কুলির হাতেও ছিলো আলাদীনের চেরাগ!

- আপডেট সময় : ০২:১৩:৫৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫ ২৯ বার পড়া হয়েছে
কুলি থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আসাদুজ্জামান খান কামালের ক্যাশিয়ার খ্যাত মোশাররফ হোসেন। খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার এই সক্রিয় নেতা কারওয়ানবাজারের তৈরি করেছেন টাকার খনি। পেশীশক্তি অর্জনে হয়ে পরেন শীর্ষ চাঁদাবাজ পিচ্ছি হান্নানের সহযোগী। হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি মোশাররফ অবশেষে গ্রেপ্তার হয় রাজধানীর অভিজাত এলাকা থেকে
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে পরিচিত মোশাররফ হোসেন ওরফে মিনতি বা কুলি মোশাররফকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ২০১৫ সালের এপ্রিলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী তাবিথ আউয়ালের পক্ষে প্রচার চালানোর সময় কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ারার সামনে খালেদা জিয়ার গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। গতকাল শুক্রবার রাতে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেন। গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১ টায় গুলশান থানা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার মোশাররফ হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি। তার বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে বোমা বিস্ফোরণের মামলাও রয়েছে।
তিনি আরও জানান, মোশাররফ তেজগাঁও থানা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক এবং গোসাইরহাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১৫ সালের এপ্রিলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী তাবিথ আউয়ালের পক্ষে প্রচার চালানোর সময় হামলার ঘটনা ঘটে।
গত ২০২৪ সালের ২২ আগস্ট এ ঘটনায় মামলা হয়। মামলায় অভিযোগ করা হয়, নির্বাচনী প্রচার চালানোর সময় খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা হামলা চালিয়েছিল। গ্রেপ্তার আসামিকে আদালতে প্রেরণ করা হলে আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
কারওয়ানবাজারের একাধিক প্রবীন ব্যবসায়ী বলেছেন, নক্কই দশকে খাদ্যের অন্বেসনে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে আসে মোশারফ। অপরিচিত বিধায় প্রথম অবস্থায় স্থানীয় কাঁচাবাজারে মিনতির কাজ শুরু করে। পাশাপাশি মাসে ৩০ টাকা বেতনে মাছের আড়তে কাজ নেন। অবসর সময়ে মেশিনে বস্তা সেলাই করেও টাকা উপার্জন করতেন। তিনি স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ী আকতার, আলেকের আড়তে কাজ শুরু করেন। এসময় কারওয়ানবাজারের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রন নেয় লোকমান ও ভিসি ফয়েজ, আলমগীর, মোশারফ ও পিচ্ছি হান্নানেরর সন্ত্রাসিরা। তাদের সঙ্গে মিলে কারওয়ান বাজারের কাঁচামাল, মাছ, ফল মাংস, চাল ডালসহ সব কিছুরই নিয়ন্ত্রন নেয় মোশারফ। পাশাপাশি কারওয়ান বাজারের চাঁদাবাজির টাকার একটি বড় অংশ তৎকালিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে দিতেন। ক্রমান্বয়ে মোশারফ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশ্রয়ে পুরো কাওয়ান বাজারের চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রন নেয়। হাতে পেয়ে যায় আলাউদ্দিনের চেরাগ। চাঁদাবাজির টাকা নিয়ে ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে বিরোধে আকতারসহ প্রায় এক ডজন ব্যবসায়ী খুন হয়েছেন। পিচ্ছি হান্নান ও তার সহযোগিরা ক্রস ফায়াওে মারা যাওয়ার পরইকারওয়ান বাজারের টাকার খনি মোশারফের হাতে চলে যায়। আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের রাজত্বে মিনতি মোশারফ বনে যান হাজার কোটিপতি। তার গ্রামের বাড়ি শরিয়তপুরের গোসাইরহাটে । হত্যাসহ এক ডজন মামলা থাকা স্বত্বেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালের ক্ষমতার দাপটে নির্বাচনী হলফনামায় সব কিছু গোপন কওে আওয়ামীলীগের টিকেটে উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যানের মনোয়রপত্র কেনেন। কামালের ঈশারায় পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় নির্বাচনে পাশও কওে চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। তারপর থেকে তাকে আর পিছু তাকাতে হয়নি। ৭ আগষ্ট ফ্যাসিষ্ট সরকারের পতনের পরই মোশারফ পালিয়ে দেশ ছাড়েন। সম্প্রতি তিনি বিএনপির এক নেতার গ্রীন সিগন্যাল পেয়ে দেশে আসেন। বৃহস্পতিবার রাতে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে একটি সমঝোতা রফাদফার জন্যই গুলশানের ঐই নেতার বাড়িতে যাওয়ার পথে আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন।
অভিযোগ রয়েছে, তেজগাঁও থানা শ্রমিক লীগের সভাপতি আবুল কাশেমের নেতৃত্বে চলা শুধু শ্রমিক লীগের কার্যালয়টিই নয়, তেজগাঁও থানা এলাকায় আওয়ামী লীগ এবং এর আরও কয়েকটি অঙ্গ সংগঠনের কার্যালয় থেকেও নিয়ন্ত্রণ হতো কারওয়ানবাজারকেন্দ্রিক চাঁদাবাজি। পাঁচটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তেজগাঁও থানা যুবলীগের একটি, ২৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের একটি, কৃষক লীগের একটি, ১ নম্বর রেলগেটে ছাত্রলীগের একটি, থানার অন্তর্গত আওয়ামী লীগের ১১টি ইউনিট কার্যালয়। এসব কার্যালয় থেকে কারওয়ানবাজারের ফুটপাত, পরিবহন, মাছ বাজারসহ ১৩টি খাত থেকে দৈনিক ১ কোটি ২০ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হতো।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নানের ভগ্নিপতি আমির চেয়ারম্যান, হান্নানের চাচাতো ভাই তাজু, হান্নানের ভাতিজা শাহীন ও মিন্টু, নাজমুল আলম রনি, হান্নানের সাবেক সহযোগী দাঁড়িওয়ালা বাশার, শীর্ষ সন্ত্রাসী আলীর ছোট ভাই চাকমা আক্তার, খালেদ রানা, ফাহিম, মো. আলী, সবুজ, নাডা জসিম, টিপু সুলতান, আক্তার, হুমায়ুন, বিএসসি ফারুক, জসিম, আমজাদ হোসেন খাঁন, বাদল ব্যাপারী, কালা মোস্তফা, রাজিব হোসেন জয়, হান্নান, মফিজ মাঝির চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ ছিলেন ব্যবসায়ীরা। খুনসহ নানা ধরনের হুমকি দিয়ে অগ্রিম ও মাসিক চাঁদা আদায় করে আসছিল তারা।
কাওরানবাজারের ফলপট্টি, ওয়াসাপট্টি, এরশাদপট্টি, সিটি করপোরেশনের সামনে, হোটেল ঝাড়ুপট্টি, জুতাপট্টি, আলীপট্টি, রেলওয়েপট্টি, কিচেনপট্টি, মুরগিপট্টি, সুরমাপট্টি, মুড়িপট্টি, একুশে টিভিপট্টি, পেঁপেপট্টি, লাল বিল্ডিংয়ের পূর্ব ও দক্ষিণপট্টি, মসজিদপট্টি ছাড়াও কয়েকটি পট্টি থেকে লোকমান বাহিনী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অগ্রিম বাবদ প্রায় ৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতি রাতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কাঁচামাল নিয়ে কারওয়ানবাজারে আসা সহস্রাধিক ট্রাক থেকে ৫০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করত চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের দপ্তরে কারওয়ানবাজারের একানব্বই জন ব্যবসায়ীর নাম-ঠিকানা ও কোন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মাসিক কত টাকা হারে চাঁদা নেওয়া হয়, তা উল্লেখ করে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে একটি অভিযোগ দেন চাঁদাবাজির শিকার জসিম পাটোয়ারী।
