পরিবারগুলো আছে বিপদে

- আপডেট সময় : ২৭ বার পড়া হয়েছে
চালের বাজারমূল্য নিয়ে এখন বিপদে মধ্যবিত্তরাও। সরকারের দেয়া সহায়তাও পায় না তারা, আবার বেশি দামের কারণে বাজার থেকে কিনে খাওয়ারও সামর্থ্য কমে যাচ্ছে। ফলে চালের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে কঠিন সময় পার করছেন তারা। কারণ, বাম্পার উৎপাদনের পরও কোনোওভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না চালের বাজার। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, নিম্নবিত্তরা সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় সরকারের দেয়া ১৫ টাকা ও ৩০ টাকা কেজি দরে প্রতিমাসে ৩০ কেজি করে চাল পাচ্ছেন। আবার ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবি’র মাধ্যমেও দেশের ৫৪ লাখ পরিবারকে প্রতিমাসে ৩০ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো আপাতত চাল নিয়ে কোনও সমস্যায় নেই বলে জানা গেছে। বিপদে আছে দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। সীমিত আয়ের কারণে রাজধানীসহ দেশের শহরগুলোতে বসবাসরত নাগরিকদের জন্য সংসারের বাধ্যতামূলক খরচগুলো মিটিয়ে বাড়তি দামে চাল কেনা অনেকটাই কষ্টসাধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কথা বলে জানা গেছে, চার সদস্যের পরিবার নিয়ে রাজধানীর বাসাবোতে ভাড়া বাসায় থাকেন আফজাল হোসেন। চাকরি করেন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মধ্যম সারির পদে। মন্দ না হলেও আয় কিন্তু সীমিত। এর মধ্য দিয়েই চলছিল তাদের চারজনের পরিবার। দুই বছর আগেও তার সন্তানদের জন্য স্কুলের খরচ ছিল না। কিন্তু এ বছর থেকে দুই সন্তানকেই স্কুলে দিয়েছেন। এরই মধ্যে বেড়েছে বাসা ভাড়া। যুক্ত হয়েছে দুই সন্তানের স্কুলের খরচ। বেড়েছে সংসারের প্রয়োজনীয় অন্যান্য সব পণ্যের দামও। এর ওপর যোগ হয়েছে চালের বাড়তি দাম। মোটামুটি মানের চালের কেজি ৬৫ টাকা। যা এক প্রকারের চাপ বলে অনুভব করছেন তিনি।
জানতে চাইলে আফজাল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, চালের দামের সঙ্গে সংসারের অন্যান্য নিত্যপণ্যের দামের একটা অলিখিত সম্পর্ক রয়েছে। চালের দাম বাড়লে শাক-সবজি, তেল, ডাল, মরিচ, লবণসহ সংসারের সব পণ্যের দাম বাড়ে। উৎপাদন এবং সরবরাহে কোনও ধরনের জটিলতা বা সমস্যা না থাকলেও গত এক বছর ধরে বাজারে চালের দাম লাগামহীন। কোনোওভাবেইে নিয়ন্ত্রণে আসছে না চালের বাজার। ক্রমশই বেড়ে চলছে। ৬৫ টাকা কেজি দরের নিচে খাওয়ার জন্য মোটামুটি মানের কোনও চাল এখন আর পাওয়া যায় না। যে চাল পাওয়া যায় সে চালে গন্ধ। ছেলেমেয়েরা খেতে চায় না। আমরা যারা মধ্যবিত্ত পরিবার তারা বিষয়টি নিয়ে খুব অস্বস্তিতে আছি।
তিনি বলেন, নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নানাবিধ সহায়তা পাওয়ার সুযোগ থাকলেও সমাজের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো কিন্তু বিপদে আছে, যা কাউকে বোঝানো যায় না। তারা লাইনে দাঁড়াতেও পারে না, আবার বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতেও পারে না। সমাজের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো এখন এক ধরনের চাপা কষ্টে দিন পার করছে।
বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চালের এই লাগামহীন বাজার পরিস্থিতির জন্য কেউই দায় নিতে চাচ্ছেন না। উৎপাদনকারী, মিলার, ডিলার, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা একে অপরের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। কৃষকরা বলছেন, চালের দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। মিলাররা দায় চাপাচ্ছেন পাইকারি ব্যবসায়ীদের ঘাড়ে। আর পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, চালের দাম বাড়ছে খুচরা পর্যায়ে। অন্যদিকে এজেন্টরা বলছেন, উৎপাদক কোম্পানির নির্ধারিত কমিশনের অতিরিক্ত দামে চাল বিক্রির সুযোগ নেই।
রাজধানীর কয়েকটি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েক মাস ধরে রাজধানীর খুচরা বাজারে বিক্রেতারা প্রতিকেজি মিনিকেট চাল ৭২ থেকে ৭৮ টাকা, নাজিরশাইল ৭৫ থেকে ৭৮ টাকা, বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ চাল ৬০ থেকে ৬৬ টাকায় বিক্রি করছেন। মোটা চাল প্রতিকেজি ৫৬ টাকা এবং মোটা হাইব্রিড চাল প্রতিকেজি ৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ কোরবানির ঈদের আগেও এসব চাল খুচরা বাজারে দুই থেকে তিন টাকা কমে বিক্রি হয়েছে।
এদিকে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চালের দাম বৃদ্ধির কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অবৈধ মজুতদারি, যা সরবরাহে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। এছাড়াও, মধ্যস্বত্বভোগীদের অতিরিক্ত লাভ, অস্পষ্ট কারণ ও বাজারের নিয়ন্ত্রণের অভাব এবং বিশ্ববাজারে দামের তুলনায় দেশীয় বাজারে দাম বৃদ্ধি।
চালের বাজার অস্থির হয়ে ওঠার মূল কারণগুলো মধ্যে রয়েছে, মজুতদারি। কারণ, ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়ানোর জন্য অবৈধভাবে চাল মজুত করে রাখে, ফলে বাজারে সরবরাহের ঘাটতি দেখা দেয়। মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব। কৃষক পর্যায়ে ধান সংগ্রহের পর পাইকার এবং তারপর মিলারদের হাতে বিভিন্ন ধাপে দাম বাড়তে থাকে। এই মধ্যস্বত্বভোগীরা তাদের লাভের অংশ যুক্ত করে বাজারমূল্য বৃদ্ধি করে। মজুতের অভাব। সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত উৎপাদন ও সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও চালের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থায় অস্বচ্ছতা নির্দেশ করে। বিশ্ববাজারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যতা। বিশ্ববাজারে চালের দাম কমে এলেও বাংলাদেশের বাজারে দাম বাড়ছে, যা অভ্যন্তরীণ বাজারের অসামঞ্জস্যতা ও অদক্ষতাকে নির্দেশ করে। ভোক্তাদের ওপর প্রভাব। বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার কারণে ভোক্তাদের, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে, চড়া দামে চাল কিনতে হচ্ছে। অস্বচ্ছ সরবরাহ ব্যবস্থা।
বাজারে চালের দামের এই আকস্মিক বৃদ্ধি এবং সরবরাহ ব্যবস্থার অস্বচ্ছতার কারণে সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়ছেন। এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য বাজার নিয়ন্ত্রণ, মজুতদারি রোধ এবং সরবরাহ ব্যবস্থা শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে চালের বাজার অস্থির করতে চালবাজ সিন্ডিকেটের নানা ফন্দি আঁটার তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় খাদ্যশস্য বিতরণ হয়েছে অন্য যেকোনোও সময়ের তুলনায় কিছুটা কম। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সরকারি গুদামে বর্তমানে এ সময়ে খাদ্যশস্যের সবচেয়ে বেশি মজুত রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে খাদ্যশস্যের মজুত ‘অত্যন্ত সন্তোষজনক’ এবং ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ২১ লাখ টনের বেশি। বোরো ধানের বাম্পার ফলন ও সরকারি সংগ্রহ এবং মজুতের কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলে জানিয়েছেন খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার।
মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, মজুতের জন্য খাদ্য অধিদফতর লাইসেন্স নেওয়া অধিকাংশ বৈধ গুদামে নির্ধারিত পরিমাণের কয়েক গুণ বেশি ধান-চাল সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এছাড়া খাদ্য মজুতের জন্য সর্বোচ্চ যে সময় নির্ধারিত, সেটিও মানা হচ্ছে না। যা মজুতদারি আইনে অবৈধ। এ অপরাধে ফৌজদারি আইনে মামলা এবং জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। অথচ প্রশাসনের দুর্বল নজরদারির সুযোগে মজুতকারি চক্র প্রায়ই লাখ লাখ টন ধান-চাল অবৈধভাবে মজুতের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজার অস্থিতিশীল করে তুলছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী বলেন, চালের বাজার কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী, এটা সত্য। কিন্তু এর জন্য মিলাররা দায়ী নয়, মিলগেটে আমরা নির্ধারিত দামেই সরবরাহ করছি। বিষয়টি সরকারের দেখভাল করা উচিত। সরকারের মনিটরিং ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। বর্তমানে চালের খুচরা বাজারে সরকারের মনিটরিং খুব একটা আছে বলে হয় না। বাজার মনিটরিং বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সারাদেশে ৫০ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ২০ হাজার হেক্টর বেশি। এবার বোরোতে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২ কোটি ২২ লাখ টন। সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শুধু হাওড়ে ৪ লাখ ৫৩ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি। আর তাতে ৫০ হাজার টন বেশি বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে।