। কেউ সামর্থ্য থাকলেও কিনছেন না নতুন জামা, খাচ্ছেন না ভালো খাবার। আর কেউ বা একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দুচোখে অন্ধকার দেখছেন। সব মিলিয়ে ঈদের আনন্দের পরিবর্তে শহীদ পরিবারে ভর করছে দুঃখ ও বেদনা।
উত্তরার জামিয়া রওজাতুল উলুম মাদ্রাসার ইবতেদায়ি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আরাফাত হুসাইন। শহীদুল ইসলাম ও সালেহা আক্তার দম্পতির তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে সে দ্বিতীয়। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের খবরে রাজধানীজুড়ে বিজয় মিছিল বের হয়। এই মিছিলে অংশ নেওয়ার আনন্দ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে চায়নি আরাফাত (১২)। তাই সেদিন বিকেলে সে অন্য সহপাঠীর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে। তবে মিছিলটি উত্তরার আজমপুর পূর্ব থানার সামনে যেতেই গুলি ছুড়তে থাকে পুলিশ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটি গুলি আরাফাতের পেটের বাঁ পাশ দিয়ে ঢুকে ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে নেওয়া হয় হাসপাতালে। এর পর থেকে আরাফাতকে নিয়ে শুরু হয় দরিদ্র মা-বাবার যুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানো যায়নি। সাড়ে চার মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ডিসেম্বরে সে মারা যায়।
আরাফাতকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ গোটা পরিবার। আরাফাত যে ছিল তাদের ভালোবাসার মধ্যমণি! আরাফাতের কথা বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তার বড় ভাই হাসান আলী। তিনি বলেন, ‘ঈদ আসার কয়েকদিন আগে থেকেই নতুন জামার বাহানা ধরত সে। কখন মার্কেটে নিয়ে যাব, কিনে দেব। আমরা পারিবারিক সচ্ছল ছিলাম না। আমার বাবা রিকশা চালাত। ওর যে চাহিদা ছিল তা আমরা পরিপূর্ণভাবে দিতে পারতাম না। চাহিদা অনুযায়ী ঈদের কেনাকাটা করে দিতে পারি নাই। তার প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমাদের কাঁদাচ্ছে।
আনন্দ মূছে গেছে শহীদ মেহেরুনের পরিবারে। মেহেরুন নেছা তানহার বয়স ছিল ২২ বছর। পড়াশোনা করছিলেন মিরপুরের হযরত শাহ আলী মহিলা কলেজে, অনার্স তৃতীয় বর্ষে। বাবা মোশাররফ হোসেন গাড়িচালক, মা আছমা আক্তার গৃহিণী। পড়ালেখার পাশাপাশি পার্টটাইম কাজ করতেন মেহেরুন নেছা। নিজের খরচ নিজেই বহন করতেন। পরিবারকেও করতে সহযোগিতা করতেন। ৫ আগস্ট নিভে গেছে এই প্রদীপ। সেদিন গণভবন ও সংসদ ভবন এলাকায় আনন্দ উদযাপন শেষে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় মেহেরুন বাসায় ফেরেন। তখনো সেখানে চলছিল সংঘর্ষ। ভাইয়ের প্রতীক্ষায় জানালার সামনে দাঁড়াতেই একটা গুলি এসে লাগে তার শরীরে। মুহূর্তে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন মেহেরুন। তাড়াতাড়ি নিকটস্থ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মোশাররফ হোসেন বলেন, মেহেরুন নেছা ছিল আমার বড় সন্তান। পৃথিবী একদিকে, আমার মেয়ে একদিকে—এত ভালোবাসতাম আমি তাকে। ঘরটা যেন মৃত বাড়ি হয়েছে। কেউ হাসিখুশি নেই, কেউ ভালো খাবার খায় না। কারণ আমার মেয়েটাই ঘরের মধ্যে উজ্জ্বল আলোর মতো ছিল। ঈদ, রমজান কোনো কিছুর আমেজ মোটেও নাই। ঈদের জন্য আমি দুই কেজি গরুর মাংস কিনে রাখছি কিন্তু মেয়ের শোকে আমার স্ত্রী বলছে, এই মাংস খাবে না। নিজের জন্য আমরা কিছুই কিনি নাই, কিনবও না। আমার মেয়ে যেহেতু নাই। আমাদের কিছুই দরকার নাই। কারণ আমাদের ঈদ আগেই শেষ হয়ে গেছে।