চাঁদাবাজির বিশাল এই সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করা হতো তেজগাঁওয়ের মনিপুরিপাড়া লায়ন মার্কেট কমপ্লেক্সের দোতলায় অবস্থিত তেজগাঁও থানা আওয়ামী লীগের কার্যালয় থেকে। দৈনিক চাঁদার টাকা এক জায়গায় করে তা পুলিশ, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও কতিপয় সাংবাদিকের কাছে ভাগ-বণ্টনের দায়িত্বে ছিলেন তেজগাঁও থানা আওয়ামী লীগ নেতা মোশারফ হোসেন, শ্রমবিষয়ক সম্পাদক আলমগীর হোসেন লাতু। আর তেজগাঁও থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যাপক আব্দুর রশিদ ও সাধারণ সম্পাদক শামীম হাসান শামীমের (২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর) মাধ্যমে চাঁদার ভাগ পৌঁছে যেত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের কাছে।
জানা গেছে, কারওয়ানবাজারের মাঠপর্যায়ে চাঁদাবাজির বড় একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করা হতো কিচেন মার্কেটের ছাদের ওপর ঢাকা মহানগর উত্তর ২৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেনের কার্যালয় এবং শ্রমিক লীগের সভাপতি আবুল কাশেমের কার্যালয় থেকে। কারওয়ানবাজারের চাঁদাবাজির অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন লোকমান হোসেন ও মোশারফ হোসেন। মোশারফ ও লোকমান, কাশেম এলাকা ছেড়ে পালানোর পর এই দুটি অফিস নিয়ন্ত্রণে নেয় বেলাল হোসেন নামে এক ব্যক্তি। মাছ বাজারের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করা হতো জাতীয় শ্রমিক লীগ তেজগাঁও থানার কার্যকরী সম্পাদক ও থানা আওয়ামী লীগের ক্রীড়া সম্পাদক মোশারফ হোসেনের কার্যালয় থেকে। এই সিন্ডিকেট এখন জালাল মোল্লা, জসিম ও অপুর ভাগিনার দখলে। এ ছাড়া আজিজুর রহমান, মুসা, বাবু, মাসুদও দখলে রেখেছেন একাধিক খাত। তাদের শেল্টার দিচ্ছেন আনোয়ার ও এল রহমান। নেপথ্যে আছেন সাইফূল আলম নিরব।
এদিকে চাঁদাবাজদের আক্রমণের শিকার হয়ে শাহাদাত হোসেন সর্দার ও জসিম পাটোয়ারী নামে দুই ব্যবসায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দপ্তর, ডিএমপি কমিশনারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাননি। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা তেজগাঁও থানায় অসংখ্য সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। দিয়েছেন মৌখিক অভিযোগও। তবে চাঁদাবাজদের সঙ্গে সখ্য থাকায় ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। মোশারফ লোকমান ছাড়াও মিজান, সায়েম ও হেলালসহ দেড়শ চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী একরকম জিম্মি করে রেখেছিল সাধারণ ব্যবসায়ীদের। চক্রটি কারওয়ানবাজারের ১৭ পট্টির ছোটবড় হাজারও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসে কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকা চাঁদা হাতিয়ে নিত। এর মধ্যে মাছ বাজার থেকেই আসত দৈনিক ২০ লাখ টাকা। রাস্তায় ঘাটে ঘাটে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হতো পণ্যবাহী যানবাহনগুলোকেও। এসব কারণে সবজিসহ অন্যান্য পণ্যের দামও বেড়ে যায়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ডিএমপি কমিশনারের দপ্তরে লিখিত অভিযোগে ব্যবসায়ীরা জানান, কারওয়ানবাজার কিচেন মার্কেটের নিচতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত ৪৫০ দোকান থেকে দোকানপ্রতি মাসে ১ হাজার ১৫০ টাকা করে চাঁদা আদায় করে সন্ত্রাসীরা। ওয়াসা গলির ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসে জনপ্রতি আদায় করা হয় ২৫ হাজার টাকা চাঁদা।
তেজগাঁও থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, সেনাসদস্যদের পাহারায় তেজগাঁও থানার কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু হয়েছে। আহত দুজন ছাড়া আমাদের সব পুলিশ সদস্য কর্মস্থলে যোগদান করেছেন। সেনাসদস্যদের নিয়ে আজকেই আমরা প্যাট্রোলিং কার্যক্রম শুরু করছি। চাঁদাবাজরা আপাতত ঠা-া রয়েছে।