কারামুক্ত হয়ে ওরা আরও ভয়ংকর
- আপডেট সময় : ১২:৩৩:২০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫ ৫৯ বার পড়া হয়েছে
* গত তিন মাসে ১০টি ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ধানমন্ডি, মগবাজার, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, মতিঝিলের অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করছে ইমন, সুব্রত বাইন, পিচ্চি হেলাল, কিলার আব্বাসসহ আট থেকে দশ শীর্ষ সন্ত্রাসী
* শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ঠেকাতে তাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের আইনের আওতায় আনা জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলো যেন শীর্ষ পর্যায়ের সন্ত্রাসীদের আশ্রয় প্রশ্রয় বা রাজনৈতিকভাবে যে সহযোগিতা, সেগুলো না দেয়। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সন্ত্রাসীদের ধরতে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে : ড. তৌহিদুল হক
রাজধানীতে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা, মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ কিংবা নির্মাণাধীন ভবনে চাঁদাবাজি করছেন শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। চাঁদা না দিলে গুলি ও বোমা মেরে আতঙ্ক তৈরি করছেন, দিচ্ছেন প্রাণনাশের হুমকিও। । সম্প্রতি সময় সংবাদের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে এমন সব তথ্য। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে সন্ত্রাসীরা ভয়ংকর হয়ে উঠেছেন এমন কথা বলছেন সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক। পুলিশ বলেছে, সদ্য কারামুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসিদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। বেশকিছু ঘটনার বিশ্লেষণে উঠে এসেছে ধানমন্ডি ৭ নম্বরের এ-তে সাত থেকে আটটি ভবন তৈরির কাজ চলছে। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর ৫ থেকে ৬ জন যুবক এসে যোগাযোগ করতে একটি মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে যান। সেই নম্বরে যোগাযোগ করলে পুলিশের খাতায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের পরিচয়ে ৩০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। চাঁদা না দিয়ে পুলিশি পাহারা বসালে হামলা চালান সন্ত্রাসীরা। ভবনের সামনে এসে দরজা খুলে ফাঁকা গুলি করার পর পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে যান তারা। এ ঘটনায় নির্মাণ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আতঙ্কে আছেন এলাকাবাসীও।
গত ১০ জানুয়ারি এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান মার্কেটের সামনে দুই ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখম করা হয়। এখানেও নাম আসে ইমনের। তবে আহতরা আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালের ভাই হওয়ায় দুজনের দ্বন্দ্বের বিষয় সামনে এলেও ভুক্তভোগীদের দাবি, জড়িত কেবল ইমন। রাজধানীর মগবাজারের বিশাল সেন্টারের দুটি দোকান দখলের চেষ্টা করে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন। মাঝে মাঝে মহড়া দিচ্ছেন তার লোকজন। রাজধানীর রূপনগরের রিও ফ্যাশনের ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করেন শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত। কারখানাটির সামনে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ভুক্তভোগীরা জানান, সন্ত্রাসীদের উৎপাতের কথাও। সম্প্রতি এক চাঁদাবাজকে গ্রেফতার করতে গেলে ছুরিকাঘাত করা হয় এক পুলিশ সদস্যকেও।
গত তিন মাসে ১০টি ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ধানমন্ডি, মগবাজার, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, মতিঝিলের অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করছে ইমন, সুব্রত বাইন, পিচ্চি হেলাল, কিলার আব্বাসসহ আট থেকে দশ জন শীর্ষ সন্ত্রাসী। কয়েকজন সহযোগী গ্রেফতার হলেও এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে তারা।
এ নিয়ে ডিএমপির গণমাধ্যম বিভাগের উপ-কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, কিছু গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে, আমরা আরও তথ্য সংগ্রহ করছি এবং তথ্য হালনাগাদ করা হচ্ছে। যে যতই চেষ্টা করুক না কেন, আমরা তাদের আইনের আওতায় আনায় বদ্ধপরিকর।
সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ঠেকাতে তাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের আইনের আওতায় আনা জরুরি। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যেন শীর্ষ পর্যায়ের সন্ত্রাসীদের আশ্রয় প্রশ্রয় বা রাজনৈতিকভাবে যে সহযোগিতা, সেগুলো না দেয়। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সন্ত্রাসীদের ধরতে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখার পরামর্শ এ বিশ্লেষকের।
এবিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কারামুক্ত হলেই পুরনো মামলায় গ্রেপ্তার করা হবে। সংশ্লিস্ট সূত্র মতে, সম্প্রতি বেশ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী কারামুক্ত হওয়ার পরই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে আন্ডারওয়ার্ল্ড। একে অপরকে ঘায়েল করতে মরিয়া তারা। দীর্ঘদিন কারাগারে থাকায় প্রকাশ্যে করতে পারেনি চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ। বিশেষ আশীর্বাদে কারামুক্ত হয়েই শীর্ষ সন্ত্রাসীরা সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে অপরাধ কর্মকান্ড চালিয়ে আসছে। হত্যাকান্ড ও চাঁদাবাজিতে লিপ্ত আছে কেউ কেউ।
