অনলাইন জুয়ার বিস্তার
বিনোদনের নামে সর্বনাশের ছক

- আপডেট সময় : ০৯:১৯:২২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫ ২৬ বার পড়া হয়েছে
প্রয়োজন এখনই সচেতনতা, কঠোর আইন প্রয়োগ ও পারিবারিক মূল্যবোধের চর্চা। এই ব্যাধি থামাতে হলে প্রয়োজন সমাজের সকল স্তরের জনগণের অংশগ্রহণ, শিক্ষা ও প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি এবং আইন প্রয়োগকারী সকল সংস্থাকে সার্বিক সহায়তা করা
ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ট্যাব ব্যবহারের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে গোপনে বিস্তার লাভ করেছে অনলাইন জুয়া সাইট ও অ্যাপস। অনেকেই মনে করেন- এটি নিছক একটি বিনোদনের মাধ্যম, কিন্তু বাস্তবে এটি একটি অর্থনৈতিক, সামাজিক, মানষিক ও আইনগত বিপর্যয়ের চরম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে তরুণ সমাজ প্রতিদিনই আকৃষ্ট হচ্ছে এই জুয়া আসক্তির ফাঁদে, যার ভয়াবহ পরিণতি দেখা যাচ্ছে পরিবারে, সমাজে, দেশে এমনকি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ভিপিএন বা ভিন্ন মাধ্যমে জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক জুয়া সাইট ও অ্যাপগুলোর মধ্যে ১ীইবঃ-স্পোর্টস বেটিং, ক্যাসিনো, ইবঃ৩৬৫-লাইভ বেটিং ও স্লট, ২২ইবঃ-স্পোর্টস ও রুলেট, গবষনবঃ-বেটিং ও স্লট গেম, গড়ংঃনবঃ-ক্রিকেট ও ফুটবল বেটিং, চধৎরসধঃপয-লাইভ ক্যাসিনো, ঈৎরপশবী-ক্রিকেট বেটিং অ্যাপ, ঔববঃরিহ-লাইভ ক্যাসিনো ও ডিলার গেম, ঋধরৎচষধু-স্পোর্টস ও লটারি এবং ঋঁহ৮৮-স্লট ও রুলেট ইত্যাদি। এসব অ্যাপ গুগল প্লে স্টোর বা অ্যাপ স্টোরে সাধারণত পাওয়া না গেলেও ব্যবহারকারীরা অচক ফাইলের মাধ্যমে ইনস্টল করে থাকে।
আইনগত দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশে অনলাইন জুয়া সম্পূর্ণ অবৈধ। কয়েকটি প্রাসঙ্গিক আইনগুলোর মধ্যে রয়েছে ১.জুয়া আইন, ১৮৬৭ (চঁনষরপ এধসনষরহম অপঃ, ১৮৬৭)। এই আইনে কোনো ধরনের জুয়া খেলা, পরিচালনা বা প্রচারণা করা দণ্ডনীয় অপরাধ। ২. সাইবার সুরক্ষা বিধিমালা, ২০২৫ এর ২০ ধারানুযায়ী (১) যদি কোনো ব্যক্তি সাইবার স্পেসে জুয়া খেলার নিমিত্ত কোনো পোর্টাল বা অ্যাপস বা ডিভাইস তৈরি করেন বা পরিচালনা করেন বা জুয়া খেলায় অংশগ্রহণ করেন বা খেলায় সহায়তা বা উৎসাহ প্রদান করেন বা উৎসাহ প্রদানের জন্য বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণ এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রচার বা বিজ্ঞাপিত করেন তা হলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হবে একটি অপরাধ। (২) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তা হলে তিনি অনধিক ২ (দুই) বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ১ (এক) কোটি টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ৩. মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ জুয়া থেকে আয়কৃত অর্থ হস্তান্তর বা বিনিয়োগ করা মানি লন্ডারিং হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ৪. আইসিটি অ্যাক্ট ২০০৬ (সংশোধিত) ইন্টারনেটভিত্তিক প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড, অবৈধ পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবহারে জড়িতরা দণ্ডনীয়।
ক্ষতিকর দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে- অনলাইন জুয়া শুধু ব্যক্তিকে নয়, পুরো পরিবার, সমাজ ও দেশকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। এর নেতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে- ১. অর্থনৈতিক ধ্বংস: স্বল্প আয়ের মানুষও ‘বড় জেতার আশায়’ সর্বস্ব হারায়। ক্রেডিট কার্ড, লোন, পারিবারিক সঞ্চয় পর্যন্ত খরচ হয়।
২. মানসিক ও সামাজিক প্রভাবঃ আসক্তি, হতাশা, বিষর্ণনতা ও আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে। পরিবারে অশান্তি, বিবাহ বিচ্ছেদ এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়। ৩. অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঃ অর্থ সংকট মেটাতে অনেকে চুরি, প্রতারণা বা ড্রাগ পাচারে জড়িয়ে পড়ে। জুয়া অর্থ প্রায়ই সন্ত্রাসী বা অপরাধী চক্রের কাছে চলে যায়। ৪. তথ্য সুরক্ষা ঝুঁকি থাকা এসব অ্যাপে নিজের মোবাইল নম্বর, ব্যাংক তথ্য ও ব্যক্তিগত ডেটা দিয়ে থাকেন ব্যবহারকারীরা। ফলে তারা সাইবার চুরি ও প্রতারণার শিকার হন। একটি বাস্তবচিত্রে দেখা গেছে, সম্প্রতি রাজধানীতে এক যুবক পরিবারের অজান্তে ১ীইবঃ অ্যাপে ৩ লাখ টাকা হেরে গিয়ে মানসিক ভারসাম্য হারান। এমন বহু অজানা ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে আমাদের চারপাশে, যা কোনো মিডিয়ায় আসছে না, কিন্তু সমাজে তার প্রভাব পড়ছে মারাত্মকভাবে।
করণীয় ও পরামশর্ ঃ পরিবারে তথা সন্তানদের ইন্টারনেট ব্যবহারে নজরদারি বাড়ানো উচিত। তরুণদের অবৈধ অ্যাপস বা সাইট সম্পর্কে পারিবারিকভাবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা অন্যভাবে সচেতন করা জরুরি। সরকারের উচিত ঠচঘ নিয়ন্ত্রণ ও অবৈধ ওয়েবসাইটসমূহ ব্লক করা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত সাইবার অপরাধ ইউনিট আরও সক্রিয় করা এবং এবিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাতে পরিবার, সমাজ ও দেশ থেকে এই মরণ নেশা দূর হয়ে যায়। সন্তান বা উঠতি বয়সীদের জন্য পর্যাপ্ত চিত্ত বিনোদন এবং খেলাধুলার ব্যবস্থা করা। অনলাইন জুয়া নিছক একটি “খেলা” নয়, এটি একটি নীরব সামাজিক দুর্যোগ। প্রয়োজন এখনই সচেতনতা, কঠোর আইন প্রয়োগ ও পারিবারিক মূল্যবোধের চর্চা। এই ব্যাধি থামাতে হলে প্রয়োজন সমাজের সকল স্তরের জনগণের অংশগ্রহণ, শিক্ষা ও প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি এবং আইন প্রয়োগকারী সকল সংস্তাকে সার্বিক সহায়তা করা। নইলে আমাদের আগামী প্রজন্ম ধ্বংসের মুখে পড়বে বিনা যুদ্ধে।
লেখক ঃ তদন্তকারী, সাইবার ক্রাইম, ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ঢাকা।