ঢাকা ১১:০৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০২ জুন ২০২৫

ট্যাবলেট তৈরিতে আটা-ময়দা!

হালিম মোহাম্মদ
  • আপডেট সময় : ১১:১৭:৪৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩১ মে ২০২৫ ৪৫ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ভেজাল ও নকল ওষুধের ব্যবসায়িরা। রাজধানী থেকে শুরু করে মফস্বলসহ সর্বত্রই বিক্রয় হচ্ছে নকল ও ভেজাল ওষুধ, যা নিয়ে রোগী ও চিকিৎসকদের মধ্যে উদ্বেগ বেড়ে চলেছে। কিছু কিছু ওষুধের ক্ষেত্রে ভেজাল ও নকলের মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে, চিকিৎসকদের মধ্যে অনেকে ওষুধগুলোর ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছেন, এমনকি কেউ কেউ বন্ধও করে দিয়েছেন। তেমনই একটি স্পর্শকাতর ওষুধের নাম অ্যালবুমিন ইঞ্জেকশন, যা মূলত বড় ধরনের অস্ত্রপচার বা গুরুতর আঘাত পরবর্তী চিকিৎসায় রক্তে প্লাজমার পরিমাণ বাড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
বিজ্ঞানবিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকী নেচারে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র ঢাকা শহরে বিক্রি হওয়া অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ ওষুধই নকল, ভেজাল এবং নিম্নমানের। ঢাকার বাইরে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা। অনেক ক্ষেত্রে আটা-ময়দা দিয়ে বানানো নকল বড়ি বা ট্যাবলেট বিক্রির ঘটনাও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এটি বন্ধ করার জন্য যে ধরনের তৎপরতা থাকা প্রয়োজন, সরকারের তরফে সেটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন ভোক্তারা।
এবিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. চঞ্চল কুমার ঘোষ বলছেন, বাজারে এর নকল এতটাই বেড়ে গেছে যে, আমরা এটা দেয়া প্রায় বন্ধই করে দিছি। মূলত অ্যালবুমিন ব্যবহারের পরও বছরখানেক আগে সিলেটে এক রোগীর মৃত্যু এবং ঢাকার বেশকিছু হাসপাতালে রোগীর শরীরে জটিলতা দেখা দেয়ায় ইঞ্জেকশনটি পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। এরপরেই নকলের বিষয়টি নিশ্চিত হন চিকিৎসকরা।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস-প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, এক্ষেত্রে আমরা সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি। যার কারণে কঠোর আইন থাকার পরও বাজারে ভেজাল ও নকল ওষুধের বিক্রি কমছে না।
বিশেষজ্ঞদের জরিপে দেখা গেছে, ভেজাল-নকল ওষুধ মফস্বলে বেশি বিক্রি ও ব্যবহার হচ্ছে। স্বাস্থ্যখাতের গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহর থেকে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত সবখানেই ভেজাল ও নকল ওষুধ ছড়িয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে যেসব ওষুধের চাহিদা এবং দাম বেশি, সেগুলোরই নকল ও ভেজাল বাজারে বেশি দেখা যাচ্ছে।
ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের স্কুল অব মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, গ্যাস্ট্রিক কিংবা অ্যান্টিবায়োটিকের ওষুধ। সারা দেশেই এগুলোর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সে কারণে অসাধু ব্যবসায়িরা সেগুলোর নকল বের করে সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
২০২২ সালে গবেষণাটির প্রধম ধাপের ফলাফলে প্রকাশিত হয়। সেখানে ঢাকায় সংগৃহীত নমুনায় নকল, ভেজাল এবং নিম্নমানের ওষুধের পরিমাণ ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। গবেষণার দ্বিতীয় ধাপে ঢাকার বাইরের জেলাগুলো থেকে গ্যাস্ট্রিক ও অ্যান্টিবায়োটিকে ওই তিন ধরনের ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়েছে। সেখানে ঢাকার থেকে প্রায় দ্বিগুণ, অর্থাৎ প্রায় ২০ শতাংশের মতো নকল, ভেজাল এবং নিম্নমানের ওষুধ পেয়েছেন গবেষকরা। নকল ওষুধের কোনো কোনোটির মধ্যে উপাদান হিসেবে আটা-ময়দাও পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। ফার্মাসিউটিক্যালে আটা-ময়দা দিয়ে বানানো হচ্ছে ট্যাবলেট। বাংলাদেশে যেসব ওষুধের নকল তৈরি হচ্ছে, সেগুলোতে উপাদান হিসেবে আটা-ময়দা, এমনকি সুজি ব্যবহার করার প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকরা।