একই ভাবে ছেলের শুন্যতার শোক কেটে উঠতে পারেনি রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের পরিবার। তাদের পরিবারে ঈদ আনন্দের পরিবর্তে চলছে শোক। ছেলে হারা শোক কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছেন। সরকার যতই সহায়তা করুক না কেন, আমার কীর্তিমান একমাত্র রোজগারের কান্ডারী সাঈদের শুন্যতা কেউ পুরন করতে পারবে না। তিনি বলেন, আমার পরিবারে ঈদ নেই। আপনারা আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন।
একই ভাবে মানবেতর জীবন কাটছে শহীদ মঞ্জুর পরিবার। গাজীপুরে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন রংপুরের পীরগাছার মঞ্জু মিয়া (৪০)। ২০ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি।
স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে গাজীপুরের বড়বাড়ি জয়বাংলা রোডে ভাড়া বাসায় থাকতেন মঞ্জু মিয়া। পীরগাছার গ্রামে থাকেন তার বৃদ্ধ মা-বাবা। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি। ছেলের মৃত্যুর পর মানবেতর জীবন-যাপন করছেন তার বৃদ্ধ মা-বাবাসহ গোটা পরিবার।
শহীদ মঞ্জুর বাবা এনছার আলী বলেন, ‘আমার ছেলে না থাকায় শুধু শূন্যতা। আমি ছেলে হারালাম, তার ছেলেমেয়েরা হারিয়েছে বাবা। পুরো পরিবারটা নিঃস্ব হয়ে গেছে। তার ছেলেমেয়েরা আর হাসে না। নতুন জামাও তেমন কিনে নাই। আমাদের জন্য এবার আর ঈদ নাই। তার ছোট বাচ্চা আছে দুজন। তারা শুধু বাবা বলে কান্না করে।
শহীদ মিরাজ হোসেনের বাসা রাজধানীর ডেমরা থানার পারডগাইরের মধুবাগে। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার তিতাস থানার সরস্বতীচর গ্রামে। বিবিএ পাস মিরাজ ছিলেন দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে মেজো। ৫ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে নাশতা খেয়ে কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে যান তিনি। যোগ দেন যাত্রাবাড়ীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে। দুপুর ২টার পরপর যাত্রাবাড়ী থানার সামনে হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে পুলিশের ছোড়া গুলি লাগে তার বুকের বাঁ পাশে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। কয়েকজন তাকে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করা হয়। মিরাজ ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। তার মৃত্যুতে শোকাচ্ছন্ন পরিবার এখন দিশেহারাও।
স্বজনরা বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বেশিরভাগ শহিদ পরিবারের খোঁজ নেননি অন্তর্বর্তী সরকার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টি, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। যা নিয়ে ক্ষুব্ধ শহিদ পরিবারের সদস্যরা। তারা বলছেন, যাদের জন্য নতুন দেশ তাদের অন্তত স্মরণ রাখা উচিত।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে যাত্রাবাড়ী এলাকায় শহিদ হন জসিম উদ্দিন। তার স্ত্রী সুলতানা রাজিয়া বলেন, গত বছর স্বামীর সঙ্গে একসঙ্গে ঈদ করেছি। ঈদে যা কিছু দরকার হতো সবকিছুই তিনিই ব্যবস্থা করতেন। এবার স্বামী নেই। ঈদে কী করব বুঝতে পারছি না। সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের খোঁজ নেওয়া হয়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জয়পুরহাটে প্রথম শহীদ হওয়া পাঁচবিবি উপজেলার রতনপুর গ্রামের কলেজছাত্র নজিবুল সরকার বিশালের পরিবারে নেই ঈদের আনন্দ। অশ্রু সিক্ত মায়ের চোখ।
