ঢাকা ০৯:০২ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম ::

ই-বর্জ্য আতঙ্কে রাজধানীবাসী

হালিম মোহাম্মদ
  • আপডেট সময় : ১০:৪৬:৩০ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫ ১৩ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক গনমুক্তি অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

পরিবেশের নতুন আতঙ্ক ই-বর্জ্য। দেশে এটি যেমন প্রতিনিয়ত বাড়ছে, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ায় সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করা হলে এর মধ্যে থাকা সব ভারী ধাতুর সংস্পর্শে শ্বাসকষ্ট, চর্ম ও স্নায়ুরোগ এমনকি ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিরও ঝুঁকি রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, নিরাপত্তা মান নিশ্চিত ও নীতিমালা বাস্তবায়নের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। ২০২১ সালে ই-বর্জ্য বিধিমালা প্রয়োগ করা হলেও এখন পর্যন্ত তার সঠিক ও সুষ্ঠু বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, ই-বর্জ্য নীতিমালা-২০২১ জোরালোভাবে বাস্তবায়নের কথা ভাবছে সরকার।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, ইলেকট্রনিক সামগ্রীর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। অধিকাংশ বাড়িতেই এখন রেফ্রিজারেটর শোভা পাচ্ছে, অনেক বাড়িতেই রয়েছে এয়ারকন্ডিশনার। ল্যাপটপ আর কম্পিউটার এখন অধিকাংশ শিক্ষিত শ্রেণির জীবনসঙ্গী। রড তৈরির জন্য ভাঙতে হচ্ছে পুরোনো জাহাজ, পুরোনো জাহাজের মালামালে সৃষ্টি হচ্ছে নানা রকম বর্জ্যের। কয়েক দশক ধরে এ সবকিছুর সঙ্গেই চলছে আমাদের আধুনিক জীবনযাপন। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এসব ইলেকট্রনিক সামগ্রীর ব্যবহার দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এসব সামগ্রীর একটি নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল বা সচল থাকার মেয়াদ থাকে। অকেজো সোলার প্যানেল ও ইলেকট্রিক গাড়িও এখন ই-বর্জ্য। সাধারণত এগুলো স্বল্পায়ু, তাই মেয়াদ শেষ হলে বা ব্যবহারের অযোগ্য হলে সেসব সামগ্রী ভাগাড়ে ছুড়ে ফেলতে হয়। ভাগাড়ে ফেলা এসব সামগ্রীর বর্জ্যই ই-বর্জ্য বা ইলেকট্রনিক-বর্জ্য হিসেবে পরিচিত।
বাংলাদেশে ই-বর্জ্যের মধ্যে মোবাইল বা সেলফোনের ই-বর্জ্য বড় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে জাহাজভাঙাসহ বছরে প্রায় ৩০ লাখ টন ই-বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এর মধ্যে প্রতিবছর প্রায় ৯০০০ টন আসে শুধু মোবাইল ফোন বর্জ্য, প্রতিবছর এর পরিমাণ ৩০ শতাংশ হারে বাড়ছে। সারা পৃথিবীতে ২০২৪ সালে ই-বর্জ্যের উৎপাদন ছিল ৬৩৩ লাখ টন। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালে বিশ্বে ই-বর্জ্যের উৎপাদন হবে ৭৪৭ মিলিয়ন টন। বিশ্বে এশিয়ার দেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশি ই-বর্জ্য তৈরি হয়, যার পরিমাণ ২৪৯ লাখ টন। আমেরিকা ও ইউরোপের চেয়েও আমরা বেশি ই-বর্জ্য তৈরি করি।
এছাড়া স্তূপ করে রাখা এসব ই-বর্জ্য থেকে নির্গত বিষাক্ত পদার্থ বিশেষ করে ভারী ধাতুগুলো ও জৈব যৌগ মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছে। ই-বর্জ্যে থাকে ক্ষতিকর বিভিন্ন ভারী ধাতু, যেমন সিলিকন ডাই-অক্সাইড, পলিয়েস্টার, ফেনল, ফরমালডিহাইড, হ্যালেজিনেটিড পলিমার, নাইট্রোজেনধারী পলিমার ইত্যাদি। ই-বর্জ্যের প্রায় ৬০ শতাংশই বিভিন্ন ভারী ধাতু, বিশেষ করে আয়রন বা লোহা, সিসা, মার্কারি, তামা, ক্যাডমিয়াম এবং ১৫ শতাংশ প্লাস্টিক সামগ্রী। এ ছাড়া এর মধ্যে থাকে টিউব ও স্ক্রিন, কেব্ল, প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড ইত্যাদি। সঠিক ব্যবস্থাপনা করা না হলে পরিবেশদূষণকারী এসব ক্ষতিকর পদার্থ মানুষ ও প্রাণীর মারাত্মক স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সম্প্রতি গবেষকদের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইলেকট্রনিক সামগ্রীগুলোর মধ্যে মোবাইল বা সেলফোনের জীবনকাল সবচেয়ে কম, যা মাত্র ১ থেকে ২ বছর এবং ডেস্কটপ ও ল্যাপটপের জীবনকাল সবচেয়ে বেশি, যা ৭ থেকে ৮ বছর। টেলিভিশনের জীবনকাল ৩ থেকে ৬ বছর। এয়ারকন্ডিশনার যন্ত্রগুলোও সাধারণত সচল থাকে ৫ থেকে ৬ বছর। অধিকাংশ রেফ্রিজারেটর ৮ বছর চলার পর নষ্ট হয়ে যায়। সে সমীক্ষায় আরও দেখা যায়, দেশের শতভাগ মানুষ সেলফোন ব্যবহার করেন, টেলিভিশন আছে ৮০ শতাংশ ঘরে। অথচ এদের ৬৫ শতাংশ মানুষই জানেন না ই-বর্জ্য কী? প্রতিবছর বাংলাদেশে ই-বর্জ্য বাড়ছে ২০ শতাংশ হারে। এর খুব সামান্য পরিমাণ প্রতিবছর রিসাইক্লিং করা হচ্ছে, যার পরিমাণ মাত্র ১৩ থেকে ১৪ হাজার টন।
মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর ই-বর্জ্যের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। পরিবেশে বায়ু, পানি, মাটি ইত্যাদির ওপর ই-বর্জ্যের বিরূপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ই-বর্জ্য যখন ভাঙা বা গলানো হয়, তখন তা থেকে যেসব রাসায়নিক ধাতব দ্রব্য বের হয় সেগুলো বাতাসে মেশে, পানিতে যায় ও মাটিকে দূষিত করে। ই-বর্জ্যের বিভিন্ন কণা ও রাসায়নিক দ্রব্য যেমন ডাইঅক্সিন বায়ুম-লের বাতাসে মেশে। এতে বায়ু দূষিত হয়। শ্বাসের সঙ্গে সেই দূষিত বায়ু দেহে শ্বাসতন্ত্রে প্রবেশ করে, ত্বকের সংস্পর্শে আসে ও মানবদেহে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে। এতে টিউমার ও ক্যানসারের মতো রোগও হতে পারে। ই-বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কারণে তা থেকে নির্গত মার্কারি বা পারদ, লিথিয়াম, সিসা, বেরিয়াম ইত্যাদি ধাতবদ্রব্য মাটির গভীরে প্রবেশ করে, এতে মাটি ও পানি দূষিত হয়। এরূপ মাটির নিচ থেকে যে পানি তোলা হয়, তাতেও এসব ধাতুর কণা পাওয়া যায়। ওপর থেকে এসব ধাতবদ্রব্য বৃষ্টির পানিতে মিশে চলে যায় পুকুর, খাল ও নদীতে। কাজেই সেসব পানিও দূষিত হয় ও জলজ জীবের আবাসস্থল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এর ফলে পরিবেশে সামগ্রিক পরিবেশতন্ত্রে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
পরিবেশবিদ অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, সীসা, পারদ ও নিকেল পানিতে মিশে পানিকে দূষিত করে। এতে উদ্ভিদ ও প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীকালে শাক-সবজিসহ বিভিন্ন রকম ফসল এবং ফলের মাধ্যমে সেগুলো আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। মানবাধিকার সংগঠন ‘ভয়েজ’-এর একটি গবেষণা বলছে, এ বর্জ্য সংগ্রহের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৫০ হাজার শিশু, যাদের প্রায় ১৫ ভাগই প্রতি বছর ই-বর্জ্যের সংস্পর্শে আসার কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ই-বর্জ্য পরিবেশ দূষণের একটি নতুন উপকরণ। ব্যবহারের পর বিভিন্ন ধরনের ইলেক্ট্রনিক্স দ্রব্য যখন অচল বা সচল অবস্থায় ফেলে দেয়া হয়, সেটাই ই-বর্জ্য। বাংলাদেশে বছরে এটি সৃষ্টি হয় ৩০ লাখ মেট্রিক টন। সাধারণত প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারের পর ফেলে দেয়া হচ্ছে ডাস্টবিনে। সেগুলো মিশছে মাটিতে, হচ্ছে দূষণ। এসব বর্জ্য থেকেই তৈরি হচ্ছে সীসা ও ক্যাডমিয়ামের মতো ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান। তবে এ বিপুল পরিমাণ ই-বর্জ্য সামলাতে বাংলাদেশ কি প্রস্তুত?