২০২৪ সালের মার্চে ঢাকা ও বরিশালে অভিযান চালিয়ে আটা, ময়দা এবং সুজি ব্যবহার করে নকল ওষুধ উৎপাদনকারী একটি দলের পাঁচজন সদস্যকে গ্রেফতার করেছিল গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের কাছ থেকে তখন বিভিন্ন ধরনের প্রায় পাঁচ লাখ নকল অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ধার করা হয়। দলটির সদস্যরা প্রায় দশ বছর ধরে নকল ওষুধ তৈরি ও বিক্রি করে আসছিল বলে জানান পুলিশের কর্মকর্তারা।
এ সকল বিষয়ে ভোক্তাদের সংগঠন ক্যাবের ভাইস-প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, নকল ওষুধ উৎপাদনে যেহেতু আসলের মতো খরচ হচ্ছে না, সেকারণে ওষুধগুলো কোম্পানির চেয়ে অনেক কম রেটে (দামে) ফার্মেসিগুলো পেয়ে যাচ্ছে। ফলে বেশি লাভের আশায় তারাও এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক সময় কিছুটা কম দামে পাওয়ার আশায় রোগীরাও নকল ওষুধ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন।
এদিকে বেসরকারি হিসেবে, বাংলাদেশে বর্তমানে আড়াই লাখেরও বেশি ওষুধের দোকান রয়েছে। এসব ফার্মেসির মধ্যে বড় একটা অংশেরই অনুমোদন নেই বলে জানা যাচ্ছে। আবার যেগুলোর অনুমোদন রয়েছে, নজরদারির অভাবে সেগুলোর মধ্যে অনেক ফার্মেসি নিয়ম-নীতি মানছে না বলে জানিয়েছেন তারা।
এব্যাপারে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, টাকা খরচ করে এসব ওষুধ কিনে মানুষ কেবল প্রতারিতই হচ্ছে না, বরং এর ফলে তাদের ভোগান্তি বাড়ছে। এমনকি অনেকে মারাও যাচ্ছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, ভেজাল ও নকল ওষুধ দুইভাবে মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে।
ডা. শরমিন বলেন, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ডা. শাহনূর শরমিন। তাৎক্ষণিক ক্ষতিটা হলো রোগির ভোগান্তি। আটা-ময়না দিয়ে বানানো নকল ওষুধ যেহেতু কাজ করতে পারে না, সেক্ষেত্রে রোগ সারছে না। অন্যদিকে, যেগুলোতে রাসায়নিক উপাদান রয়েছে, সেগুলোর কারণে দীর্ঘ মেয়াদে রোগির শরীরে নতুন নানান স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হতে পারে। আবার গুরুতর অসুস্থ রোগীর ক্ষেত্রে নকল-ভেজাল ওষুধ মৃত্যুরও কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
তিনি বলছেন, এক্ষেত্রে ওষুধে কাজ না হওয়ায় যেমন মৃত্যু হতে পারে, তেমনিভাবে রাসায়নিক উপাদানের প্রতিক্রিয়াতেও সেটি ঘটতে পারে। গত বছর ঢাকার বেশকিছু হাসপাতালে অ্যানেস্থেসিয়া বা চেতনানাশক ওষুধ দেয়ার পর অন্তত তিনটি শিশুর মৃত্যু হয়। পরে চেতনানাশকে ব্যবহৃত হ্যালোথেন পরীক্ষা করে চিকিৎসকরা জানতে পারেন যে, সেগুলোতে ভেজাল ছিল। এ ঘটনার পর দেশের সরকারি-বেসরকারি সকল হাসপাতালে চেতনানাশক ওষুধ হিসেবে হ্যালোথেনের ব্যবহার বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। নকল ও ভেজাল ওষুধের মতো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখা না গেলেও নিম্নমানের ওষুধে দীর্ঘমেয়াদে জনস্বাস্থ্যের বড় ক্ষতি করছে বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা।
অপরদিকে ঢাকায় ওষুধের বড় পাইকারি বাজার মিটফোর্ড এলাকার একজন ওষুধ ব্যবসায়ী বলছেন, স্বাভাবিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় নকল ও ভেজাল ওষুধের উৎপাদন এবং বিক্রি কম দেখা যায়। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে পুলিশ বাহিনীকে আগের মতো সক্রিয় অবস্থায় দেখা যাচ্ছে না। ওষুধ প্রশাসনকেও সেভাবে মাঠে নামতে দেখা যায়নি। এই সুযোগে হেরা আবার ব্যবসা শুরু করছে।
বাংলাদেশ কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতি কার্যালয়ের সচিব আবু হেলা মোস্তফা কামাল বলেন, কিন্তু এখন যতটুকু জানি, এগুলো অনেক কমে গেছে। তারপরও কেউ নকল ওষুধ বিক্রি করছে কি-না, সেটা বোঝা মুশকিল। ধরা না পড়া পর্যন্ত টের পাওয়া যায় না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, নকল ওষুধ বিক্রির ধরন এখন বদলে গেছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ওয়ারি বিভাগের উপকমিশনার মোস্তাক সর্দার বলেন, অতীতে নকল ও ভেজাল ওষুধ কারকারিদের যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই ধরা পড়েছেন গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। কিন্তু নতুন চক্রটির ব্যাপারে এখনও কোনো তথ্য আমার জানা নেই। বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখবো।
২০২৩ সালে পাস হওয়া ওষুধ ও কসমেটিক আইনে নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। গত দুই বছরে নকল ওষুধ কারবারিদের মধ্যে কয়েকজন ধরাও পড়েছে। কিন্তু কাউকেই যাবজ্জীবন সাজা দিতে দেখা যায়নি। ক্যাবের নেতা এস এম নাজের হোসাইন বলেন, উল্টো দেখা যাচ্ছে, যারা ধরা পড়ছেন তারাও কয়েক মাসের মধ্যে ছাড়া পেয়ে পুনরায় ব্যবসা শুরু করেছে। কারণ তারা দেখেছে যে, শাস্তি হয় না।
নকল ও ভেজাল ওষুধের মামলায় সাজা না হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আসরাফ হোসেন বলেন, এটা আদালতের ব্যাপার, আমাদের হাতে নেই। তবে বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন যে, তদন্তে গাফিলতি থাকার কারণে অনেক সময় দোষী ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া যাচ্ছে না।
উল্লেখ্য যে, ২০০৯ সালে দেশের একটি কোম্পানির প্যারাসিটামল সিরাপ পান করে অন্তত ২৮টি শিশুর মৃত্যু হয়। ঘটনার পর ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। কিন্তু তদন্তের সময় আদালতে প্যারাসিটামল সিরাপের যে নমুনা জমা দেওয়া হয়েছিল, সেটি সরাসরি ওই কারখানা থেকে জব্দ না করায় কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। সে সময় সরকারি আইনজীবীদের কথায় তদন্তের সেই দুর্বলতার কথা প্রকাশ পেয়েছিল।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ট্যাবলেট তৈরিতে আটা-ময়দা!

আপডেট সময় : ১১:১৭:৪৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩১ মে ২০২৫

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ভেজাল ও নকল ওষুধের ব্যবসায়িরা। রাজধানী থেকে শুরু করে মফস্বলসহ সর্বত্রই বিক্রয় হচ্ছে নকল ও ভেজাল ওষুধ, যা নিয়ে রোগী ও চিকিৎসকদের মধ্যে উদ্বেগ বেড়ে চলেছে। কিছু কিছু ওষুধের ক্ষেত্রে ভেজাল ও নকলের মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে, চিকিৎসকদের মধ্যে অনেকে ওষুধগুলোর ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছেন, এমনকি কেউ কেউ বন্ধও করে দিয়েছেন। তেমনই একটি স্পর্শকাতর ওষুধের নাম অ্যালবুমিন ইঞ্জেকশন, যা মূলত বড় ধরনের অস্ত্রপচার বা গুরুতর আঘাত পরবর্তী চিকিৎসায় রক্তে প্লাজমার পরিমাণ বাড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
বিজ্ঞানবিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকী নেচারে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র ঢাকা শহরে বিক্রি হওয়া অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ ওষুধই নকল, ভেজাল এবং নিম্নমানের। ঢাকার বাইরে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা। অনেক ক্ষেত্রে আটা-ময়দা দিয়ে বানানো নকল বড়ি বা ট্যাবলেট বিক্রির ঘটনাও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এটি বন্ধ করার জন্য যে ধরনের তৎপরতা থাকা প্রয়োজন, সরকারের তরফে সেটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন ভোক্তারা।
এবিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. চঞ্চল কুমার ঘোষ বলছেন, বাজারে এর নকল এতটাই বেড়ে গেছে যে, আমরা এটা দেয়া প্রায় বন্ধই করে দিছি। মূলত অ্যালবুমিন ব্যবহারের পরও বছরখানেক আগে সিলেটে এক রোগীর মৃত্যু এবং ঢাকার বেশকিছু হাসপাতালে রোগীর শরীরে জটিলতা দেখা দেয়ায় ইঞ্জেকশনটি পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। এরপরেই নকলের বিষয়টি নিশ্চিত হন চিকিৎসকরা।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস-প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, এক্ষেত্রে আমরা সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি। যার কারণে কঠোর আইন থাকার পরও বাজারে ভেজাল ও নকল ওষুধের বিক্রি কমছে না।
বিশেষজ্ঞদের জরিপে দেখা গেছে, ভেজাল-নকল ওষুধ মফস্বলে বেশি বিক্রি ও ব্যবহার হচ্ছে। স্বাস্থ্যখাতের গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহর থেকে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত সবখানেই ভেজাল ও নকল ওষুধ ছড়িয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে যেসব ওষুধের চাহিদা এবং দাম বেশি, সেগুলোরই নকল ও ভেজাল বাজারে বেশি দেখা যাচ্ছে।
ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের স্কুল অব মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, গ্যাস্ট্রিক কিংবা অ্যান্টিবায়োটিকের ওষুধ। সারা দেশেই এগুলোর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সে কারণে অসাধু ব্যবসায়িরা সেগুলোর নকল বের করে সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
২০২২ সালে গবেষণাটির প্রধম ধাপের ফলাফলে প্রকাশিত হয়। সেখানে ঢাকায় সংগৃহীত নমুনায় নকল, ভেজাল এবং নিম্নমানের ওষুধের পরিমাণ ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। গবেষণার দ্বিতীয় ধাপে ঢাকার বাইরের জেলাগুলো থেকে গ্যাস্ট্রিক ও অ্যান্টিবায়োটিকে ওই তিন ধরনের ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়েছে। সেখানে ঢাকার থেকে প্রায় দ্বিগুণ, অর্থাৎ প্রায় ২০ শতাংশের মতো নকল, ভেজাল এবং নিম্নমানের ওষুধ পেয়েছেন গবেষকরা। নকল ওষুধের কোনো কোনোটির মধ্যে উপাদান হিসেবে আটা-ময়দাও পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। ফার্মাসিউটিক্যালে আটা-ময়দা দিয়ে বানানো হচ্ছে ট্যাবলেট। বাংলাদেশে যেসব ওষুধের নকল তৈরি হচ্ছে, সেগুলোতে উপাদান হিসেবে আটা-ময়দা, এমনকি সুজি ব্যবহার করার প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকরা।
২০২৪ সালের মার্চে ঢাকা ও বরিশালে অভিযান চালিয়ে আটা, ময়দা এবং সুজি ব্যবহার করে নকল ওষুধ উৎপাদনকারী একটি দলের পাঁচজন সদস্যকে গ্রেফতার করেছিল গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের কাছ থেকে তখন বিভিন্ন ধরনের প্রায় পাঁচ লাখ নকল অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ধার করা হয়। দলটির সদস্যরা প্রায় দশ বছর ধরে নকল ওষুধ তৈরি ও বিক্রি করে আসছিল বলে জানান পুলিশের কর্মকর্তারা।
এ সকল বিষয়ে ভোক্তাদের সংগঠন ক্যাবের ভাইস-প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, নকল ওষুধ উৎপাদনে যেহেতু আসলের মতো খরচ হচ্ছে না, সেকারণে ওষুধগুলো কোম্পানির চেয়ে অনেক কম রেটে (দামে) ফার্মেসিগুলো পেয়ে যাচ্ছে। ফলে বেশি লাভের আশায় তারাও এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক সময় কিছুটা কম দামে পাওয়ার আশায় রোগীরাও নকল ওষুধ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন।
এদিকে বেসরকারি হিসেবে, বাংলাদেশে বর্তমানে আড়াই লাখেরও বেশি ওষুধের দোকান রয়েছে। এসব ফার্মেসির মধ্যে বড় একটা অংশেরই অনুমোদন নেই বলে জানা যাচ্ছে। আবার যেগুলোর অনুমোদন রয়েছে, নজরদারির অভাবে সেগুলোর মধ্যে অনেক ফার্মেসি নিয়ম-নীতি মানছে না বলে জানিয়েছেন তারা।
এব্যাপারে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, টাকা খরচ করে এসব ওষুধ কিনে মানুষ কেবল প্রতারিতই হচ্ছে না, বরং এর ফলে তাদের ভোগান্তি বাড়ছে। এমনকি অনেকে মারাও যাচ্ছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, ভেজাল ও নকল ওষুধ দুইভাবে মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে।
ডা. শরমিন বলেন, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ডা. শাহনূর শরমিন। তাৎক্ষণিক ক্ষতিটা হলো রোগির ভোগান্তি। আটা-ময়না দিয়ে বানানো নকল ওষুধ যেহেতু কাজ করতে পারে না, সেক্ষেত্রে রোগ সারছে না। অন্যদিকে, যেগুলোতে রাসায়নিক উপাদান রয়েছে, সেগুলোর কারণে দীর্ঘ মেয়াদে রোগির শরীরে নতুন নানান স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হতে পারে। আবার গুরুতর অসুস্থ রোগীর ক্ষেত্রে নকল-ভেজাল ওষুধ মৃত্যুরও কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
তিনি বলছেন, এক্ষেত্রে ওষুধে কাজ না হওয়ায় যেমন মৃত্যু হতে পারে, তেমনিভাবে রাসায়নিক উপাদানের প্রতিক্রিয়াতেও সেটি ঘটতে পারে। গত বছর ঢাকার বেশকিছু হাসপাতালে অ্যানেস্থেসিয়া বা চেতনানাশক ওষুধ দেয়ার পর অন্তত তিনটি শিশুর মৃত্যু হয়। পরে চেতনানাশকে ব্যবহৃত হ্যালোথেন পরীক্ষা করে চিকিৎসকরা জানতে পারেন যে, সেগুলোতে ভেজাল ছিল। এ ঘটনার পর দেশের সরকারি-বেসরকারি সকল হাসপাতালে চেতনানাশক ওষুধ হিসেবে হ্যালোথেনের ব্যবহার বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। নকল ও ভেজাল ওষুধের মতো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখা না গেলেও নিম্নমানের ওষুধে দীর্ঘমেয়াদে জনস্বাস্থ্যের বড় ক্ষতি করছে বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা।
অপরদিকে ঢাকায় ওষুধের বড় পাইকারি বাজার মিটফোর্ড এলাকার একজন ওষুধ ব্যবসায়ী বলছেন, স্বাভাবিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় নকল ও ভেজাল ওষুধের উৎপাদন এবং বিক্রি কম দেখা যায়। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে পুলিশ বাহিনীকে আগের মতো সক্রিয় অবস্থায় দেখা যাচ্ছে না। ওষুধ প্রশাসনকেও সেভাবে মাঠে নামতে দেখা যায়নি। এই সুযোগে হেরা আবার ব্যবসা শুরু করছে।
বাংলাদেশ কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতি কার্যালয়ের সচিব আবু হেলা মোস্তফা কামাল বলেন, কিন্তু এখন যতটুকু জানি, এগুলো অনেক কমে গেছে। তারপরও কেউ নকল ওষুধ বিক্রি করছে কি-না, সেটা বোঝা মুশকিল। ধরা না পড়া পর্যন্ত টের পাওয়া যায় না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, নকল ওষুধ বিক্রির ধরন এখন বদলে গেছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ওয়ারি বিভাগের উপকমিশনার মোস্তাক সর্দার বলেন, অতীতে নকল ও ভেজাল ওষুধ কারকারিদের যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই ধরা পড়েছেন গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। কিন্তু নতুন চক্রটির ব্যাপারে এখনও কোনো তথ্য আমার জানা নেই। বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখবো।
২০২৩ সালে পাস হওয়া ওষুধ ও কসমেটিক আইনে নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। গত দুই বছরে নকল ওষুধ কারবারিদের মধ্যে কয়েকজন ধরাও পড়েছে। কিন্তু কাউকেই যাবজ্জীবন সাজা দিতে দেখা যায়নি। ক্যাবের নেতা এস এম নাজের হোসাইন বলেন, উল্টো দেখা যাচ্ছে, যারা ধরা পড়ছেন তারাও কয়েক মাসের মধ্যে ছাড়া পেয়ে পুনরায় ব্যবসা শুরু করেছে। কারণ তারা দেখেছে যে, শাস্তি হয় না।
নকল ও ভেজাল ওষুধের মামলায় সাজা না হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আসরাফ হোসেন বলেন, এটা আদালতের ব্যাপার, আমাদের হাতে নেই। তবে বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন যে, তদন্তে গাফিলতি থাকার কারণে অনেক সময় দোষী ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া যাচ্ছে না।
উল্লেখ্য যে, ২০০৯ সালে দেশের একটি কোম্পানির প্যারাসিটামল সিরাপ পান করে অন্তত ২৮টি শিশুর মৃত্যু হয়। ঘটনার পর ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। কিন্তু তদন্তের সময় আদালতে প্যারাসিটামল সিরাপের যে নমুনা জমা দেওয়া হয়েছিল, সেটি সরাসরি ওই কারখানা থেকে জব্দ না করায় কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। সে সময় সরকারি আইনজীবীদের কথায় তদন্তের সেই দুর্বলতার কথা প্রকাশ পেয়েছিল।