ঢাকা ০৫:৪৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৩ নভেম্বর ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম ::

- পাঠক সংকটে ধুঁকছে দেশের লাইব্রেরীগুলো

ওরা বই ছেড়ে মোবাইলে

হালিম মোহাম্মদ
  • আপডেট সময় : ২০ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

পাঠক সংকটে ধুঁকছে রাজধানীসহ সারাদেশের পাবলিক লাইব্রেরীগুলো। বই পড়ার অভ্যাসে শূন্যের কোঠায় বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, বই পাঠের পরিবর্তে ডিজিটাল যুগে শিশু থেকে শুরু করে বালক, কিশোর, যুবকসহ সকলের হাতে এখন আর বই থাকে না। এখন তারা সকলেই মোবাইল ফোনে আশক্ত হয়ে পড়েছে।
প্রবীণ বই প্রেমীরা বলেছেন, এক সময় যেখানে পাঠাগারগুলোতে বইপ্রেমীদের ভিড় দেখা যেত, এখন সেখানে প্রযুক্তির জয়জয়কার। মোবাইল ফোন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ডিজিটাল বিনোদনের যুগে বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ দিন দিন কমে যাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে পাঠক সংকটের কারনে মুখ থুবড়ে পড়েছে রাজধানীসহ সারাদেশের লাইব্রেরীগুলো। সম্পতি এক জরিপে জানা গেছে, গড় পড়তা একজন বাংলাদেশি পুরো বছরে মাত্র ৬২ ঘণ্টা বই পড়েন, সংখ্যার দিক থেকে এর পরিমাণ তিনটিরও কম। এর ফলে বই পড়ার অভ্যাস তথা পাঠাভ্যাস র‌্যাংকিংয়ে একেবারে তলানিতে ঠাঁই পেয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি সিইও ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনের ২০২৪ সালের পাঠাভ্যাস সংক্রান্ত এক জরিপে দেখা গেছে, ১০২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ৯৭তম স্থানে।
তারা বলেন, এক সময়ের সাহিত্যচর্চায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশে আজ বই পড়ার অভ্যাস দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। প্রকাশক ও শিক্ষকদের মতে, পাঠ্যবইয়ের বাইরে পড়ার আগ্রহ প্রায় হারিয়েই গেছে। খুলনার এক লাইব্রেরিয়ান বলেন, শিশুরা টিকটক আর ফেসবুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দেয়, কিন্তু বইয়ের সঙ্গে পাঁচ মিনিটও কাটায় না। এমনকি শিক্ষিত পরিবারেও এখন বই রাখা হয় না।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলেন, একুশে বইমেলা ও অনলাইন বুকস্টোরগুলো বইয়ের বাজার টিকিয়ে রাখলেও, তথ্য বলছে, পাঠকদের পড়ার অভ্যাস অত্যন্ত অনিয়মিত। বড় শহরের বাইরে গ্রন্থাগার প্রায় নেই বললেই চলে, গ্রামীণ এলাকার বহু শিক্ষার্থী কখনো গল্পের বই হাতে পায় না। তারা আরো বলেন, পরিবার ও অনেকাংশে শিশুদের বই বিমুখতার জন্য দায়ী। কারণ অনেক পরিবারে শিশুদের হাতে অল্প বয়সেই মোবাইল তুলে দেওয়া হয়। ফলে তারা বইয়ের পরিবর্তে কার্টুন বা গেমের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বিটিআরসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬-১২ বছর বয়সী শিশুদের ৬০ শতাংশের হাতে স্মার্টফোন আছে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস তৈরির আগেই তারা প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে।
আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও পাঠ্যবইয়ের বাইরে স্বাধীন পাঠের প্রতি জোর কম। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার চাপের মধ্যে থেকেও বই পড়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়। শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠ্যক্রমভিত্তিক বইয়ের বাইরে সাহিত্য ও সাধারণ জ্ঞানের বই পড়ার তাগিদ না থাকায় শিক্ষার্থীরা বই পড়ায় আগ্রহ হারাচ্ছে। শহরকেন্দ্রিক কিছু বিদ্যালয়ে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করতে পাঠচক্রের আয়োজন করা হলেও দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নেই এমন কোনো উদ্যোগ।
এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বইপড়ুয়া দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির নাগরিকরা বছরে গড়ে ৩৫৭ ঘণ্টা বই পড়েন, অর্থাৎ সপ্তাহে প্রায় সাত ঘণ্টা। খুব কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে ভারত (৩৫২ ঘণ্টা) ও যুক্তরাজ্য (৩৪৩ ঘণ্টা)। চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে রয়েছে ফ্রান্স (৩০৫ ঘণ্টা) এবং ইতালি (২৭৮ ঘণ্টা)। চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান মাঝামাঝি। তবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতই একমাত্র পাঠাভ্যাসে শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ (৬২ ঘণ্টা), পাকিস্তান (৬০ ঘণ্টা) ও আফগানিস্তান (৫৮ ঘণ্টা) বিশ্বের সবচেয়ে কম বইপড়া দেশের তালিকায় জায়গা পেয়েছে।
জরিপটি বিশ্বজুড়ে এক স্পষ্ট বিভাজন দেখিয়ে দিচ্ছে, যেখানে একদল মানুষ এখনো বইকে জীবনের অংশ মনে করে, আরেকদল বই ছেড়ে ছোট ভিডিও ও সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে হারিয়ে যাচ্ছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মানুষ প্রতিদিন প্রায় এক ঘণ্টা বই পড়ে, সেখানে বাংলাদেশের মানুষ পড়ে গড়ে পাঁচ মিনিটেরও কম। ঢাকার এক প্রকাশক বলেন, বই পড়া কমে যাওয়া মানে শুধু পাঠাভ্যাস হারানো নয়, এর সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে কল্পনা, সহমর্মিতা আর জ্ঞান। এটি এক ধরনের মানসিক দারিদ্র্য।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বই বিমুখতা বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বলা যায় প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি এবং ইন্টারনেটের ব্যাপক ব্যবহার। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩ কোটি। এর মধ্যে অধিকাংশই স্মার্টফোন ব্যবহারকারী। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক এবং ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৮০ শতাংশ তরুণ প্রতিদিন ৫ ঘণ্টারও বেশি সময় মোবাইল স্ক্রিনে কাটায়। প্রযুক্তির প্রতি এমন আসক্তি বই পড়ার প্রতি উদাসীনতা তৈরি করছে। যেখানে আগে অবসর মানেই ছিল বই পড়া। সেখানে বর্তমানে অবসর সময় কাটানোর প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে মোবাইল ফোন। ২০২৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের ৭৫ শতাংশ সময় মোবাইল স্ক্রিনে ব্যয় করে। এই গবেষণায় আরো বলা হয়, বই পড়া সময়সাপেক্ষ এবং মনোযোগ দাবি করে, যা সোশ্যাল মিডিয়ার তাৎক্ষণিক বিনোদনের সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। তাছাড়া, বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য নিয়ে আলোচনা করার মতো বন্ধু বা সহপাঠীর অভাবেও বই পড়ার অনুপ্রেরণা কমে যায়।
তাছাড়াও বাংলাদেশে সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা অনেকাংশে কমে যাচ্ছে। বইমেলাগুলোতেও পাঠকদের সংখ্যা দিন দিন কমছে। ২০২৪ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকায় বইমেলাতে আগত দর্শনার্থীদের ৩০ শতাংশই কেবল ঘুরতে আসে, বই কেনার উদ্দেশ্য তাদের মধ্যে নেই। এর পেছনে অন্যতম কারণ হলো, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে প্রযুক্তিনির্ভর বিনোদনের চাহিদা। শুধু বই পড়া নয় বরং প্রযুক্তির কারণে বই প্রকাশনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রকাশকরা বলছেন, আগের মতো বই বিক্রি হয় না, যার ফলে নতুন লেখকদের উৎসাহও কমে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মতে, আমাদের তরুণ সমাজকে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। কারণ বই পড়া মানুষের জ্ঞানার্জন, চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি, ভাষাগত দক্ষতা এবং সৃজনশীলতা বিকাশে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। এটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জ্ঞান এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক। পাশাপাশি, বই পড়া জীবনের মূল্যবোধ ও নীতিবোধ গঠনে সহায়তা করে। তাই ব্যক্তিগত ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর বই পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। অভিভাবকদের উচিত শিশুদের বই উপহার দেওয়া এবং পড়ার প্রতি উৎসাহিত করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠাগারের আধুনিকায়ন এবং বই পড়ার প্রতিযোগিতার আয়োজনও গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বই পড়ার প্রচারণা চালানো যেতে পারে। জনপ্রিয় লেখক ও সাহিত্যিকদের নিয়ে লাইভ সেশন, বুক রিভিউ এবং আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে তরুণদের বইয়ের প্রতি আকর্ষণ বাড়ানো সম্ভব। তাছাড়াও তরুণ প্রজন্মকে বই পড়ায় উৎসাহিত করতে জাতীয় পর্যায়ে নানা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে।
সর্বোপরি, বর্তমানে আমরা মোবাইল ফোন ও প্রযুক্তির প্রভাবকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে চলা সম্ভব নয়। তবে প্রযুক্তির সঙ্গে বইয়ের সহাবস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব। আমাদের মনে রাখতে হবে, বই পড়ার অভ্যাস শুধু জ্ঞান অর্জনই নয় বরং তরুণ প্রজন্মের একটি সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করে। তাই প্রযুক্তি আর বইয়ের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করে সমাজে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা আরো উজ্জ্বল করা এখন আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
বিশ্বজুড়ে পাঠাভ্যাসের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেছে গ্লোবাল রিডিং র‌্যাংকিং ২০২৪। এতে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের গড় বার্ষিক বই পড়ার সময় বিবেচনা করা হয়েছে। জরিপ অনুযায়ী, বই পড়ায় বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশ হলো- যুক্তরাষ্ট্র (৩৫৭ ঘণ্টা), ভারত (৩৫২ ঘণ্টা), যুক্তরাজ্য (৩৪৩ ঘণ্টা), ফ্রান্স (৩০৫ ঘণ্টা), ইতালি (২৭৮ ঘণ্টা), কানাডা (২৩২ ঘণ্টা), রাশিয়া (২২৩ ঘণ্টা), অস্ট্রেলিয়া (২১৭ ঘণ্টা), স্পেন (১৮৭ ঘণ্টা) ও নেদারল্যান্ডস (১৮২ ঘণ্টা)। মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছে সুইজারল্যান্ড ও তাইওয়ান (১৫৭ ঘণ্টা), সিঙ্গাপুর, বেলজিয়াম ও হংকং (১৫৫ ঘণ্টা)। এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকা ও চীনের মানুষেরা (মূল ভূখ-) গড়ে ১৫৪ ঘণ্টা বই পড়ে।
জাপানের অবস্থান তুলনামূলক নিচে, তারা বছরে গড়ে মাত্র ১৩৫ ঘণ্টা বই পড়ে। তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, দক্ষিণ কোরিয়া ও ব্রাজিলের নাগরিকরা বছরে ১৩০ থেকে ১২৫ ঘণ্টা সময় দেন বই পড়ায়। ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ায় গড় বই পড়ার সময় ১২৩–১২২ ঘণ্টা। নিউজিল্যান্ড ১১৯ ঘণ্টা; গ্রিস, হাঙ্গেরি ও ইউক্রেন ১১৭ ঘণ্টা এবং স্লোভাকিয়া ১১৬ ঘণ্টা বই পড়ে।
তালিকার নিচের দিকে দেখা যায়, কেনিয়া ১০৮ ঘণ্টা, আর্জেন্টিনা ১০৩ ঘণ্টা এবং ভেনেজুয়েলার মানুষেরা ১০৪ ঘণ্টা বই পড়ে। আর সবচেয়ে নিচের অংশে রয়েছে বেশ কয়েকটি আফ্রিকান ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ। মরক্কো (৬৭ ঘণ্টা), আলজেরিয়া ও কাজাখস্তান (৬৫ ঘণ্টা), ইরাক (৬৪ ঘণ্টা) এবং বাংলাদেশ (৬২ ঘণ্টা) বই পড়ায় বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, পাকিস্তান ও ব্রুনেই সারা বছরে বই পড়ে গড়ে ৬০ ঘণ্টা। তালিকার একেবারে নিচে রয়েছে আফগানিস্তান। সেখানে একজন নাগরিক বছরে গড়ে মাত্র ৫৮ ঘণ্টা বই পড়েন।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

- পাঠক সংকটে ধুঁকছে দেশের লাইব্রেরীগুলো

ওরা বই ছেড়ে মোবাইলে

আপডেট সময় :

পাঠক সংকটে ধুঁকছে রাজধানীসহ সারাদেশের পাবলিক লাইব্রেরীগুলো। বই পড়ার অভ্যাসে শূন্যের কোঠায় বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, বই পাঠের পরিবর্তে ডিজিটাল যুগে শিশু থেকে শুরু করে বালক, কিশোর, যুবকসহ সকলের হাতে এখন আর বই থাকে না। এখন তারা সকলেই মোবাইল ফোনে আশক্ত হয়ে পড়েছে।
প্রবীণ বই প্রেমীরা বলেছেন, এক সময় যেখানে পাঠাগারগুলোতে বইপ্রেমীদের ভিড় দেখা যেত, এখন সেখানে প্রযুক্তির জয়জয়কার। মোবাইল ফোন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ডিজিটাল বিনোদনের যুগে বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ দিন দিন কমে যাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে পাঠক সংকটের কারনে মুখ থুবড়ে পড়েছে রাজধানীসহ সারাদেশের লাইব্রেরীগুলো। সম্পতি এক জরিপে জানা গেছে, গড় পড়তা একজন বাংলাদেশি পুরো বছরে মাত্র ৬২ ঘণ্টা বই পড়েন, সংখ্যার দিক থেকে এর পরিমাণ তিনটিরও কম। এর ফলে বই পড়ার অভ্যাস তথা পাঠাভ্যাস র‌্যাংকিংয়ে একেবারে তলানিতে ঠাঁই পেয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি সিইও ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনের ২০২৪ সালের পাঠাভ্যাস সংক্রান্ত এক জরিপে দেখা গেছে, ১০২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ৯৭তম স্থানে।
তারা বলেন, এক সময়ের সাহিত্যচর্চায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশে আজ বই পড়ার অভ্যাস দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। প্রকাশক ও শিক্ষকদের মতে, পাঠ্যবইয়ের বাইরে পড়ার আগ্রহ প্রায় হারিয়েই গেছে। খুলনার এক লাইব্রেরিয়ান বলেন, শিশুরা টিকটক আর ফেসবুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দেয়, কিন্তু বইয়ের সঙ্গে পাঁচ মিনিটও কাটায় না। এমনকি শিক্ষিত পরিবারেও এখন বই রাখা হয় না।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলেন, একুশে বইমেলা ও অনলাইন বুকস্টোরগুলো বইয়ের বাজার টিকিয়ে রাখলেও, তথ্য বলছে, পাঠকদের পড়ার অভ্যাস অত্যন্ত অনিয়মিত। বড় শহরের বাইরে গ্রন্থাগার প্রায় নেই বললেই চলে, গ্রামীণ এলাকার বহু শিক্ষার্থী কখনো গল্পের বই হাতে পায় না। তারা আরো বলেন, পরিবার ও অনেকাংশে শিশুদের বই বিমুখতার জন্য দায়ী। কারণ অনেক পরিবারে শিশুদের হাতে অল্প বয়সেই মোবাইল তুলে দেওয়া হয়। ফলে তারা বইয়ের পরিবর্তে কার্টুন বা গেমের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বিটিআরসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬-১২ বছর বয়সী শিশুদের ৬০ শতাংশের হাতে স্মার্টফোন আছে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস তৈরির আগেই তারা প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে।
আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও পাঠ্যবইয়ের বাইরে স্বাধীন পাঠের প্রতি জোর কম। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার চাপের মধ্যে থেকেও বই পড়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়। শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠ্যক্রমভিত্তিক বইয়ের বাইরে সাহিত্য ও সাধারণ জ্ঞানের বই পড়ার তাগিদ না থাকায় শিক্ষার্থীরা বই পড়ায় আগ্রহ হারাচ্ছে। শহরকেন্দ্রিক কিছু বিদ্যালয়ে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করতে পাঠচক্রের আয়োজন করা হলেও দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নেই এমন কোনো উদ্যোগ।
এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বইপড়ুয়া দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির নাগরিকরা বছরে গড়ে ৩৫৭ ঘণ্টা বই পড়েন, অর্থাৎ সপ্তাহে প্রায় সাত ঘণ্টা। খুব কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে ভারত (৩৫২ ঘণ্টা) ও যুক্তরাজ্য (৩৪৩ ঘণ্টা)। চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে রয়েছে ফ্রান্স (৩০৫ ঘণ্টা) এবং ইতালি (২৭৮ ঘণ্টা)। চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান মাঝামাঝি। তবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতই একমাত্র পাঠাভ্যাসে শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ (৬২ ঘণ্টা), পাকিস্তান (৬০ ঘণ্টা) ও আফগানিস্তান (৫৮ ঘণ্টা) বিশ্বের সবচেয়ে কম বইপড়া দেশের তালিকায় জায়গা পেয়েছে।
জরিপটি বিশ্বজুড়ে এক স্পষ্ট বিভাজন দেখিয়ে দিচ্ছে, যেখানে একদল মানুষ এখনো বইকে জীবনের অংশ মনে করে, আরেকদল বই ছেড়ে ছোট ভিডিও ও সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে হারিয়ে যাচ্ছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মানুষ প্রতিদিন প্রায় এক ঘণ্টা বই পড়ে, সেখানে বাংলাদেশের মানুষ পড়ে গড়ে পাঁচ মিনিটেরও কম। ঢাকার এক প্রকাশক বলেন, বই পড়া কমে যাওয়া মানে শুধু পাঠাভ্যাস হারানো নয়, এর সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে কল্পনা, সহমর্মিতা আর জ্ঞান। এটি এক ধরনের মানসিক দারিদ্র্য।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বই বিমুখতা বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বলা যায় প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি এবং ইন্টারনেটের ব্যাপক ব্যবহার। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩ কোটি। এর মধ্যে অধিকাংশই স্মার্টফোন ব্যবহারকারী। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক এবং ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৮০ শতাংশ তরুণ প্রতিদিন ৫ ঘণ্টারও বেশি সময় মোবাইল স্ক্রিনে কাটায়। প্রযুক্তির প্রতি এমন আসক্তি বই পড়ার প্রতি উদাসীনতা তৈরি করছে। যেখানে আগে অবসর মানেই ছিল বই পড়া। সেখানে বর্তমানে অবসর সময় কাটানোর প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে মোবাইল ফোন। ২০২৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের ৭৫ শতাংশ সময় মোবাইল স্ক্রিনে ব্যয় করে। এই গবেষণায় আরো বলা হয়, বই পড়া সময়সাপেক্ষ এবং মনোযোগ দাবি করে, যা সোশ্যাল মিডিয়ার তাৎক্ষণিক বিনোদনের সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। তাছাড়া, বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য নিয়ে আলোচনা করার মতো বন্ধু বা সহপাঠীর অভাবেও বই পড়ার অনুপ্রেরণা কমে যায়।
তাছাড়াও বাংলাদেশে সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা অনেকাংশে কমে যাচ্ছে। বইমেলাগুলোতেও পাঠকদের সংখ্যা দিন দিন কমছে। ২০২৪ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকায় বইমেলাতে আগত দর্শনার্থীদের ৩০ শতাংশই কেবল ঘুরতে আসে, বই কেনার উদ্দেশ্য তাদের মধ্যে নেই। এর পেছনে অন্যতম কারণ হলো, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে প্রযুক্তিনির্ভর বিনোদনের চাহিদা। শুধু বই পড়া নয় বরং প্রযুক্তির কারণে বই প্রকাশনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রকাশকরা বলছেন, আগের মতো বই বিক্রি হয় না, যার ফলে নতুন লেখকদের উৎসাহও কমে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মতে, আমাদের তরুণ সমাজকে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। কারণ বই পড়া মানুষের জ্ঞানার্জন, চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি, ভাষাগত দক্ষতা এবং সৃজনশীলতা বিকাশে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। এটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জ্ঞান এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক। পাশাপাশি, বই পড়া জীবনের মূল্যবোধ ও নীতিবোধ গঠনে সহায়তা করে। তাই ব্যক্তিগত ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর বই পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। অভিভাবকদের উচিত শিশুদের বই উপহার দেওয়া এবং পড়ার প্রতি উৎসাহিত করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠাগারের আধুনিকায়ন এবং বই পড়ার প্রতিযোগিতার আয়োজনও গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বই পড়ার প্রচারণা চালানো যেতে পারে। জনপ্রিয় লেখক ও সাহিত্যিকদের নিয়ে লাইভ সেশন, বুক রিভিউ এবং আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে তরুণদের বইয়ের প্রতি আকর্ষণ বাড়ানো সম্ভব। তাছাড়াও তরুণ প্রজন্মকে বই পড়ায় উৎসাহিত করতে জাতীয় পর্যায়ে নানা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে।
সর্বোপরি, বর্তমানে আমরা মোবাইল ফোন ও প্রযুক্তির প্রভাবকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে চলা সম্ভব নয়। তবে প্রযুক্তির সঙ্গে বইয়ের সহাবস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব। আমাদের মনে রাখতে হবে, বই পড়ার অভ্যাস শুধু জ্ঞান অর্জনই নয় বরং তরুণ প্রজন্মের একটি সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করে। তাই প্রযুক্তি আর বইয়ের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করে সমাজে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা আরো উজ্জ্বল করা এখন আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
বিশ্বজুড়ে পাঠাভ্যাসের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেছে গ্লোবাল রিডিং র‌্যাংকিং ২০২৪। এতে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের গড় বার্ষিক বই পড়ার সময় বিবেচনা করা হয়েছে। জরিপ অনুযায়ী, বই পড়ায় বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশ হলো- যুক্তরাষ্ট্র (৩৫৭ ঘণ্টা), ভারত (৩৫২ ঘণ্টা), যুক্তরাজ্য (৩৪৩ ঘণ্টা), ফ্রান্স (৩০৫ ঘণ্টা), ইতালি (২৭৮ ঘণ্টা), কানাডা (২৩২ ঘণ্টা), রাশিয়া (২২৩ ঘণ্টা), অস্ট্রেলিয়া (২১৭ ঘণ্টা), স্পেন (১৮৭ ঘণ্টা) ও নেদারল্যান্ডস (১৮২ ঘণ্টা)। মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছে সুইজারল্যান্ড ও তাইওয়ান (১৫৭ ঘণ্টা), সিঙ্গাপুর, বেলজিয়াম ও হংকং (১৫৫ ঘণ্টা)। এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকা ও চীনের মানুষেরা (মূল ভূখ-) গড়ে ১৫৪ ঘণ্টা বই পড়ে।
জাপানের অবস্থান তুলনামূলক নিচে, তারা বছরে গড়ে মাত্র ১৩৫ ঘণ্টা বই পড়ে। তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, দক্ষিণ কোরিয়া ও ব্রাজিলের নাগরিকরা বছরে ১৩০ থেকে ১২৫ ঘণ্টা সময় দেন বই পড়ায়। ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ায় গড় বই পড়ার সময় ১২৩–১২২ ঘণ্টা। নিউজিল্যান্ড ১১৯ ঘণ্টা; গ্রিস, হাঙ্গেরি ও ইউক্রেন ১১৭ ঘণ্টা এবং স্লোভাকিয়া ১১৬ ঘণ্টা বই পড়ে।
তালিকার নিচের দিকে দেখা যায়, কেনিয়া ১০৮ ঘণ্টা, আর্জেন্টিনা ১০৩ ঘণ্টা এবং ভেনেজুয়েলার মানুষেরা ১০৪ ঘণ্টা বই পড়ে। আর সবচেয়ে নিচের অংশে রয়েছে বেশ কয়েকটি আফ্রিকান ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ। মরক্কো (৬৭ ঘণ্টা), আলজেরিয়া ও কাজাখস্তান (৬৫ ঘণ্টা), ইরাক (৬৪ ঘণ্টা) এবং বাংলাদেশ (৬২ ঘণ্টা) বই পড়ায় বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, পাকিস্তান ও ব্রুনেই সারা বছরে বই পড়ে গড়ে ৬০ ঘণ্টা। তালিকার একেবারে নিচে রয়েছে আফগানিস্তান। সেখানে একজন নাগরিক বছরে গড়ে মাত্র ৫৮ ঘণ্টা বই পড়েন।