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে পুরনো কিংবা নষ্ট ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করেন এমন কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা শ্বাসকষ্ট, কাশির মতো রোগে ভোগেন প্রায়ই। চিকিৎসকরা সতর্ক করছেন, ই-বর্জ্যে থাকা বিভিন্ন ভারী ধাতুর দূষণ রোধ করা না গেলে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়বে দিন দিন।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আবু সাঈদ শিমুল বলেন, আমরা যেন এসব বর্জ্য যত্রতত্র না ফেলি। একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রিসাইকেলও করা যায়। এছাড়া যারা হ্যান্ডলিংক করবেন, তারা যেন অন্তত মাস্ক ও গ্লাভস পরেন। এ অবস্থায় এ থেকে উত্তরণে ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুমোদনের পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের।
এ বিষয়ে অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ফরমাল সেক্টরে রিসাইক্লিংয়ের দরকার আছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ বা যারা ব্যবসা করছেন, তাদেরকে প্রণোদনা দিয়ে ফরমাল সেক্টরে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে অনুমোদন দেয়া যেতে পারে।
এদিকে রাজধানীতে বর্জ্যব্যবস্থাপনায় অনিয়ম চলছে। দেড় দশক ধরে ঘুরে ফিরে ৪টি প্রতিষ্ঠানই পাচ্ছে কাজ। ঢাকা উত্তর সিটির বর্জ্যব্যবস্থাপনায় অনিয়মের অভিযোগ অন্য ঠিকাদারদের। এতে সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম ও তার স্বজনদের জড়িত থাকার অভিযোগও তাদের। ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) বলছে, শিগগিরই নতুন দরপত্র আহ্বান করা হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোটি পরিবারের বসবাস ঢাকা শহরে। প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে মানুষ প্রতিদিনই তৈরি করছে প্রায় সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টন বর্জ্য। আর এ বর্জ্য বাসাবাড়ি থেকে সংগ্রহ করে আমিনবাজার বা মাতুয়াইলে ময়লার ভাগাড়ে পৌঁছে দিতে অনিয়মের অভিযোগ অনেকের। বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে প্রথমে নেয়া হয় সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশনে (এসটিএস)। সেখান থেকে সে বর্জ্য যায় মাতুয়াইল বা আমিনবাজারে ময়লার ভাগাড়ে। ১৬ বছর ধরে ঘুরে ফিরে ৪ জন ঠিকাদারই পাচ্ছেন সে কাজ। কয়েকজন ঠিকাদার অভিযোগ করছেন, টেন্ডারে এমনভাবে শর্ত দেয়া হতো, যাতে ঘুরেফিরে ৪টি প্রতিষ্ঠানই কাজ পায়। এমনকি সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের কয়েকজন স্বজন এতে জড়িত বলেও মনে করেন তারা। ডিএনসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফিদা হাসান বলেন,এটি সংশোধন করা হবে। ১৭ তারিখে টেন্ডার ওপেন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিভিন্ন আবেদন পেয়েছি। তাই আমরা সেগুলোকে বিবেচনায় নিচ্ছি, যাতে সর্বোচ্চ অংশগ্রহণকারী নিতে পারি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অনিয়ম স্থায়ীভাবে বন্ধে সিটি করপোরেশনের বেশকিছু নিয়ম-কানুনের সংস্কার প্রয়োজন। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, নাগরিক সেবা দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর দীর্ঘদিনের অসুখ নিরাময় করা না গেলে শুধু সিদ্ধান্ত নিয়ে বা কিছু নিয়ম-কানুন পরিবর্তন করে অবস্থার পরির্তন করা যাবে না। অনিয়ম বন্ধে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বা যে রূপে পরিচালনা করা দরকার, সেটি স্থায়ীভাবে করা প্রয়োজন। নাগরিক সেবা বাড়াতে করপোরেশনগুলোকে উদ্যোগী হওয়ারও পরামর্শ দেন এ বিশ্লেষক।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ই-বর্জ্য আতঙ্কে রাজধানীবাসী

আপডেট সময় : ১০:৪৬:৩০ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫

পরিবেশের নতুন আতঙ্ক ই-বর্জ্য। দেশে এটি যেমন প্রতিনিয়ত বাড়ছে, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ায় সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করা হলে এর মধ্যে থাকা সব ভারী ধাতুর সংস্পর্শে শ্বাসকষ্ট, চর্ম ও স্নায়ুরোগ এমনকি ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিরও ঝুঁকি রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, নিরাপত্তা মান নিশ্চিত ও নীতিমালা বাস্তবায়নের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। ২০২১ সালে ই-বর্জ্য বিধিমালা প্রয়োগ করা হলেও এখন পর্যন্ত তার সঠিক ও সুষ্ঠু বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, ই-বর্জ্য নীতিমালা-২০২১ জোরালোভাবে বাস্তবায়নের কথা ভাবছে সরকার।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, ইলেকট্রনিক সামগ্রীর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। অধিকাংশ বাড়িতেই এখন রেফ্রিজারেটর শোভা পাচ্ছে, অনেক বাড়িতেই রয়েছে এয়ারকন্ডিশনার। ল্যাপটপ আর কম্পিউটার এখন অধিকাংশ শিক্ষিত শ্রেণির জীবনসঙ্গী। রড তৈরির জন্য ভাঙতে হচ্ছে পুরোনো জাহাজ, পুরোনো জাহাজের মালামালে সৃষ্টি হচ্ছে নানা রকম বর্জ্যের। কয়েক দশক ধরে এ সবকিছুর সঙ্গেই চলছে আমাদের আধুনিক জীবনযাপন। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এসব ইলেকট্রনিক সামগ্রীর ব্যবহার দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এসব সামগ্রীর একটি নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল বা সচল থাকার মেয়াদ থাকে। অকেজো সোলার প্যানেল ও ইলেকট্রিক গাড়িও এখন ই-বর্জ্য। সাধারণত এগুলো স্বল্পায়ু, তাই মেয়াদ শেষ হলে বা ব্যবহারের অযোগ্য হলে সেসব সামগ্রী ভাগাড়ে ছুড়ে ফেলতে হয়। ভাগাড়ে ফেলা এসব সামগ্রীর বর্জ্যই ই-বর্জ্য বা ইলেকট্রনিক-বর্জ্য হিসেবে পরিচিত।
বাংলাদেশে ই-বর্জ্যের মধ্যে মোবাইল বা সেলফোনের ই-বর্জ্য বড় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে জাহাজভাঙাসহ বছরে প্রায় ৩০ লাখ টন ই-বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এর মধ্যে প্রতিবছর প্রায় ৯০০০ টন আসে শুধু মোবাইল ফোন বর্জ্য, প্রতিবছর এর পরিমাণ ৩০ শতাংশ হারে বাড়ছে। সারা পৃথিবীতে ২০২৪ সালে ই-বর্জ্যের উৎপাদন ছিল ৬৩৩ লাখ টন। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালে বিশ্বে ই-বর্জ্যের উৎপাদন হবে ৭৪৭ মিলিয়ন টন। বিশ্বে এশিয়ার দেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশি ই-বর্জ্য তৈরি হয়, যার পরিমাণ ২৪৯ লাখ টন। আমেরিকা ও ইউরোপের চেয়েও আমরা বেশি ই-বর্জ্য তৈরি করি।
এছাড়া স্তূপ করে রাখা এসব ই-বর্জ্য থেকে নির্গত বিষাক্ত পদার্থ বিশেষ করে ভারী ধাতুগুলো ও জৈব যৌগ মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছে। ই-বর্জ্যে থাকে ক্ষতিকর বিভিন্ন ভারী ধাতু, যেমন সিলিকন ডাই-অক্সাইড, পলিয়েস্টার, ফেনল, ফরমালডিহাইড, হ্যালেজিনেটিড পলিমার, নাইট্রোজেনধারী পলিমার ইত্যাদি। ই-বর্জ্যের প্রায় ৬০ শতাংশই বিভিন্ন ভারী ধাতু, বিশেষ করে আয়রন বা লোহা, সিসা, মার্কারি, তামা, ক্যাডমিয়াম এবং ১৫ শতাংশ প্লাস্টিক সামগ্রী। এ ছাড়া এর মধ্যে থাকে টিউব ও স্ক্রিন, কেব্ল, প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড ইত্যাদি। সঠিক ব্যবস্থাপনা করা না হলে পরিবেশদূষণকারী এসব ক্ষতিকর পদার্থ মানুষ ও প্রাণীর মারাত্মক স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সম্প্রতি গবেষকদের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইলেকট্রনিক সামগ্রীগুলোর মধ্যে মোবাইল বা সেলফোনের জীবনকাল সবচেয়ে কম, যা মাত্র ১ থেকে ২ বছর এবং ডেস্কটপ ও ল্যাপটপের জীবনকাল সবচেয়ে বেশি, যা ৭ থেকে ৮ বছর। টেলিভিশনের জীবনকাল ৩ থেকে ৬ বছর। এয়ারকন্ডিশনার যন্ত্রগুলোও সাধারণত সচল থাকে ৫ থেকে ৬ বছর। অধিকাংশ রেফ্রিজারেটর ৮ বছর চলার পর নষ্ট হয়ে যায়। সে সমীক্ষায় আরও দেখা যায়, দেশের শতভাগ মানুষ সেলফোন ব্যবহার করেন, টেলিভিশন আছে ৮০ শতাংশ ঘরে। অথচ এদের ৬৫ শতাংশ মানুষই জানেন না ই-বর্জ্য কী? প্রতিবছর বাংলাদেশে ই-বর্জ্য বাড়ছে ২০ শতাংশ হারে। এর খুব সামান্য পরিমাণ প্রতিবছর রিসাইক্লিং করা হচ্ছে, যার পরিমাণ মাত্র ১৩ থেকে ১৪ হাজার টন।
মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর ই-বর্জ্যের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। পরিবেশে বায়ু, পানি, মাটি ইত্যাদির ওপর ই-বর্জ্যের বিরূপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ই-বর্জ্য যখন ভাঙা বা গলানো হয়, তখন তা থেকে যেসব রাসায়নিক ধাতব দ্রব্য বের হয় সেগুলো বাতাসে মেশে, পানিতে যায় ও মাটিকে দূষিত করে। ই-বর্জ্যের বিভিন্ন কণা ও রাসায়নিক দ্রব্য যেমন ডাইঅক্সিন বায়ুম-লের বাতাসে মেশে। এতে বায়ু দূষিত হয়। শ্বাসের সঙ্গে সেই দূষিত বায়ু দেহে শ্বাসতন্ত্রে প্রবেশ করে, ত্বকের সংস্পর্শে আসে ও মানবদেহে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে। এতে টিউমার ও ক্যানসারের মতো রোগও হতে পারে। ই-বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কারণে তা থেকে নির্গত মার্কারি বা পারদ, লিথিয়াম, সিসা, বেরিয়াম ইত্যাদি ধাতবদ্রব্য মাটির গভীরে প্রবেশ করে, এতে মাটি ও পানি দূষিত হয়। এরূপ মাটির নিচ থেকে যে পানি তোলা হয়, তাতেও এসব ধাতুর কণা পাওয়া যায়। ওপর থেকে এসব ধাতবদ্রব্য বৃষ্টির পানিতে মিশে চলে যায় পুকুর, খাল ও নদীতে। কাজেই সেসব পানিও দূষিত হয় ও জলজ জীবের আবাসস্থল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এর ফলে পরিবেশে সামগ্রিক পরিবেশতন্ত্রে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
পরিবেশবিদ অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, সীসা, পারদ ও নিকেল পানিতে মিশে পানিকে দূষিত করে। এতে উদ্ভিদ ও প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীকালে শাক-সবজিসহ বিভিন্ন রকম ফসল এবং ফলের মাধ্যমে সেগুলো আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। মানবাধিকার সংগঠন ‘ভয়েজ’-এর একটি গবেষণা বলছে, এ বর্জ্য সংগ্রহের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৫০ হাজার শিশু, যাদের প্রায় ১৫ ভাগই প্রতি বছর ই-বর্জ্যের সংস্পর্শে আসার কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ই-বর্জ্য পরিবেশ দূষণের একটি নতুন উপকরণ। ব্যবহারের পর বিভিন্ন ধরনের ইলেক্ট্রনিক্স দ্রব্য যখন অচল বা সচল অবস্থায় ফেলে দেয়া হয়, সেটাই ই-বর্জ্য। বাংলাদেশে বছরে এটি সৃষ্টি হয় ৩০ লাখ মেট্রিক টন। সাধারণত প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারের পর ফেলে দেয়া হচ্ছে ডাস্টবিনে। সেগুলো মিশছে মাটিতে, হচ্ছে দূষণ। এসব বর্জ্য থেকেই তৈরি হচ্ছে সীসা ও ক্যাডমিয়ামের মতো ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান। তবে এ বিপুল পরিমাণ ই-বর্জ্য সামলাতে বাংলাদেশ কি প্রস্তুত?
