কারাগারে ঈদের ৩ জামাত বন্দিদের বিশেষ আয়োজন

- আপডেট সময় : ০৪:২৬:২৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৬ জুন ২০২৫ ৫১ বার পড়া হয়েছে
আনন্দ নেই দেড়শতাধিক ভিআইপি বন্দির
আজ শুক্রবার। রাত পোহালেই কার কোরবানির ঈদ। কোরবানির ঈদ উপলক্ষে দেশের ৬৮ কারাগারে বন্দির জন্য তিন দিনব্যাপী বিশেষ আয়োজন করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। এসব আয়োজনের তদারক করছেন ঢাকা বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন্স) জাহাঙ্গীর কবির। এর মধ্যে ঈদের আগের দিন কারাগার প্রাঙ্গণে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, দুস্থ বন্দিদের মাঝে নতুন পোশাক বিতরণ, বন্দিদের অংশগ্রহণে কিরাত, আজান, সিরাত, কুইজ প্রতিযোগিতা এবং পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠিত হবে।
ঈদের দিন বন্দিদের জন্য পরিবেশিত হবে উন্নতমানের খাবার । নাশতায় থাকবে পায়েস ও মুড়ি; দুপুরে থাকবে মুরগির রোস্ট, গরু ও খাসির মাংস, সালাদ, কোমল পানীয়, মিষ্টান্ন ও পান-সুপারি। এছাড়া তিনটি ঈদ জামাত আয়োজন করা হবে । একটি বন্দিদের জন্য ও দুটি কারা স্টাফদের জন্য। আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে আরপি গেটে উপহার ও সুভেনিয়রও বিতরণ করা হবে।
ঈদের দ্বিতীয় দিন আত্মীয়দের পাঠানো রান্না করা খাবার বন্দিদের মাঝে বিতরণ করা হবে। আর তৃতীয় দিন আয়োজিত হবে “প্রিজন ম্যারাথন-২০২৫”, যাতে অংশ নেবেন কর্মকর্তা, কর্মচারী ও স্থানীয় জনগণ। একই দিনে থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণ।
কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার এ কে এম মাসুদ জানান, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বন্দিদের জন্য থাকবে বিশেষ খাবার ও বিনোদনের ব্যবস্থা। ঈদের আনন্দ সারাদেশের সব কারাগারে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যেই এই আয়োজন।
কারাগারে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক সদস্য জানান, ঈদের দিন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বজনদের ভিড় আরও বাড়বে। আর ঈদের পরদিন ভিড় সামলানো কঠিন হয়ে যায়। সব বন্দির পরিবার কি আসেন? এমন প্রশ্নে সেই নিরাপত্তা কর্মী জানান, এমন অসংখ্য ব্যক্তি কারাগারে আছেন যাদের দেখতে পরিবারের সদস্যরা আসেন না। কারও কারও তো পরিবারই নেই।
কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঈদের দিন সকালে দেশের সব কারাগারেই নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা ছিল। সেইসঙ্গে দিনভর থাকবে বন্দিদের অংশগ্রহণে নানা আয়োজন। হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও।
সন্ধ্যায় কারারক্ষী ব্যারাকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং সন্ধ্যার পর স্টাফদের সন্তানদের অংশগ্রহণে কবিতা আবৃত্তি ও গানের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া ঈদের তিনদিন পরিবারের সঙ্গে একটি বিশেষ সাক্ষাতেরও সুযোগ পাবেন সব কারাবন্দি।
কারা অধিদপ্তরের সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশের কারাগারগুলোয় ৪২ হাজার ৪৫০ জন ধারণক্ষমতার বিপরীতে বর্তমানে বন্দি আছেন মোট ৬০ হাজার ৯১৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ বন্দি ৫৮ হাজার ৮৯০ ও নারী রয়েছেন ২ হাজার ২৪ জন। বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৫৭ জন, কাশিমপুরে চারটি কারাগারে ৬২ জনসহ ঢাকা বিভাগের অন্যান্য কারাগার মিলিয়ে মোট ১২৫ জন ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দি রয়েছেন। সারাদেশের কেন্দ্রীয় এবং জেলা কারাগারে আটক রয়েছেন প্রায় দেড় শতাধিক ভিআইপি বন্দি বা ডিভিশনপ্রাপ্ত প্রথম শ্রেনীর বন্দি।
এদিকে কারাগারে আটক একসময়ের দোর্দ- দাপুটে এই নেতারা এখন বড্ড অসহায়। তাদের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। কী ছিল না তার? অর্থবিত্ত বা ক্ষমতা! এখন সবই হাতছাড়া। তিনিও ঈদ করছেন কারাগারে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু। আওয়ামী লীগের একসময়ে ‘মিস্টার সিদ্ধান্ত’ নামে খ্যাত এই নেতা দলে অপাঙক্তেয় হলেও এলাকায় আধিপত্য ঠিকই ধরে রেখেছিলেন। তার কাছে হাজিরা দিতে ও দোয়া নিতে হতো বহু শিল্পপতির। বরিশাল অঞ্চলে নেতা হতে হলে হাতেগোনা যে দুই-তিনজনের আশির্বাদ প্রয়োজন হতো, তিনি তাদেরই অন্যতম। প্রতাপশালী এই নেতার গ্রেফতারের পর তার ঢাকার ও ঝালকাঠির বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা উদ্ধার হয়েছে। কারাগারে অসহায় ঈদ পালন করছেন তিনিও।
যদিও সম্প্রতি আদালতে সাবেক এই মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি ঢাকা বারের সদস্য, হাইকোর্ট বারের সদস্য। এখানকার পরিবেশ দেখে দুঃখিত। এই পরিবেশে কিছু বলা উচিত না। মামলা চলবে, ভবিষ্যতে আমি আমার বক্তব্য উপস্থাপন করবো। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অনেক কথা বলেছেন। আমি একজন রাজনীতিবিদ। রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে গেলে দুই ঘণ্টা লেগে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা একে অপরের ভাই ভাই। মিলে-মিশে থাকা উচিত। আমরা একসঙ্গে থাকবো। কেন দ্বন্দ্বে জড়াবো? আশা করছি, এ পরিবেশ থাকবে না।’ তার এ কথার মধ্যেই বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা চিৎকার শুরু করেন। তারা বলতে শুরু করেন, তিনি (আমু) ভয় দেখাচ্ছেন। তখন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তাদের শান্ত করেন। পরে আমু বলেন, ‘আমরা যার যার পক্ষ অবলম্বন করবো। নিজেরা নিজেরা কেন দ্বন্দ্বে জড়াবো।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ড. আব্দুর রাজ্জাক, লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, শাজাহান খান, কাজী জাফরউল্লাহ, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ডা. দীপু মনিরও ঈদ কাটছে কারাগারে। একেকজন একেকটা আসনে ধরাকে সরা জ্ঞান করলেও এখন তাদের অসহায়ত্বে কেউ পাশে নেই।
সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা কামাল আহমেদ মজুমদার তো শেষ বয়সে এসে কারাগারের যন্ত্রণা না নিতে পেরে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ারই ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি আদালতে বলেন, ‘আমার ৭৬ বছর বয়স। আমার চোখ ৭০ শতাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। আমার পরিবার সম্পর্কে কোনো খোঁজ-খবর নিতে পারছি না। আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতি করবো না।’
‘রাজনীতি থেকে ইস্তফা দিলাম। আমি আওয়ামী লীগের কোনো পদে নেই। এখন থেকে প্রাথমিক সদস্য পথ থেকেও পদত্যাগ করলাম। একের পর এক মামলা দেওয়া হচ্ছে। একের পর এক নির্যাতন করা হচ্ছে। এই বয়সে আমার ওপর জুলুম চালানো হচ্ছে। আল্লাহকে ডাক দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই’- বলেন ঢাকার রাজনীতির এই প্রভাবশালী নেতা।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের কথিত ছোটভাই সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকও ঈদ করছেন কারাগারে। সবচেয়ে প্রভাবশালী এই প্রতিমন্ত্রী এখন সবচেয়ে অসহায়। ১০ মার্চ দুদকের মামলায় হাজিরা দিতে আদালতে এসে সাংবাদিকদের দেখে জুনাইদ আহমেদ পলক বলতে শুরু করেন, ‘কথা বললেই রিমান্ড ও মামলার সংখ্যা বাড়ে। হাত পেছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে আটকে রাখে। কথা বলে কী লাভ?’
এর বাইরে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, জাতীয় কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার, সাবেক এমপি হাজী মোহাম্মদ সেলিমসহ দলটির জেলা-উপজেলা পর্যায়ের অসংখ্য নেতা এবছর কারাগারে ঈদ করছেন। তবে আটককৃতদের ভিতরে তেমন কোনো আনন্দের লেস মাত্র দেখা যাচ্ছে না। ভিআইপিরা শুধুমাত্র জেলকোড অনুযায়ী জেলে সময় পার করছেন বা টাইম পাশ করছেন। রুটিন মাফিক গোসল করা খাবার খাওয়া নামাজ আদায় করছেন। ধর্মীয় কিতাব, পত্রিকা পড়ে, টিভির খবর দেখে সময় কাটাচ্ছেন তারা।
এবিষয়ে কারা অধিদপ্তর ঢাকা বিভাগের ডিআইজি প্রিজন্স জাহাঙ্গীর কবির জানান, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কাশিমপুরের চারটি কেন্দ্রীয় কারাগার এবং মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, গোপালগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর ও নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগার এই আয়োজনের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তিনি আরও বলেন, দেশের কারাগারের ৮টি বিভাগে ৬৮ কারাগারে একই নিয়মে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হবে। খাবারের বেলায় একই ভাবে রুটিন মাফিক কার্যক্রম চলবে।