ঈদের আনন্দ যেন হারিয়ে গেছে বিশালের মা-বাবার কাছ থেকে। নাজিবুল সরকার বিশালের মা বলেন, গত রমজান মাসে আমাদের পরিবারে চার সদস্য ছিল। কত আনন্দের সঙ্গে কাটছিল দিনগুলো। ঈদের খবর জানতে চাইলে ডুকরে কেঁদে ওঠে অশ্রুভেজা চোখে বলতে থাকেন—বিগত ঈদেও ছিল পরিপূর্ণ আনন্দ। কিন্তু এ বছর বড় ছেলে নাজিবুল সরকার বিশাল আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে গেছে। সেইসঙ্গে আমাদের ঈদের আনন্দও হারিয়ে গেছে।
এবিষয়ে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ৭৪৫ জনের পরিবার ও ৫ হাজার ৫৯৬ জন আহতকে মোট ৯৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা দিয়েছে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন। এর মধ্যে ৩৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা শহীদ পরিবারের মাঝে এবং ৫৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা টাকা আহত ব্যক্তিদের মাঝে দেওয়া হয়েছে। গত শুক্রবার সকালে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ঈদ আনন্দ নেই জুলাই শহীদ পরিবারে

আপডেট সময় : ০৫:১৫:৫০ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩০ মার্চ ২০২৫

শোক কাটিয়ে উঠার চেষ্টায় স্বজনরা
আনন্দের পরিবর্তে স্বজনহারা শূন্যতা

জুলাই আন্দোলনে শহীদদের পরিবারে এখনো শোকের ছায়া। নেই ঈদের অনন্দ। কেউ হারিয়েছেন বাবা, কেউবা সন্তান। পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশাহারা অবস্থায় অনেক পরিবার। তাদের এ শোক কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। সরকার পর্যাপ্ত সহায়তা দিলেও স্বজনহারা কষ্ট মন থেকে যাবে না কথনও। জুলাইয়ে শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে তাদের শূন্যতার চিত্র তুলে ধরা হলো।
একদিন পরই ঈদ। দরজায় কড়া নাড়ছে ঈদুল ফিতর। তবে সেই আনন্দের লেশমাত্র নেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানে স্বজন হারানো পরিবারগুলোর মাঝে। আট মাস পেরিয়ে গেলেও শোক কাটিয়ে উঠতে পারছেন না তারা। তাদের পরিবাওে নেই ঈদ আনন্দ। কেউ সামর্থ্য থাকলেও কিনছেন না নতুন জামা, খাচ্ছেন না ভালো খাবার। আর কেউ বা একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দুচোখে অন্ধকার দেখছেন। সব মিলিয়ে ঈদের আনন্দের পরিবর্তে শহীদ পরিবারে ভর করছে দুঃখ ও বেদনা।
উত্তরার জামিয়া রওজাতুল উলুম মাদ্রাসার ইবতেদায়ি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আরাফাত হুসাইন। শহীদুল ইসলাম ও সালেহা আক্তার দম্পতির তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে সে দ্বিতীয়। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের খবরে রাজধানীজুড়ে বিজয় মিছিল বের হয়। এই মিছিলে অংশ নেওয়ার আনন্দ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে চায়নি আরাফাত (১২)। তাই সেদিন বিকেলে সে অন্য সহপাঠীর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে। তবে মিছিলটি উত্তরার আজমপুর পূর্ব থানার সামনে যেতেই গুলি ছুড়তে থাকে পুলিশ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটি গুলি আরাফাতের পেটের বাঁ পাশ দিয়ে ঢুকে ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে নেওয়া হয় হাসপাতালে। এর পর থেকে আরাফাতকে নিয়ে শুরু হয় দরিদ্র মা-বাবার যুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানো যায়নি। সাড়ে চার মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ডিসেম্বরে সে মারা যায়।
আরাফাতকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ গোটা পরিবার। আরাফাত যে ছিল তাদের ভালোবাসার মধ্যমণি! আরাফাতের কথা বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তার বড় ভাই হাসান আলী। তিনি বলেন, ‘ঈদ আসার কয়েকদিন আগে থেকেই নতুন জামার বাহানা ধরত সে। কখন মার্কেটে নিয়ে যাব, কিনে দেব। আমরা পারিবারিক সচ্ছল ছিলাম না। আমার বাবা রিকশা চালাত। ওর যে চাহিদা ছিল তা আমরা পরিপূর্ণভাবে দিতে পারতাম না। চাহিদা অনুযায়ী ঈদের কেনাকাটা করে দিতে পারি নাই। তার প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমাদের কাঁদাচ্ছে।
আনন্দ মূছে গেছে শহীদ মেহেরুনের পরিবারে। মেহেরুন নেছা তানহার বয়স ছিল ২২ বছর। পড়াশোনা করছিলেন মিরপুরের হযরত শাহ আলী মহিলা কলেজে, অনার্স তৃতীয় বর্ষে। বাবা মোশাররফ হোসেন গাড়িচালক, মা আছমা আক্তার গৃহিণী। পড়ালেখার পাশাপাশি পার্টটাইম কাজ করতেন মেহেরুন নেছা। নিজের খরচ নিজেই বহন করতেন। পরিবারকেও করতে সহযোগিতা করতেন। ৫ আগস্ট নিভে গেছে এই প্রদীপ। সেদিন গণভবন ও সংসদ ভবন এলাকায় আনন্দ উদযাপন শেষে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় মেহেরুন বাসায় ফেরেন। তখনো সেখানে চলছিল সংঘর্ষ। ভাইয়ের প্রতীক্ষায় জানালার সামনে দাঁড়াতেই একটা গুলি এসে লাগে তার শরীরে। মুহূর্তে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন মেহেরুন। তাড়াতাড়ি নিকটস্থ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মোশাররফ হোসেন বলেন, মেহেরুন নেছা ছিল আমার বড় সন্তান। পৃথিবী একদিকে, আমার মেয়ে একদিকে—এত ভালোবাসতাম আমি তাকে। ঘরটা যেন মৃত বাড়ি হয়েছে। কেউ হাসিখুশি নেই, কেউ ভালো খাবার খায় না। কারণ আমার মেয়েটাই ঘরের মধ্যে উজ্জ্বল আলোর মতো ছিল। ঈদ, রমজান কোনো কিছুর আমেজ মোটেও নাই। ঈদের জন্য আমি দুই কেজি গরুর মাংস কিনে রাখছি কিন্তু মেয়ের শোকে আমার স্ত্রী বলছে, এই মাংস খাবে না। নিজের জন্য আমরা কিছুই কিনি নাই, কিনবও না। আমার মেয়ে যেহেতু নাই। আমাদের কিছুই দরকার নাই। কারণ আমাদের ঈদ আগেই শেষ হয়ে গেছে।
একই ভাবে ছেলের শুন্যতার শোক কেটে উঠতে পারেনি রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের পরিবার। তাদের পরিবারে ঈদ আনন্দের পরিবর্তে চলছে শোক। ছেলে হারা শোক কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছেন। সরকার যতই সহায়তা করুক না কেন, আমার কীর্তিমান একমাত্র রোজগারের কান্ডারী সাঈদের শুন্যতা কেউ পুরন করতে পারবে না। তিনি বলেন, আমার পরিবারে ঈদ নেই। আপনারা আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন।
একই ভাবে মানবেতর জীবন কাটছে শহীদ মঞ্জুর পরিবার। গাজীপুরে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন রংপুরের পীরগাছার মঞ্জু মিয়া (৪০)। ২০ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি।
স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে গাজীপুরের বড়বাড়ি জয়বাংলা রোডে ভাড়া বাসায় থাকতেন মঞ্জু মিয়া। পীরগাছার গ্রামে থাকেন তার বৃদ্ধ মা-বাবা। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি। ছেলের মৃত্যুর পর মানবেতর জীবন-যাপন করছেন তার বৃদ্ধ মা-বাবাসহ গোটা পরিবার।
শহীদ মঞ্জুর বাবা এনছার আলী বলেন, ‘আমার ছেলে না থাকায় শুধু শূন্যতা। আমি ছেলে হারালাম, তার ছেলেমেয়েরা হারিয়েছে বাবা। পুরো পরিবারটা নিঃস্ব হয়ে গেছে। তার ছেলেমেয়েরা আর হাসে না। নতুন জামাও তেমন কিনে নাই। আমাদের জন্য এবার আর ঈদ নাই। তার ছোট বাচ্চা আছে দুজন। তারা শুধু বাবা বলে কান্না করে।
শহীদ মিরাজ হোসেনের বাসা রাজধানীর ডেমরা থানার পারডগাইরের মধুবাগে। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার তিতাস থানার সরস্বতীচর গ্রামে। বিবিএ পাস মিরাজ ছিলেন দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে মেজো। ৫ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে নাশতা খেয়ে কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে যান তিনি। যোগ দেন যাত্রাবাড়ীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে। দুপুর ২টার পরপর যাত্রাবাড়ী থানার সামনে হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে পুলিশের ছোড়া গুলি লাগে তার বুকের বাঁ পাশে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। কয়েকজন তাকে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করা হয়। মিরাজ ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। তার মৃত্যুতে শোকাচ্ছন্ন পরিবার এখন দিশেহারাও।
স্বজনরা বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বেশিরভাগ শহিদ পরিবারের খোঁজ নেননি অন্তর্বর্তী সরকার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টি, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। যা নিয়ে ক্ষুব্ধ শহিদ পরিবারের সদস্যরা। তারা বলছেন, যাদের জন্য নতুন দেশ তাদের অন্তত স্মরণ রাখা উচিত।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে যাত্রাবাড়ী এলাকায় শহিদ হন জসিম উদ্দিন। তার স্ত্রী সুলতানা রাজিয়া বলেন, গত বছর স্বামীর সঙ্গে একসঙ্গে ঈদ করেছি। ঈদে যা কিছু দরকার হতো সবকিছুই তিনিই ব্যবস্থা করতেন। এবার স্বামী নেই। ঈদে কী করব বুঝতে পারছি না। সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের খোঁজ নেওয়া হয়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জয়পুরহাটে প্রথম শহীদ হওয়া পাঁচবিবি উপজেলার রতনপুর গ্রামের কলেজছাত্র নজিবুল সরকার বিশালের পরিবারে নেই ঈদের আনন্দ। অশ্রু সিক্ত মায়ের চোখ।
ঈদের আনন্দ যেন হারিয়ে গেছে বিশালের মা-বাবার কাছ থেকে। নাজিবুল সরকার বিশালের মা বলেন, গত রমজান মাসে আমাদের পরিবারে চার সদস্য ছিল। কত আনন্দের সঙ্গে কাটছিল দিনগুলো। ঈদের খবর জানতে চাইলে ডুকরে কেঁদে ওঠে অশ্রুভেজা চোখে বলতে থাকেন—বিগত ঈদেও ছিল পরিপূর্ণ আনন্দ। কিন্তু এ বছর বড় ছেলে নাজিবুল সরকার বিশাল আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে গেছে। সেইসঙ্গে আমাদের ঈদের আনন্দও হারিয়ে গেছে।
এবিষয়ে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ৭৪৫ জনের পরিবার ও ৫ হাজার ৫৯৬ জন আহতকে মোট ৯৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা দিয়েছে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন। এর মধ্যে ৩৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা শহীদ পরিবারের মাঝে এবং ৫৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা টাকা আহত ব্যক্তিদের মাঝে দেওয়া হয়েছে। গত শুক্রবার সকালে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ।