পুরো সড়কই যেন বাস স্টপেজ
- আপডেট সময় : ১২:৪৫:৩৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ৩৩০ বার পড়া হয়েছে
রাজধানী ঢাকার মতোই চট্টগ্রাম মহানগরীর সড়কগুলোতে বেহালদশা। মহানগরীর গণপরিবহনে চলছে চরম বিশৃঙ্খলা। আইন বা নিয়ম মানার কিংবা মানানোর গরজ নেই কারও। আইন মানাতে কোনো কার্যকর ভূমিকা নেই ট্রাফিক বিভাগের। কাপ্তাই রাস্তার মাথা, সিঅ্যান্ডবি, ষোলশহর রেলস্টেশন, ওয়াসা, লালখান বাজার, নিউমার্কেট, কোতোয়ালি মোড়, লালদীঘি মোড়, আন্দরকিল্লা মোড়, অক্সিজেন মোড়, ইপিজেড মোড়, কাস্টমস মোড়, তিন নম্বর গেট, বারিকবিল্ডিং মোড়ের চিত্র একই। এসব স্থানে ’বাস থামিবে না’ সাইনগুলোর স্থানে দেখা যায় ঠিক উল্টো চিত্র। যেখানে-সেখানে বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী উঠানো যেন নিয়মে পরিনত হয়েছে।
বেশীরভাগ পথচারির বক্তব্য- ট্রাফিকের গাফলতিতে যানজটের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। এই প্রতিবেদকের সাথে স্থানীয় সাংবাদিকদের একটি টিমের দেখা হয়। সহকর্মীদের সহযোগিতায় গত কয়েকদিন সরেজমিনে নগরীর বেশ কয়েকটি মোড়ে অবস্থান নেয় এই প্রতিবেদক। দেখা যায় যত্রতত্র ব্যস্ত মোড়গুলোতে প্রতিযোগিতা করে যাত্রী ওঠাতে-নামাতে সড়কের মাঝখানে আড়াআড়ি করে গাড়ি রাখার প্রবণতা। বিশেষ করে নগরীতে নির্ধারিত স্থানে যাত্রী ওঠানামার জন্য সিএমপির নির্দেশনা একেবারেই কার্যকর হচ্ছে না বলে অভিযোগ যাত্রীদের।
প্রায় ৬০ লাখ মানুষের বাস চট্টগ্রাম মহানগরীতে। নগরীতে চলাচল করে প্রায় সাড়ে তিন লাখ যান্ত্রিক যানবাহন। পাশাপাশি আছে তিন লাখের বেশি প্যাডেলচালিত রিকশা। এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণে হিমশিম চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। নগরীজুড়ে যত্রতত্র পার্কিং, ট্রাফিক নির্দেশনা না মানা, অবৈধ যানবাহন চলাচল করার কারণে অব্যবস্থাপনা দেখা দিয়েছে নগর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায়। দুর্ঘটনা, প্রতারণা কিংবা যানজটে নাকাল হয়ে যার মাশুল গুনতে হচ্ছে নগরবাসীকেই।
নগরীর চৌমুহনী মোড়ে বাস থামিবে না সাইনবোর্ডের সামনেই দাঁড়িয়ে যাত্রী নিচ্ছেন ১০ নম্বর রুটে চলাচলকারী শাহ আমানত নামে চট্টমেট্রো-জ-১১-১৬৫১ নম্বরের ইপিজেডগামী বাসটি। এসময় দায়িত্বরত ট্রাফিক সদস্যরা বাসগুলোকে সরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছেন। গত বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টার দৃশ্য ছিলো এটা। গত মঙ্গলবার দুপুরে নগরীর আগ্রাবাদ ডিউ দুবাই সেন্টারের সামনে বাস থামিবে না সাইনবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করছিল ৭ নম্বর রুটে চলাচলকারী চট্টমেট্রো-জ-১১-১৭৭৭ নম্বরের লুসাই পরিবহনের বাসটি। অথচ ওই বাসটির মাত্র ৫০ হাত পেছনেই নগর ট্রাফিকের পশ্চিম এবং বন্দর দুই বিভাগের উপ-কমিশনারের কার্যালয়। জিইসি মোড়ে অপেক্ষামান এক বাসযাত্রী বলেন, বাসগুলোকে মোড়ে না দাঁড়ানোর নির্দেশনা দেয়া আছে। কিন্তু তারা মানে না। মামলাও দিচ্ছে ট্রাফিক সার্জেন্টরা। তারপরও মোড়ে দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয় বাসগুলো। যাত্রীরাও সচেতন নন, তারা মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। ওই মোড়ে দাঁড়ানো আলম নামে এক যাত্রী বলেন, বহদ্দারহাট যাবো। যেখানে বাস থামিবে সাইন আছে, ওখানে বাস যায় না। আবার মোড় থেকে ওই স্থানে যেতে যেতে বাস যাত্রীতে পূর্ণ হয়ে যায়। যে কারণে ইচ্ছা না থাকলেও বাসে ওঠার জন্য মোড়ে দাঁড়াই। এখানে ট্রাফিকরা যদি নির্ধারিত স্থানে দাঁড়ানোর জন্য বাসগুলোকে বাধ্য করতেন, তাহলে ধীরে ধীরে যাত্রীরাও অভ্যস্ত হয়ে যেতেন। পুরো বিষয়টি ট্রাফিকের মর্জির ওপর নির্ভর করে।
একই চিত্র আগ্রাবাদ মোড়ের বিসিক ভবনের সামনেও। সাগরিকা থেকে আসা ৭ নম্বর রুটের বাসগুলো বামদিকে চলাচলের একমাত্র লেনটি পুরোটাই দখল করে যাত্রী ওঠায়। যে কারণে পেছনের গাড়িগুলোকে প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয় দীর্ঘক্ষণ। সামনেই ১০ নম্বর রুটে চলাচলকারী একটি হিউম্যান হলার দাঁড়িয়ে থাকলেও কোনো জবাবদিহিতা নেই। নগরীর কালুরঘাট, নতুন ব্রিজ, নিউমার্কেট, লালদীঘিগামী বাসগুলোও ট্রাফিক সার্জেন্টের সামনেই সড়কের মাঝখানে কিংবা বাস থামিবে না সাইনবোর্ডের সামনেই দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো করছে। আবার একই রুটের পেছনের গাড়িকেও আটকানোর জন্য আড়াআড়ি করে রাস্তায় দাঁড়ায় বাসগুলো। ওই স্পটে দায়িত্ব পালন করা এক কনস্টেবল হাতে থাকা লাঠি দিয়ে দু-একটি গাড়িতে আঘাত করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিলেও বাসের চালক-সহকারীদের তাতে কোনো হেলদোল থাকে না।
ব্যস্ততম বক্সিবিট এলাকায়ও একই অবস্থা। এখানে নিউমার্কেট থেকে ছেড়ে আসা কালুরঘাটগামী হিউম্যান হলার, মুরাদপুরগামী টেম্পুগুলো ছোট সড়কে দাঁড়িয়ে যাত্রী ডাকে। আর পেছনে গাড়ির জটলা লালদীঘি পাড় পর্যন্ত পেরিয়ে যায়। একইভাবে নিউমার্কেটগামী হিউম্যান হলার ও কোতোয়ালি মোড়গামী টেম্পুর কারণে টেরিবাজার মুখ থেকে ক্ষেত্রবিশেষে আন্দরকিল্লা পর্যন্ত পরিবহনের জটলা তৈরি হয়। স্থানীয় পথচারী ও যাত্রীদের অভিযোগ, বক্সিরবিট মোড়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্রাফিক সদস্যদের অনীহার কারণেই এখানে দিনের বেশিরভাগ সময় যানজট লেগে থাকে। নতুন কার্যকর হওয়া ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ মোতাবেক নির্দেশনা না মেনে যাত্রী ওঠানামা করলে জরিমানার বিধান রয়েছে। অথচ লোকাল বাসগুলো নির্দেশনা মানছে না। ট্রাফিক পুলিশের অবহেলার কারণেও বাসগুলো নির্ধারিত স্থানে যাত্রী ওঠানামায় আগ্রহী হচ্ছে না। একই মোড়ে আখতারুজ্জামান সেন্টারের সামনে কথা হয় জাফরুল আনোয়ার নামে এক যাত্রীর সঙ্গে। তিনি বলেন, বাস থামিবে লেখা স্থানে কোনো বাসই দাঁড়ায় না। যে কারণে বাধ্য হয়ে মোড়ে এসে বাসে উঠতে হয়। সব সময় একই বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। অথচ প্রত্যেক মোড়ে মোড়ে অনেক ট্রাফিক পুলিশ রয়েছে।
সিএমপির উপ-কমিশনার (ট্রাফিক-বন্দর) মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীতে যত সংখ্যক গণপরিবহন রয়েছে, সে অনুপাতে স্টপেজ নেই। বাস দাঁড়ানোর কোনো স্টপেজ নেই। তারপরেও সড়কে শৃঙ্খলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যস্ত মোড়গুলোতে বাসগুলো দাঁড়ানো-না দাঁড়ানোর বিষয়ে নির্দেশনা সম্বলিত সাইনবোর্ড দেওয়া আছে। আমরা এসব নির্দেশনা কার্যকরে গুরুত্ব দেই। অনেক সময় যারা এসব নির্দেশনা মানেন না, তাদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন দেই। তাছাড়া আমরা গণপরিবহনের চালক-সহকারীদের মোটিভেট করার চেষ্টা করছি, তারা যাতে নির্ধারিত স্থানে যাত্রী ওঠানো-নামানো করেন। সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়া বলেন, নগরীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এলোমেলো বাস দাঁড়ানোর কারণে যানজট তৈরি হয়। এ যানজট নিরসনে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ চৌরাস্তার মোড়ে বাস থামার জন্য স্থান নির্ধারিত করে দেওয়া আছে। এসব নির্দেশনা মানাও হয়। কোনো ক্ষেত্রে না মানলে বাসগুলোকে আইনের আওতায় আনা হয়। মামলা দেওয়া হয়। তারপরেও চট্টগ্রাম মহানগরের পরিধি বেড়েছে। সে অনুপাতে জনবল কম। জনবল সংকট নিরসনে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।