বিএনপি কেন ভয় পাচ্ছে গনভোটকে
- আপডেট সময় : ১০৫ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে “জুলাই সনদ” (July Charter) এখন অন্যতম আলোচিত ইস্যু। এই সনদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে একটি “জনগণমুখী পুনর্গঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা” গড়ে তোলা। যেখানে নির্বাহী ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা।
তবে প্রশ্ন উঠছে এই সনদ বাস্তবায়নের আগে জনগণের মতামত যাচাই করতে গণভোট আয়োজন করা কি প্রয়োজন? আর যদি প্রয়োজন হয়, তবে কেন বিএনপি এখন পর্যন্ত এই প্রস্তাবে অনাগ্রহী?
এদিকে জামায়াত, এনসিপি, হেফাজত, চরমোনাই সহ ৮টি রাজনৈতিক দল দাবি জানিয়েছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে নভেম্বরে গণভোট দিতে হবে। জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে হবে। এতে সরকারের কিছু অর্থ খরচ হলেও গণভোটের আয়োজন করতে হবে। অন্যথায় সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।
তবে বিএনপি মনে করে গণভোট নয়, তারা ‘জনসমর্থনের ম্যান্ডেট’ চায়।
বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মতে, জুলাই সনদ হলো দলের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির দলিল। কোনো সংবিধান সংশোধন প্রস্তাব নয়। তারা মনে করে, এই সনদ বাস্তবায়নের বৈধতা আসবে নির্বাচনে জনগণের ভোটের মাধ্যমেই। তাদের যুক্তি জনগণ যখন বিএনপিকে ভোট দেবে, তখন তারা সনদের নীতিগুলোকেও অনুমোদন দেবে।”
অর্থাৎ, তারা নির্বাচনকেই গণভোটের বিকল্প হিসেবে দেখছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ কোথায় দাঁড়াবে?
যদি বিএনপি ২০২৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়, তখন এই সনদ বাস্তবায়নে তারা সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিতে পারে। কিন্তু তখনও গণভোট ছাড়া জনগণের সরাসরি অনুমোদন পাওয়া কঠিন হবে।
রাজনৈতিকভাবে, গণভোট না দিলে সরকারের নীতির “জনসমর্থনের বৈধতা” নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
মূলত জুলাই সনদ হচ্ছে একটি প্রস্তাবিত রাজনৈতিক সংস্কারের দলিল। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হলে কিছু মূল বিষয়ে পরিবর্তনের প্রস্তাব আনতে হবে। যেমন
১.নির্বাহী ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করন।
২.সংসদ সদস্যদের জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করা।
৩.নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করা।
৪.বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া।
৫.স্থানীয় সরকারে স্বশাসনের
রাজনীতিতে অর্থ ও প্রভাবের নিয়ন্ত্রণ করা।
এই প্রস্তাবগুলো কার্যকর করতে হলে সংবিধান সংশোধন অপরিহার্য, যা আবার সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে পাস করতে হয়।
তাই বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের পরিবর্তনে জনগণের সরাসরি মতামত নেওয়া নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে জরুরি।
এছাড়াও বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে গণভোট ছাড়া জুলাই সনদ প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. মাহবুবুর রহমান মনে করেন, “জুলাই সনদ কেবল দলীয় প্রতিশ্রুতি নয়, এটি রাষ্ট্র কাঠামোর পুনঃনকশা। সেক্ষেত্রে জনগণের সরাসরি অনুমোদন ছাড়া এর বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশে গণভোটের সংস্কৃতি অনুপস্থিত। তবে নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক সচেতনতা এতটাই বেড়েছে যে তারা এখন এর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ চায়।
রাজনৈতিক বাস্তবতায় গণভোটে বিএনপির ভয় কোথায়? বিএনপির ভেতরকার নেতারা গণভোটকে দ্বিমুখী তলোয়ার হিসেবে দেখেন।
তাদের মতে, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ এখনো পুরোনো ব্যবস্থার হাতে। তাই গণভোটে প্রভাব খাটানো সম্ভব। সরকারি যন্ত্রের হস্তক্ষেপে গণভোটের ফল বিকৃত হলে তাদের আন্দোলনের গতিপথ থেমে যাবে। এছাড়া
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ “গণভোটে না” প্রচারণাকে ব্যবহার করে বিএনপির সংস্কার পরিকল্পনাকে দুর্বল করতে পারে। ফলে, দলটি এখন গণভোট নয়, বরং বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরির পথে এগোচ্ছে।
তাছাড়া গণভোট না দিলে রাজনৈতিক বৈধতাও প্রশ্নের মূখে পড়তে পারে। যদি বিএনপি আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে এবং গণভোট ছাড়া জুলাই সনদ বাস্তবায়ন শুরু করে, তাহলে রাজনৈতিক বিরোধীরা এটিকে “জনমতের বাইরে চাপিয়ে দেওয়া সংস্কার” হিসেবে প্রচার করতে পারে।
এতে দেশে নতুন করে আবারও রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ার ঝুঁকি রয়েছে।
এছাড়া গণভোটের আয়োজন করতে গেলে যে বিশাল প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ তৈরি হবে, সেটিও বিএনপি এখন নিতে চায় না।
কেন বিএনপি ভয় পাচ্ছে গণভোটকে? কারণ বিএনপির ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন সূত্র বলছে, গণভোট নিয়ে তাদের তিনটি আশঙ্কা রয়েছে।
১. প্রশাসনিক প্রভাব বর্তমান এখনো রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিপক্ষ গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
২. রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ: ক্ষমতাসীন মহল গণভোটের মাধ্যমে দলের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে।
৩. আন্দোলনের গতি হারানো: গণভোটে পরাজয় মানেই আন্দোলনের রাজনৈতিক শক্তি দুর্বল হওয়া।
একজন জ্যেষ্ঠ বিএনপি নেতা নাম প্রকাশ না করে বলেন, “গণভোট এখন আমাদের পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা চাই আগে ক্ষমতায় আসতে, তারপর জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে গনভোট করতে ।
এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণের মতে, “রেফারেন্ডাম গণতন্ত্রের চূড়ান্ত প্রকাশ। এ বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে “বাংলাদেশের মতো পরিবর্তনশীল রাষ্ট্রে সাংবিধানিক সংস্কারের আগে রেফারেন্ডাম জনগণের আস্থার প্রতীক এবং এটা হওয়া জরুরী। তবে তারা সতর্ক করে বলেছে, প্রশাসনিক পক্ষপাত, দলীয় প্রভাব এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি গণভোটের স্বচ্ছতা ব্যাহত করতে পারে। তাই আন্তর্জাতিক মহলও গণভোটে আগ্রহী হলেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
এ বিষয়ে আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত হচ্ছে গনভোট করতে “সংবিধান অনুমোদন দেয় কিন্তু জনগণ এর বৈধতা দেয়।
সাবেক বিচারপতি রুহুল আমিন বলেন, সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে সংসদীয় অনুমোদন যথেষ্ট। তবে এক্ষেত্রে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণই গণতন্ত্রের আত্মা। তিনি আরও বলেন, যদি রাষ্ট্র কাঠামো মৌলিকভাবে বদলায়, তাহলে গণভোট নেওয়া নৈতিক বাধ্যবাধকতা হয়ে দাঁড়ায়। তখন আর বিকল্প চিন্তার সুযোগ নাই।
গনভোটের বিষয়ে তরুণ প্রজন্মের মতামত হচ্ছে “আমরা গনভোটে অংশ নিতে চাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, ৬৮% তরুণ গণভোটকে জনগণের মতামত জানানোর সুযোগ হিসেবে দেখছে।
২২% মনে করে, “গণভোট নিরপেক্ষভাবে আয়োজন করা সম্ভব নয়। আর বাকি ১০% এ বিষয়ে অনিশ্চিত। একজন তরুণ শিক্ষার্থী বলেন, যদি সত্যিই পরিবর্তন আসে, তবে আমাদের মতামত জানার সুযোগ থাকা উচিত। এমনকি শুধু রাজনৈতিক দল নয়, জনগণকেও জবাবদিহির অংশ হতে হবে।
তবে গণভোট ছাড়া জুলাই সনদের বৈধতা সংকটের ঝুঁকি থেকেই যাবে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বিএনপি যদি ক্ষমতায় এসে গণভোট ছাড়া জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করে,
তাহলে বিরোধীরা একে “জনবিচ্ছিন্ন সংস্কার” হিসেবে প্রচার করতে পারে।
ফলে সরকার রাজনৈতিক বৈধতা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য তখন চ্যালেঞ্জে পড়তে পারেন।
অন্যদিকে, গণভোট আয়োজন করলে প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ ও বিদেশি পর্যবেক্ষণের চাপও বেড়ে যাবে। কারণ গনভোট নৈতিকভাবে প্রয়োজনীয় এবং রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
গণভোট বাংলাদেশের সংবিধানে ঐচ্ছিক হলেও এর নৈতিক শক্তি অপরিসীম।
জুলাই সনদের মতো বড় পরিবর্তনে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ না থাকলে,
রাজনৈতিকভাবে সেটি দীর্ঘস্থায়ী আস্থা পাবে না।
তাই বিএনপি এখন নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে বৈধতা অর্জনের পথ বেছে নিয়েছে।
তবে ভবিষ্যতে যদি তারা সত্যিই “জনগণের রাষ্ট্র” গঠনে বিশ্বাসী হয়, তাহলে একটি সীমিত বা বিষয়ভিত্তিক গণভোটই হতে পারে তাদের সবচেয়ে বড় আস্থার প্রতীক।
তবে বাংলাদেশে গণভোটের সংস্কৃতি নতুন হলেও এর প্রয়োজনীয়তা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
গণতন্ত্র তখনই পূর্ণতা পায়, যখন জনগণ কেবল ভোট দেয় না বরং রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্তেও অংশ নেয়।
বিএনপিকে জুলাই সনদ সেই সুযোগ এনে দিতে পারে, যদি দলটি জনগণের গনভোটের মতামতকে ভয় না পায়।




