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে পুরনো কিংবা নষ্ট ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করেন এমন কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা শ্বাসকষ্ট, কাশির মতো রোগে ভোগেন প্রায়ই। চিকিৎসকরা সতর্ক করছেন, ই-বর্জ্যে থাকা বিভিন্ন ভারী ধাতুর দূষণ রোধ করা না গেলে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়বে দিন দিন।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আবু সাঈদ শিমুল বলেন, আমরা যেন এসব বর্জ্য যত্রতত্র না ফেলি। একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রিসাইকেলও করা যায়। এছাড়া যারা হ্যান্ডলিংক করবেন, তারা যেন অন্তত মাস্ক ও গ্লাভস পরেন। এ অবস্থায় এ থেকে উত্তরণে ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুমোদনের পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের।
এ বিষয়ে অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ফরমাল সেক্টরে রিসাইক্লিংয়ের দরকার আছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ বা যারা ব্যবসা করছেন, তাদেরকে প্রণোদনা দিয়ে ফরমাল সেক্টরে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে অনুমোদন দেয়া যেতে পারে।
এদিকে রাজধানীতে বর্জ্যব্যবস্থাপনায় অনিয়ম চলছে। দেড় দশক ধরে ঘুরে ফিরে ৪টি প্রতিষ্ঠানই পাচ্ছে কাজ। ঢাকা উত্তর সিটির বর্জ্যব্যবস্থাপনায় অনিয়মের অভিযোগ অন্য ঠিকাদারদের। এতে সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম ও তার স্বজনদের জড়িত থাকার অভিযোগও তাদের। ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) বলছে, শিগগিরই নতুন দরপত্র আহ্বান করা হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোটি পরিবারের বসবাস ঢাকা শহরে। প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে মানুষ প্রতিদিনই তৈরি করছে প্রায় সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টন বর্জ্য। আর এ বর্জ্য বাসাবাড়ি থেকে সংগ্রহ করে আমিনবাজার বা মাতুয়াইলে ময়লার ভাগাড়ে পৌঁছে দিতে অনিয়মের অভিযোগ অনেকের। বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে প্রথমে নেয়া হয় সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশনে (এসটিএস)। সেখান থেকে সে বর্জ্য যায় মাতুয়াইল বা আমিনবাজারে ময়লার ভাগাড়ে। ১৬ বছর ধরে ঘুরে ফিরে ৪ জন ঠিকাদারই পাচ্ছেন সে কাজ। কয়েকজন ঠিকাদার অভিযোগ করছেন, টেন্ডারে এমনভাবে শর্ত দেয়া হতো, যাতে ঘুরেফিরে ৪টি প্রতিষ্ঠানই কাজ পায়। এমনকি সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের কয়েকজন স্বজন এতে জড়িত বলেও মনে করেন তারা। ডিএনসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফিদা হাসান বলেন,এটি সংশোধন করা হবে। ১৭ তারিখে টেন্ডার ওপেন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিভিন্ন আবেদন পেয়েছি। তাই আমরা সেগুলোকে বিবেচনায় নিচ্ছি, যাতে সর্বোচ্চ অংশগ্রহণকারী নিতে পারি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অনিয়ম স্থায়ীভাবে বন্ধে সিটি করপোরেশনের বেশকিছু নিয়ম-কানুনের সংস্কার প্রয়োজন। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, নাগরিক সেবা দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর দীর্ঘদিনের অসুখ নিরাময় করা না গেলে শুধু সিদ্ধান্ত নিয়ে বা কিছু নিয়ম-কানুন পরিবর্তন করে অবস্থার পরির্তন করা যাবে না। অনিয়ম বন্ধে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বা যে রূপে পরিচালনা করা দরকার, সেটি স্থায়ীভাবে করা প্রয়োজন। নাগরিক সেবা বাড়াতে করপোরেশনগুলোকে উদ্যোগী হওয়ারও পরামর্শ দেন এ বিশ্লেষক।