তৈরি পোশাক শিল্প ধ্বংসে দেশী-বিদেশী চক্রান্ত
- আপডেট সময় : ০৯:৩০:৩৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ অক্টোবর ২০২৪ ৯৭ বার পড়া হয়েছে
– সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা
– আন্দোলন নিরসনে বিজিএমইএ ব্যর্থতা
– ব্যবসায়ীদের ব্যাংকের অসহযোগিতা
– অডিট নিয়ে কাস্টমসের হয়রানি
– শ্রমিক সংগঠনের নামে দলীয় চাঁদাবাজি
– আস্থার সংকটে বিদেশী ক্রয়াদেশ কমে যাচ্ছে
– অস্থিরতার সুযোগে প্রতিযোগী দেশ লাভবান
সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে শুরু হওয়া আন্দোলনে সংঘাত সহিংসতা ও সরকার পতনের কারণে ১৮ জুলাই থেকে তৈরি পোশাক শিল্পে এমনিতেই উৎপাদন ব্যাহত ছিল, সরকার পতনের পর শ্রমিকদের লাগাতার আন্দোলনে পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান এই খাতটি নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সার্বিক প্রেক্ষাপটে পোশাক শিল্প ধ্বংসে দেশী-বিদেশী চক্রান্ত ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
সরকারের নানামুখী উদ্যোগ সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ঘাটতি, ঝুট ব্যবসার, কারখানার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার তৎপরতা, বেতন ভাতা সংক্রান্ত সমস্যা এবং বাইরের ইন্ধনসহ বিভিন্ন কারণে পোশাক কারখানাগুলোতে অস্থিরতা যেন থামছেই না। পোশাকশিল্পের সাম্প্রতিক অস্থিরতা নিরসনের লক্ষ্যে চারজন উপদেষ্টার সমন্বয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের একাধিক দল মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন করে। পরে শ্রমিকনেতা ও পোশাকশিল্পের মালিকপক্ষের সঙ্গে একাধিক বৈঠকের মাধ্যমে ১৮ দফা দাবি পূরণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তার পরেও একের পর এক প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা রাস্তায় আন্দোলনে নামে। শ্রমিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষের সময় এক শ্রমিকের মৃত্যুও হয়। আহত হয় প্রায় অর্ধশতাধিক।
আশুলিয়া এলাকায় এখনও ২৫-৩০টি কারখানা বন্ধ রয়েছে। প্রতিদিনই আন্দোলনের নামে অস্থিরতাসহ জনদুর্ভোগ তৈরি করা হচ্ছে। গতকাল রোববার সাভারের আশুলিয়ায় বহিরাগতদের হামলা ও মারধরে এক পোশাক শ্রমিক গুরুতর আহত হলে। এ ঘটনার প্রতিবাদে উত্তেজিত শ্রমিকরা ওই কারখানা ভাঙচুরসহ এক স্টাফকে মারধর করে। শিল্প পুলিশ জানায়, সকালে নিশ্চিন্তপুর এলাকার আল-মুসলিম অ্যাপারেলস নামক তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবে কাজে যোগ দেন। এর এক ঘণ্টা পরে শ্রমিকরা জানতে পারেন কারখানার এক শ্রমিককে বহিরাগতরা মারধর করেছে। এর প্রতিবাদে কারখানার শ্রমিকরা বিচারের দাবিতে কর্মবিরতি পালন শুরু করে। একপর্যায়ে উত্তেজিত পোশাক শ্রমিকরা কারখানার এক স্টাফকে মারধর করে এবং কারখানা ভাঙচুর করে।
হঠাৎ করেই তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষের কারন অনুসন্ধান করতে গিয়ে পাওয়া যায় চাঞ্চল্যকর তথ্য। ক্ষমতার পালাবদলে ঝুট ব্যবসা দখল ও স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাদের অনুসারীদের মাধ্যমে নৈরাজ্যসৃষ্টি করে বর্তমান সরকারকে বেকায়দায় ফেলার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। শ্রমিক সংগঠনের নেতারাও বলছে, একই কথা। তারা বলেন, ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিতে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় অস্থিরতা সৃষ্টি করছে একটি চক্র। যারা বিগত সরকারের (আওয়ামীলীগ) আমলেও এই ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেছে। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বহিরাগতদের ভাড়া করে তারাই পোশাক খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। শ্রমিক নেতারা বলেন, আন্দোলনকারী শ্রমিকরা যেসকল দাবি দাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ করেছে তার কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে যে হামলাকারীরা শ্রমিকদের উস্কে দিচ্ছে তারা স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাদের অনুসারী।
মালিক পক্ষ বলছেন, পোশাক শিল্পে অস্থিরতা আগেও ছিল, তবে কখনই এতো দীর্ঘায়িত হয়নি। অবশ্যই এদের পেছনে ইন্ধন রয়েছে। একটি মহল শ্রমিক অসন্তোষের নামে দেশের অর্থনীতিকে ধূলিস্মাৎ করতে চায়। তারা বলেন, পোশাক শিল্পে এসে অনেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেনি, বিদেশে টাকা পাচার করেছে। গার্মেন্টস বন্ধ থাকলে তাদের কোন সমস্যা হবে না। সমস্যায় পড়বে সত্যিকারের মালিকরা।
চলমান শ্রমিক আন্দোলন মোকাবিলা এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে পোশাক খাতের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বোঝাতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পরিচালনা বোর্ড এমন অভিযোগ করেন পোশাক শিল্পর মালিকরা। তারা বলেন, এ শিল্পকে ধ্বংস করতে একটি গোষ্ঠী কলকাঠি নাড়ছে, বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তারপরও সরকারের কাছে তারা শিল্পের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরছে না এবং বিদেশি ক্রেতাদের আস্থায় আনতে উদ্যোগ নিচ্ছে না। যেভাবে প্রতিনিয়ত আন্দোলন হচ্ছে এভাবে চলতে থাকলে এই আন্দোলন শুধু সাভার আশুলিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। একটা সময় দেখা যাবে পুরো দেশেই ছড়িয়ে গেছে। এখনই সময় নিয়ন্ত্রণ আনার।
পোশাক শিল্পের মালিকরা অভিযোগ করে বলেন, পদে পদে ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়রানি করছে কাস্টর্মস কর্তৃপক্ষ। সবকিছু অনলাইনে হচ্ছে তার পরেও তাদের কাছে যেতে হচ্ছে। অডিটের নামে ফাইল আটকে রাখা হয়। পরে লবিং করে ফাইল ছাড়াতে হয়। এভাবে কতদিন লভিং করে ব্যবসা করব। এই নীতি পরিবর্তনের দাবি করেন তারা। শুধু অডিটই নয় ব্যাংক সেক্টরেও তাদের অসহযোগিতা করার অভিযোগ তোলেন।
শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে মালিকপক্ষ বলছেন, আমাদের শ্রমিকরা শান্তিপ্রিয়। মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক অতুলনীয়। এখন বহিরাগত একটি চক্র গার্মেন্টস শিল্প ধ্বংস করার পাঁয়তারা শুরু করেছে। প্রশাসন সরকার ঠেকানোর জন্য যেই ভূমিকা নিয়েছিল, সেই ভূমিকা এখন নেওয়া উচিত দেশ গড়ার জন্য। তাহলে সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। প্রশাসন কেন চুপ আছে? তখন তো প্রশাসন রাস্তায় নেমে গুলি ছুড়েছে, আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করতে লাঠিপেটা করেছে। সেই ভূমিকা নিয়ে দেশ গড়তে আবার তাদের মাঠে নামা উচিত। এখন ষড়যন্ত্রের মধ্যে পড়ে গেছি। ৫০-৬০টা লোক এসে ভাংচুর চালিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা হা করে তাকিয়ে দেখছি।
দেশে চলমান শ্রমিক অসন্তোষে চরম বিপাকে দেশের অন্যতম রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প। চলমান অস্থিরতায় একদিকে যেমন আর্থিক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে, পাশাপাশি দেশি-বিদেশি ক্রেতা হারাচ্ছেন শিল্পমালিকরা। তবে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে থাকলেও এই অস্থিরতার সুযোগে বিদেশি অর্ডার লুফে নিচ্ছেন প্রতিযোগী দেশগুলো।
বিজিএমইএ’র তথ্যে, দেশে ৪৫০০ কারখান রয়েছে, যেখানে ৪৫ লক্ষ শ্রমিক কাজ করে। এই শিল্পে নারী শ্রমিক রয়েছে ২৫ লক্ষ। পোশাক শিল্পে ৫০ বিলিয়ন ডলার বাজার রয়েছে। এখান থেকে ৮৫% রপ্তানি আয় হয়। এই সেক্টরের সাথে ৩ কোটি পরিবার জড়িত রয়েছে। এ খাতকে যদি ক্ষতি করা তবে বাংলাদেশের অর্থনীতিই ওলটপালট হয়ে যাবে।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, সরকার চায় গার্মেন্টস মালিকরা শান্তিতে ব্যবসা করুক। প্রধান উপদেষ্টা পোশাক খাত নিয়ে ভিশন বিচলিত, সমাধান খুজছেন। চলমান পরিস্থিতিতে বায়ারদের আস্থায় আনা ভীষণ জরুরি। প্রধান উপদেষ্টা বিদেশি বায়ারদের সাথেও আলোচনায় বসতে রাজি আছেন। ওনার মতো বিশ্ব বরেণ্য মানুষকে ব্যবহার করতে না পারলে আমাদের (বিজিএমইএ) ব্যর্থতা। এছাড়া এক্সিট পলিসি নিয়ে কাজ করারও এখন উপযুক্ত সময় বলে জানান তিনি।