ব্যবসায়ী সংগঠনের দুর্বলতায় খেয়ালখুশি সিদ্ধান্ত সরকারের
- আপডেট সময় : ১১:০১:০২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৫ ৩ বার পড়া হয়েছে
মূল্যস্ফীতি উচ্চ, কলকারখানায় চলছে শ্রমিক অসন্তোষ। বিনিয়োগে স্থবিরতা, গ্যাস-বিদ্যুৎ নিয়ে আছে সংকট। এ অবস্থায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য যখন ধুঁকছে তখন হঠাৎ করেই শতাধিক পণ্য ও সেবায় কর, শুল্ক ও ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে সরকারের নেওয়া এমন সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেন ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠনে প্রশাসক দায়িত্ব পালন করায় সরকারের এমন অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের বিপক্ষে যেতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোতে সর্বশেষ যে নেতারা ছিলেন তাদের অধিকাংশই এখন পলাতক। ফলে অংশীজনদের মতামতের প্রতিফলন ঘটছে না সিদ্ধান্ত গ্রহণে। গত ৯ জানুয়ারি রাতে দুটি অধ্যাদেশ জারি করে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়। এরপর সমালোচনার মুখে রেস্তোরাঁ সেবা, মোবাইল, ইন্টারনেট, ওষুধসহ কয়েকটি পণ্য ও সেবায় কয়েক দফায় ভ্যাট এবং শুল্ক কমিয়ে আগের হারে ফিরিয়ে নিয়েছে সরকার। তবে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কোনো পক্ষের সঙ্গে আলোচনা বা ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়নি। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোতে নেতৃত্বের দুর্বলতা, অংশীজনদের কোনো রকম মতামত না নেওয়ার মানসিকতায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। একে সরকারের ‘কৌশলগত ভুল’ বলেও অবহিত করেন বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ঋণ দিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে কর-জিডিপি অনুপাত ০ দশমিক ২ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। আইএমএফের শর্ত প্রতিপালনে এনবিআর অর্থবছরের মাঝখানে কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন করে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি, বাংলাদেশ এগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনসহ (বাপা) একাধিক সংগঠন। এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন অর্থনীতিবিদরাও।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ও এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘অবিবেচনাপ্রসূতভাবে ভ্যাটের হার বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেন, রাজস্ব আদায় বাড়াতে প্রত্যক্ষ করে মনোযোগ দেওয়া দরকার হলেও অন্তর্বর্তী সরকার আগের মতোই পরোক্ষ করে নজর দিচ্ছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক। পণ্য ও সেবায় কর আরোপ এবং অব্যাহতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সাধারণত বছরজুড়ে গুটিকয়েক পণ্যের করের হার বাড়ানো ও করছাড় এনবিআরের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেয় সরকার। তবে প্রতি বছর জুনে অর্থবছরের বাজেট হয়। সেই বাজেটে একসঙ্গে শতাধিক বা তার বেশি পণ্যের কর কমানো বা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। বাজেটের আগে মাসজুড়ে ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও অন্য অংশীজনদের মতামত নেওয়া হয়। তবে এবার অধ্যাদেশ জারি করে হঠাৎ মূসক, শুল্ক ও ভ্যাট বাড়িয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে নেওয়া হয়নি কোনো মতামত।
এ বিষয়ে আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের ডিরেক্টর (অপারেশন) সৈয়দ জহুরুল আলম বলেন, সরকারের এ সিদ্ধান্ত ব্যবসাবান্ধব নয়। এটা অন্য কোনো পরিকল্পনার অংশ কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারও সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে একেবারে সর্বনিম্ন স্তরের পণ্যের ওপর অযৌক্তিকভাবে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এটা কোনোভাবে জনবান্ধব নয়, কাদের স্বার্থে এ সরকার কাজ করছে তা নিয়ে আমি সন্দিহান।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন বলেন, গণআন্দোলনের মাধ্যমে আসা জনগণের সরকার ক্ষমতায়। কিন্তু এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কারও সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। আইএমএফের কথা বলে বাজেটের মাঝপথে এভাবে জনগণের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিস) গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর বলেন, সরকার যদি সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতো তাহলে ভালো হতো। তখন রাজস্ব বাড়াতে অন্য কোনো উপায় আছে কি না তা খুঁজে বের করা যেত। যেহেতু আলাপ আলোচনা হয়নি সেহেতু এ ধরনের সিদ্ধান্তকে অংশগ্রহণমূলক বলা যাবে না। এটাকে কেউ ভালোভাবে নিয়েছেন এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ক্ষমতার পালাবদলে অনেক ব্যবসায়ী সংগঠনের শীর্ষপদে রদবদল হয়েছে। বিভিন্ন মামলা ও অভিযোগে অনেক ব্যবসায়ী গ্রেফতার হয়েছেন। অনেকে পালিয়েছেন স্বৈরাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ), ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসে (বেসিস) প্রশাসক নিযুক্ত আছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসায়ী সংগঠনে নেতৃত্বশূন্যতায় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সরকার তার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারছে। প্রশাসকরা ব্যবসায়ীদের প্রয়োজন, ভাষা বোঝেন না। তারা সরকারের প্রতিনিধি। এতে দেখা দিচ্ছে সংকট। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাংলাদেশে এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ -এ তিনটা সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী সংগঠন। ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে এখান থেকে সবচেয়ে বেশি আলোচনা ও সমালোচনা আসা উচিত। দুর্ভাগ্যবশত এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ চলছে শাসক দিয়ে। ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানো নিয়ে দুই জায়গা থেকে সেভাবে প্রতিক্রিয়া আসেনি।
তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের পক্ষে কেউ কথা বলেনি। এসব সংগঠন থেকে প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি না। ব্যবসায়ীদের পক্ষে কথা বলার প্ল্যাটফর্মগুলো সীমিত হয়ে আসছে। হয়তো আমি বিকেএমইএ থেকে কথা বলছি। অন্যদিকে মেট্রোপলিটন চেম্বার থেকে মাঝে মধ্যে কথা বলা হচ্ছে। প্রশাসক যেখানে আছে সেখানে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিতে হবে। ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি সেখানে আসা উচিত। তাহলে ব্যবসায়ীদের কথা সরকারের কাছে পৌঁছাবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিস) গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর বলেন, এটা সরকারের একটা কৌশলগত ভুল। এনবিআর সবার সঙ্গে আলাপ করলে ভালো ভালো পরামর্শ পেতো। এই কর বাড়ানোর প্রস্তাবটা এনবিআর এককভাবে সরকারকে দিয়েছে। সরকারের কাছে এই মুহূর্তে টাকা নেই। সরকার একটা আইন করে এ ধরনের ভ্যাট বা শুল্ক বাড়িয়েছে। আলাপ আলোচনা করলে নানান রকমের কথাবার্তা হতো, প্রস্তাব আসতো। ব্যবসা বাণিজ্যে মন্দা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিনিয়োগ কম। এখন ভ্যাট, ট্যাক্স বাড়ালে পণ্য ও সেবা দুটোরই দাম বাড়বে। এর ফলে পণ্যের চাহিদা কমে যাবে। এসব আশঙ্কা থেকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করা হয়নি। ব্যবসায়ীরা হয়তো সরকারকে বাধা দিত। মূসক বা কর বাড়িয়ে ১২ হাজার কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব হবে না জানিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, রাজস্ব আদায় হয়তো কিছু বাড়বে।