এদিকে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ছাড় না দিতে ইউনিটপ্রধান, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার এসপিদের কাছে দেওয়া হয়েছে বিশেষ নির্দেশনা। এমনকি কোনো সন্ত্রাসী কারামুক্ত হলেই পুরনো মামলায় আবারও ধরার পরিকল্পনা নিয়েছে পুলিশ। মূলত আন্ডারওয়ার্ল্ড রুখতেই পুলিশ ভিন্ন কৌশল নিয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ডিএমপির নিউ মার্কেট জোনের একাধিক পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারসহ এলিফ্যান্ট রোড, নিউ মার্কেট ও আশপাশের এলাকা, ধানমন্ডির কিছু অংশের বিপণিবিতান, ইন্টারনেট, কেবল টিভির সংযোগ (ডিশ) ও ফুটপাতের চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিতেই সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসীচক্র নিজেদের শক্তির জানান দিতেই পরিকল্পিত হামলা চালিয়েছে। মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের ব্যবসায়ী এহতেশামুলকে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টার সময় সন্ত্রাসী দলের ১৫ থেকে ২০ জনের মতো উপস্থিত ছিল। আশপাশের বিভিন্ন স্থানে আরও ২০ জনের মতো অবস্থান নিয়েছিল। মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের বিভিন্ন মার্কেটে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবসা করছেন এমন ব্যবসায়ীরা বলেন, প্রায় সাড়ে চার মাস আগে থেকেই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি চঞ্চলসহ কয়েকজন কয়েক দফায় মার্কেট পরিচালনা কমিটির কার্যালয়ে গিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের কথা বলে মার্কেট সংশ্লিষ্ট নানা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার বিষয়ে জানায়। মূলত এ ঘটনার পরই সন্ত্রাসীরা মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের দোকানগুলোর ময়লার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ বদলে যায়। এ বিষয়ে নিউ মার্কেট থানার ওসি মোহসীন উদ্দিন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের বসুন্ধরা শপিংমল এলাকায় ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা না পেয়ে গুলি, ককটেল ও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। গত ২৫ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ১১টার দিকে একদল দুর্বৃত্ত ফাঁকা গুলি, ককটেল ও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপে করে পালিয়ে যায়।
এ ঘটনার বিষয়ে ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দাদা পরিচয়ে এক ব্যক্তি ব্যবসায়ীদের বলেন কেউ চাঁদা চাইলে তাকে জানাতে। এর এক দিন পর এসে সেই ব্যক্তি নিজেই চাঁদা দাবি করেন। কিন্তু ব্যবসায়ীরা চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় গুলি, ককটেল ও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে। পেট্রোল বোমায় কয়েকটি দোকানের মালপত্র পুড়ে যায়। এ ছাড়া আরও কিছু দোকানের মালপত্র লুট করা হয়।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন,এ ধরনের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের যখন মুক্তি দেওয়া হয়, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তাদের নজরদারিতে রাখা হবে। বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নজরদারির মধ্যে না রাখলে শীর্ষ পর্যায়ের সন্ত্রাসীরা জামিনে বের হওয়ার পরে ভালো হয়ে যাবে, এই সরল বিশ্বাস রাখার তো কোনো সুযোগ নেই। সেই জায়গা থেকে নতুন করে অপরাধের পরিকল্পনা করেছে। নতুন করে দল গোছাচ্ছে, কেউ নতুন সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্র গড়ে তুলছে। এ রকমও হয়েছে, কেউ কেউ জামিনে বের হয়ে নতুন করে অপরাধে লিপ্ত হয়ে নতুন মামলায় আসামি হয়েছে। এ রকম দুজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম আমরা জেনেছি নানা মাধ্যমে। তারা চাঁদাবাজি, দখল, মাদক-বাণিজ্য ও অস্ত্র-বাণিজ্যের মতো অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। এ ছাড়া একটি গ্রুপ অন্য একটি গ্রুপের সঙ্গে সংঘাতে যুক্ত হচ্ছে আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে।
পুলিশ সূত্র জানায়, সন্ত্রাসীদের তৎপরতা নিয়ে পুলিশের কয়েকটি ইউনিট প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনটি পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠিয়েছে। পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাইয়ে আত্মগোপন করে আছেন। টিপু হত্যাকা-ের পর তিনি আলোচনায় এসেছিলেন। দুবাইয়ে থাকলেও ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে সবচেয়ে বেশি প্রভাব তার। জিসানের সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক ভারতে পালিয়ে আছেন। কিন্তু দেশে তার দখলবাজি, টেন্ডার বাণিজ্য ও চাঁদাবাজিতে নিয়ন্ত্রণ এখনো আছে। মোল্লা মাসুদ ও সুব্রত বাইন ভারতে থেকে সক্রিয় আছেন। তাদের সঙ্গে মোহাম্মদপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, কিলার আব্বাস ও ইমনের ভালো যোগাযোগ আছে। তারা আবারও আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছে। প্রায় ২০ বছর ধরে কারাগারে আটক ছিল হেলাল। তার বিরুদ্ধে আছে অন্তত এক ডজন মামলা। সব মামলায় জামিন হয়। ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর পুলিশ সদর দপ্তর ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করে। তবে এই তালিকায় সুইডেন আসলামের নাম ছিল না। তাদের মধ্যে ১৩ জন বিদেশে আত্মগোপন করে আছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জামিনে মুক্ত হতে নানা চেষ্টা করেন। প্রথমে কারাগার থেকে মুক্ত হয় কিলার আব্বাস। আরও মুক্ত হয় সুইডেন আসলাম, মোহাম্মদপুরের ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, হাজারীবাগ এলাকার সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন ও খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু।