ঢাকা ০৯:৫১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০১ জুন ২০২৫

নির্বাচনের আগেই শাস্তির আওতায় শীর্ষ সন্ত্রাসিরা

বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট সময় : ০১:৩৩:৫৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩১ মে ২০২৫ ১০ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি
  • রাজধানীতে তিন খুনের পেছনে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী

  • সব বাহিনীর তৎপরতা আরও বাড়ানোর তাগিদ

নির্বাচনের আগে এসব শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীদের আইনের আওতায় আনতে না পারলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে মত বিশ্লেষকদের। সম্প্রতি বেশ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তারে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও বাহিনীগুলোর তৎপরতা আরও বাড়ানোর তাগিদ অপরাধ বিশ্লেষকদের।
একাধিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেছেন, রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডের কিলার গ্রুপগুলোর সদস্যরা আধিপত্য বিস্তার, মাদক পাচার, অস্ত্র চোরাচালান, খুন, রাহাজানি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে এমন কোন অপরাধ নেই, যার সঙ্গে এই ধরনের অপরাধী-সন্ত্রাসীরা যুক্ত নয়। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে চলে আসায় নিয়ন্ত্রণ করছে টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বিদেশ থেকে দেশে চলে এসেছে আবার অনেকই জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে এখন নিয়ন্ত্রণ করছে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডসহ সারাদেশের অপরাধমূলক কর্মকান্ড। তাদের রয়েছে একাধিক কিলার গ্রুপ, যারা খুন করতে সিদ্ধহস্ত। সম্প্রতি রাজধানীতে বেশ কটি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ সকল ঘটনার পেছনে জেল থেকে ছাড়া পাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসিদের নাম এসেছে। শুধু তাই নয়, বিশেষ কওে বাড্ডায় ইন্টারনেট ও ক্যারল ব্যবসার আধিপত্যের লড়াইয়ে ৩ জন খুন হয়েছে। এ সকল হত্যাকান্ডের পেছনে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রীদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের আগে এসকল শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রেফতার এবং অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার প্রয়োজন। তা না হলে নির্বাচনে পরিস্থিতি আরো বেশী ঘোলাটে হতে পারে।
অপরদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পুলিশের তালিকাভুক্ত দাগি ও শীর্ষ সন্ত্রাসীরা ফিরে আসতে শুরু করেছেন। তাদের কেউ কেউ জামিনে বা সাজার মেয়াদ শেষে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছেন; দীর্ঘদিন দেশে-বিদেশে গা-ঢাকা দেওয়া সন্ত্রাসীরাও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যে বেরিয়ে এসে অপরাধ ও চাঁদাবাজি করছেন এবং অপরাধ সাম্রাজ্যের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এতে প্রতিপক্ষের সঙ্গে তাদের বিরোধ ঘটছে এবং সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীরা দেশের ফেরায় কিংবা আদালত থেকে ছাড়া পাওয়ায় আতঙ্ক দেখা দিয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
বিষয়টি নিয়ে পুলিশের উচ্চপর্যায়েও আলোচনা চলছে। পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সন্ত্রাসীদের ফিরে আসার বিষয়টি স্বীকার করে বলছেন, গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়ে এবং জেল প্যারেড কার্যক্রম জোরদার করে এ ধরনের আসামি শীর্ষ ও দাগি সন্ত্রাসীদের নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘কিছু তালিকাভুক্ত দাগি ও শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজার মেয়াদ শেষে কারাগার থেকে বের হয়েছেন। কিছু সন্ত্রাসী বিদেশে থেকে ফেরত এসেছেন, আমরা এমন তথ্যও পেয়েছি। গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়িয়ে আমরা তাদের বিষয়ে খোঁজখবর রাখছি। এ ব্যাপারে গোয়েন্দা পুলিশসহ পুলিশের সব ইউনিট তৎপর আছে। কেউ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব। আমরা কাউকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে দেব না।
সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন মগবাজারের আতঙ্ক হিসেবে পরিচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী রাসু। ইতোমধ্যে ২০ বছর জেল খেটে জামিনে বেরিয়ে এসেছেন ঝিগাতলা, ধানমন্ডি ও কামরাঙ্গীরচরের কথিত ‘ক্যাপ্টেন’ তারেক সাঈদ ওরফে মামুন। তিনি চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী, সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই সাঈদ আহমেদ টিপু, আদালত চত্বরে আইনজীবী মোর্শেদ হত্যা মামলা, বহুল আলোচিত হিমেল ও রহিম হত্যা মামলাসহ বেশ কয়েকটি হত্যা মামলার চার্জশিট এবং সাজাভুক্ত আসামি। গত সোমবার রাতে তেজগাঁওয়ে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ফিল্মি স্টাইলে হামলা হয়। ইতোমধ্যেই পুলিশ জানতে পেরেছে, একাধিক শীর্ষ সন্ত্রাসী এই হামলার সঙ্গে জড়িত।
ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী, এনডিসি বলেছেন, ছিনতাইকারী ও চাঁদাবাজদের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করতে হবে। শীর্ষ সন্ত্রাসী, ঝুট ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণকারী, ছিনতাইকারী ও চাঁদাবাজদের গ্রেফতার করতে হবে। ডিএমপির থানাগুলোকে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। দায়িত্ববোধ ও আগ্রহ থেকে সকলকে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হবে। সকলে সম্মিলিতভাবে কাজ করলে পুলিশের প্রতি জনগণের পূর্ণ আস্থা ফিরে আসবে। মামলা তদন্তে অগ্রগতি আরো বাড়াতে হবে। থানায় জিডি করার এক ঘন্টার মধ্যে রেসপন্স করতে হবে এবং সে সংক্রান্তে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করতে হবে। জিডি তদন্তের ক্ষেত্রে কোন প্রকার বিলম্ব করা যাবে না।
আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের পরিচালক (আইএসপিআর) লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি-উদ-দৌলা চৌধুরী বলেন, সেনাবাহিনী প্রধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনার আলোকে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং জনগণের জানমালের সুরক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ প্রস্তুত এবং প্রতিশ্রুতবদ্ধ।
সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, সেনাবাহিনী করল এটা ইতিবাচক। এটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কারণ পুলিশ আদৌ পারত কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এই জায়গায় পুলিশের এবং পুলিশের যে অন্যান্য ইউনিটগুলো আছে তাদের ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে। তাদের ঘাটতিগুলো কোথায়, কিভাবে অভিযান পরিচালনা করে শীর্ষ পর্যায়ের সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার এবং আইনের মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যার্থতা কোথায়?’
আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, অপরাধ দমনে আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের সততা দিয়ে কাজ করতে হবে ও ন্যায়ের পথে থাকতে হবে। চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও খুন বন্ধ করতে আমাদের শতভাগ চেষ্টা করতে হবে। সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার, চাঁদাবাজি ও মাদকসহ সকল অপরাধ দমন করতে হবে। সেক্ষেত্রে যদি কোন প্রতিকূলতা থাকে সেটি মোকাবেলা করে আমাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানী ছাড়াও চট্টগ্রাম, খুলনা, কক্সবাজার, যশোর ও রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে থাকা দাগি সন্ত্রাসীরা দেশে ফিরছেন। গোপীবাগ-মতিঝিলের আতঙ্ক হিসেবে পরিচিত নাসির উদ্দিন ২৩ বছর পর ইতালি থেকে ফেরত এসেছেন। আন্ডারগ্রাউন্ড সন্ত্রাসীদের কাছে তিনি ‘গোপীবাগের বস’ হিসেবে পরিচিত। দেশে ফিরেছেন শাহজাহানপুরের সন্ত্রাসী সোহেল শাহরিয়ার ওরফে শটগান সোহেল। অভিযোগ, দেশে ফেরার পর তার পরিকল্পনাতেই মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুর রহমান টিপু খুন হয়েছেন। এই হত্যা মামলার পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নকারী হিসেবে চার্জশিটে তার নাম রয়েছে। এই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এখন তিনি কারাগারে আছেন।
এ ছাড়া মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাতের সহযোগী লাক্কু, মিরপুরের তালিকাভুক্ত দাগি সন্ত্রাসী খোরশেদের সহযোগী হেলাল, দুলুসহ একাধিকজন, ফার্মগেট তেজগাঁওয়ের আশিক বাহিনীর কয়েকজন সদস্য, যাত্রাবাড়ীর রোজেন গ্রুপের চুই উজ্জ্বলসহ কয়েকজন সদস্য, যাত্রাবাড়ীর ইয়াসিন উদ্দিন লিটন ওরফে লিটন আকন্দ ওরফে শুটার লিটন, কামরাঙ্গীরচরের নূরুজ্জামান বাবু, মোহাম্মদপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সহযোগী মাজহারুল ইসলাম শাকিলসহ অনেকেই বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার র‌্যাব-পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে রয়েছেন।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, সরকার ঘোষিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ বেশ কিছু সন্ত্রাসীর নাম ব্যবহার করে এখনও ঢাকা এবং আশপাশের এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি, দখল ও টেন্ডারবাজি চলছে। এদের মধ্যে অনেকে ক্রসফায়ারে বা অন্য কোনোভাবে মারা গেছেন। অনেকে কারাগারে এবং কয়েকজন বিদেশে। তারা কারাগার ও বিদেশে বসেই অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। শীর্ষ সন্ত্রাসীর বাইরেও কিছু দাগি সন্ত্রাসী র‌্যাব-পুলিশের অভিযানের কারণে অবৈধ পথে বিদেশে চলে যান। নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন মহলের গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে তারা দেশে ফিরে আসার তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে গত মঙ্গলবার কুষ্টিয়ায় অভিযান চালিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন আর মোল্লা মাসুদকে গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী। একই সময়ে হাতিরঝিল থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তার ২ সহযোগীকে। মোহাম্মদপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ঐ এলাকার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী এক্স এল বাবুকেও। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী কঠোর অবস্থায় থাকবে বলে হুঁশিয়ার করেছে বাহিনীটি। গত দুই মাসে রাজধানীতে তিনটি খুনের ঘটনার নেপথ্যে নাম এসেছে তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের। অন্তত আটটি স্থানে হামলা, দখল ও চাঁদাবাজির ঘটনাতেও শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীদের জড়িত থাকার তথ্য দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সম্প্রতি বেশ কজন ধরা পড়লেও নির্বাচনের দিন ঠিক হলে এসব সন্ত্রাসীদের তৎপরতা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা অপরাধ বিশ্লেষকদের।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

নির্বাচনের আগেই শাস্তির আওতায় শীর্ষ সন্ত্রাসিরা

আপডেট সময় : ০১:৩৩:৫৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩১ মে ২০২৫
  • রাজধানীতে তিন খুনের পেছনে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী

  • সব বাহিনীর তৎপরতা আরও বাড়ানোর তাগিদ

নির্বাচনের আগে এসব শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীদের আইনের আওতায় আনতে না পারলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে মত বিশ্লেষকদের। সম্প্রতি বেশ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তারে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও বাহিনীগুলোর তৎপরতা আরও বাড়ানোর তাগিদ অপরাধ বিশ্লেষকদের।
একাধিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেছেন, রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডের কিলার গ্রুপগুলোর সদস্যরা আধিপত্য বিস্তার, মাদক পাচার, অস্ত্র চোরাচালান, খুন, রাহাজানি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে এমন কোন অপরাধ নেই, যার সঙ্গে এই ধরনের অপরাধী-সন্ত্রাসীরা যুক্ত নয়। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে চলে আসায় নিয়ন্ত্রণ করছে টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বিদেশ থেকে দেশে চলে এসেছে আবার অনেকই জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে এখন নিয়ন্ত্রণ করছে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডসহ সারাদেশের অপরাধমূলক কর্মকান্ড। তাদের রয়েছে একাধিক কিলার গ্রুপ, যারা খুন করতে সিদ্ধহস্ত। সম্প্রতি রাজধানীতে বেশ কটি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ সকল ঘটনার পেছনে জেল থেকে ছাড়া পাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসিদের নাম এসেছে। শুধু তাই নয়, বিশেষ কওে বাড্ডায় ইন্টারনেট ও ক্যারল ব্যবসার আধিপত্যের লড়াইয়ে ৩ জন খুন হয়েছে। এ সকল হত্যাকান্ডের পেছনে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রীদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের আগে এসকল শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রেফতার এবং অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার প্রয়োজন। তা না হলে নির্বাচনে পরিস্থিতি আরো বেশী ঘোলাটে হতে পারে।
অপরদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পুলিশের তালিকাভুক্ত দাগি ও শীর্ষ সন্ত্রাসীরা ফিরে আসতে শুরু করেছেন। তাদের কেউ কেউ জামিনে বা সাজার মেয়াদ শেষে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছেন; দীর্ঘদিন দেশে-বিদেশে গা-ঢাকা দেওয়া সন্ত্রাসীরাও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যে বেরিয়ে এসে অপরাধ ও চাঁদাবাজি করছেন এবং অপরাধ সাম্রাজ্যের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এতে প্রতিপক্ষের সঙ্গে তাদের বিরোধ ঘটছে এবং সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীরা দেশের ফেরায় কিংবা আদালত থেকে ছাড়া পাওয়ায় আতঙ্ক দেখা দিয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
বিষয়টি নিয়ে পুলিশের উচ্চপর্যায়েও আলোচনা চলছে। পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সন্ত্রাসীদের ফিরে আসার বিষয়টি স্বীকার করে বলছেন, গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়ে এবং জেল প্যারেড কার্যক্রম জোরদার করে এ ধরনের আসামি শীর্ষ ও দাগি সন্ত্রাসীদের নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘কিছু তালিকাভুক্ত দাগি ও শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজার মেয়াদ শেষে কারাগার থেকে বের হয়েছেন। কিছু সন্ত্রাসী বিদেশে থেকে ফেরত এসেছেন, আমরা এমন তথ্যও পেয়েছি। গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়িয়ে আমরা তাদের বিষয়ে খোঁজখবর রাখছি। এ ব্যাপারে গোয়েন্দা পুলিশসহ পুলিশের সব ইউনিট তৎপর আছে। কেউ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব। আমরা কাউকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে দেব না।
সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন মগবাজারের আতঙ্ক হিসেবে পরিচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী রাসু। ইতোমধ্যে ২০ বছর জেল খেটে জামিনে বেরিয়ে এসেছেন ঝিগাতলা, ধানমন্ডি ও কামরাঙ্গীরচরের কথিত ‘ক্যাপ্টেন’ তারেক সাঈদ ওরফে মামুন। তিনি চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী, সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই সাঈদ আহমেদ টিপু, আদালত চত্বরে আইনজীবী মোর্শেদ হত্যা মামলা, বহুল আলোচিত হিমেল ও রহিম হত্যা মামলাসহ বেশ কয়েকটি হত্যা মামলার চার্জশিট এবং সাজাভুক্ত আসামি। গত সোমবার রাতে তেজগাঁওয়ে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ফিল্মি স্টাইলে হামলা হয়। ইতোমধ্যেই পুলিশ জানতে পেরেছে, একাধিক শীর্ষ সন্ত্রাসী এই হামলার সঙ্গে জড়িত।
ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী, এনডিসি বলেছেন, ছিনতাইকারী ও চাঁদাবাজদের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করতে হবে। শীর্ষ সন্ত্রাসী, ঝুট ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণকারী, ছিনতাইকারী ও চাঁদাবাজদের গ্রেফতার করতে হবে। ডিএমপির থানাগুলোকে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। দায়িত্ববোধ ও আগ্রহ থেকে সকলকে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হবে। সকলে সম্মিলিতভাবে কাজ করলে পুলিশের প্রতি জনগণের পূর্ণ আস্থা ফিরে আসবে। মামলা তদন্তে অগ্রগতি আরো বাড়াতে হবে। থানায় জিডি করার এক ঘন্টার মধ্যে রেসপন্স করতে হবে এবং সে সংক্রান্তে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করতে হবে। জিডি তদন্তের ক্ষেত্রে কোন প্রকার বিলম্ব করা যাবে না।
আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের পরিচালক (আইএসপিআর) লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি-উদ-দৌলা চৌধুরী বলেন, সেনাবাহিনী প্রধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনার আলোকে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং জনগণের জানমালের সুরক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ প্রস্তুত এবং প্রতিশ্রুতবদ্ধ।
সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, সেনাবাহিনী করল এটা ইতিবাচক। এটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কারণ পুলিশ আদৌ পারত কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এই জায়গায় পুলিশের এবং পুলিশের যে অন্যান্য ইউনিটগুলো আছে তাদের ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে। তাদের ঘাটতিগুলো কোথায়, কিভাবে অভিযান পরিচালনা করে শীর্ষ পর্যায়ের সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার এবং আইনের মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যার্থতা কোথায়?’
আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, অপরাধ দমনে আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের সততা দিয়ে কাজ করতে হবে ও ন্যায়ের পথে থাকতে হবে। চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও খুন বন্ধ করতে আমাদের শতভাগ চেষ্টা করতে হবে। সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার, চাঁদাবাজি ও মাদকসহ সকল অপরাধ দমন করতে হবে। সেক্ষেত্রে যদি কোন প্রতিকূলতা থাকে সেটি মোকাবেলা করে আমাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানী ছাড়াও চট্টগ্রাম, খুলনা, কক্সবাজার, যশোর ও রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে থাকা দাগি সন্ত্রাসীরা দেশে ফিরছেন। গোপীবাগ-মতিঝিলের আতঙ্ক হিসেবে পরিচিত নাসির উদ্দিন ২৩ বছর পর ইতালি থেকে ফেরত এসেছেন। আন্ডারগ্রাউন্ড সন্ত্রাসীদের কাছে তিনি ‘গোপীবাগের বস’ হিসেবে পরিচিত। দেশে ফিরেছেন শাহজাহানপুরের সন্ত্রাসী সোহেল শাহরিয়ার ওরফে শটগান সোহেল। অভিযোগ, দেশে ফেরার পর তার পরিকল্পনাতেই মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুর রহমান টিপু খুন হয়েছেন। এই হত্যা মামলার পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নকারী হিসেবে চার্জশিটে তার নাম রয়েছে। এই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এখন তিনি কারাগারে আছেন।
এ ছাড়া মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাতের সহযোগী লাক্কু, মিরপুরের তালিকাভুক্ত দাগি সন্ত্রাসী খোরশেদের সহযোগী হেলাল, দুলুসহ একাধিকজন, ফার্মগেট তেজগাঁওয়ের আশিক বাহিনীর কয়েকজন সদস্য, যাত্রাবাড়ীর রোজেন গ্রুপের চুই উজ্জ্বলসহ কয়েকজন সদস্য, যাত্রাবাড়ীর ইয়াসিন উদ্দিন লিটন ওরফে লিটন আকন্দ ওরফে শুটার লিটন, কামরাঙ্গীরচরের নূরুজ্জামান বাবু, মোহাম্মদপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সহযোগী মাজহারুল ইসলাম শাকিলসহ অনেকেই বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার র‌্যাব-পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে রয়েছেন।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, সরকার ঘোষিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ বেশ কিছু সন্ত্রাসীর নাম ব্যবহার করে এখনও ঢাকা এবং আশপাশের এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি, দখল ও টেন্ডারবাজি চলছে। এদের মধ্যে অনেকে ক্রসফায়ারে বা অন্য কোনোভাবে মারা গেছেন। অনেকে কারাগারে এবং কয়েকজন বিদেশে। তারা কারাগার ও বিদেশে বসেই অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। শীর্ষ সন্ত্রাসীর বাইরেও কিছু দাগি সন্ত্রাসী র‌্যাব-পুলিশের অভিযানের কারণে অবৈধ পথে বিদেশে চলে যান। নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন মহলের গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে তারা দেশে ফিরে আসার তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে গত মঙ্গলবার কুষ্টিয়ায় অভিযান চালিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন আর মোল্লা মাসুদকে গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী। একই সময়ে হাতিরঝিল থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তার ২ সহযোগীকে। মোহাম্মদপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ঐ এলাকার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী এক্স এল বাবুকেও। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী কঠোর অবস্থায় থাকবে বলে হুঁশিয়ার করেছে বাহিনীটি। গত দুই মাসে রাজধানীতে তিনটি খুনের ঘটনার নেপথ্যে নাম এসেছে তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের। অন্তত আটটি স্থানে হামলা, দখল ও চাঁদাবাজির ঘটনাতেও শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীদের জড়িত থাকার তথ্য দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সম্প্রতি বেশ কজন ধরা পড়লেও নির্বাচনের দিন ঠিক হলে এসব সন্ত্রাসীদের তৎপরতা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা অপরাধ বিশ্লেষকদের।