বায়ুদূষণেও কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ

- আপডেট সময় : ১২:১৮:৫৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ১৬৬ বার পড়া হয়েছে
ভয়াবহ বায়ু দূষনে ঢাকাসহ সারা দেশে নিউমোনিয়া ও ব্রংকাইটিজে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। পাশাপাশি হাসপাতালেও বাড়তে শুরু করেছে এ ধরনের রোগী। ঢাকার শিশু হাসপাতাল ছাড়াও চারটি সরকারি হাসপাতালে প্রতিদিনই শ্বাসকষ্ট বা ব্রংকাইটিজ ও নিউমোনিয়া রোগী ভর্তি হচ্ছে। এই পাঁচ হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসে দ্বিতীয় সপ্তাহের হিসেব মতে ব্রংকাইটিজ এবং নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ৬৭০ শিশুকে ভর্তি করা হয়েছে। গত জানুয়ারী মাসে এমন উপসর্গেও রোগীর সংখ্যা ছিল ৩০৭ জন। বহির্বিভাগেও এই রোগে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। আর আক্রান্তদের মধ্যে শিশু বেশি। মারাও যাচ্ছে প্রতিদিন গড়ে তিনজন করে।
অপরদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে মোট শিশুমৃত্যুর প্রায় ১৮ শতাংশই হয় ব্রংকাইটিজ আর নিউমোনিয়ায়। বাংলাদেশে প্রতি ঘণ্টায় দুই থেকে তিনজন শিশু শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ায় মারা যায়। প্রতিবছর মারা যায় কমপক্ষে ২৪ হাজার ৩০০ শিশু। আর এই আক্রান্তদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতালগুলোকে। এক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হাসপাতালের আইসিইউ বিছানা সংকট। এর ফলে রোাগী মৃত্যুও বেড়েছে। রাজধানীর বাইরের জেলা শহরগুলোর অবস্থা আরও নাজুক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্প্রতি ভয়াবহ বায়ুদূষণের প্রভাবেই শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়া রোগী বাড়ছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে প্রতিবছরই এই হার বাড়ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, মুগদা সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল এবং কয়েকটি প্রথম শ্রেণির বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, নিউমোনিয়ায় আক্রান্তরা যখন অতিরিক্ত শ্বাসকষ্টে ভোগে, তখন পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নেয়। বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না থাকায় অনেককে ছুটতে হয় বেসরকারি হাসপাতালের দিকে। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালের খরচ বহন করা সবার পক্ষে সম্ভব না হওয়ায় অনেকেই ভাগ্যের হাতে রোগীকে ছেড়ে দেন।
ঢাকার চারটি সরকারি হাসপাতালের সূত্রমতে, তারা তাদের সাধ্যমতো চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু যখন আইসিইউ প্রয়োজন দেখা দেয়, তখনই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কোনো হাসপাতালেই শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত আইসিইউ নেই।
শুধু ঢাকা শিশু হাসপাতাল অ্যান্ড ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে পাও্য়া তথ্যমতে, চলতি বছরের গত মঙ্গলবার পর্যন্ত পাঁচ হাজারের মতো শিশু নিউমোনিয়া নিয়ে এই হাসপাতালে ভর্তি হয়। ২০২৩ সালে ভর্তি ছিল সাড়ে তিন হাজার এবং তার আগের বছর ২০২২ সালে তিন হাজার। অর্থাৎ এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। আইসিইউ সংকটে তাদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আইসিডিডিআরবির তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে শীর্ষ পাঁচটি সংক্রামক রোগের মধ্যে নিউমোনিয়া একটি। সংক্রামক রোগে শূন্য দশমিক ৭ মিলিয়ন মৃত্যুর ১৪ শতাংশ নিউমোনিয়ায়। বাংলাদেশে প্রতি ঘণ্টায় দুই থেকে তিনজন শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। প্রতিবছর মারা যায় কমপক্ষে ২৪ হাজার ৩০০ জন শিশু। শিশুদের ৫২ শতাংশই মারা যাচ্ছে বাড়িতে এবং কোনো ধরনের চিকিৎসা না পেয়েই।
তথ্য অনুযায়ী, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে প্রতিবছর ৯৩ লাখ ৫০ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়। নিউমোনিয়ার ঝুঁকিতে থাকা দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের ১৫ নভেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে শীতজনিত নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে এক লাখের বেশি।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিআর,বি) দেওয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর পাঁচ বছরের কম বয়সি ৮০ হাজারের মতো শিশু ভাইরাল নিউমোনিয়ায় ও বিভিন্ন ধরনের রেসপিরেটরি সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। পাঁচ বছরের কম বয়সিদের শতকরা ২৮ ভাগ মৃত্যুর কারণ এই শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়া।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, দ্রুত শনাক্ত করা গেলে এতে শতভাগ রোগী সুস্থ হওয়া সম্ভব। নির্মূলে প্রয়োজন সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা। সরকারের পাশাপাশি কাজে লাগাতে হবে এ খাতে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও। সারা দেশের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তা গবেষণার মাধ্যমে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা গেলেই ঠেকানো সম্ভব এ রোগের প্রাদুর্ভাব। এক্ষেত্রে কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী বা মাঠপর্যায়ে যারা স্বাস্থ্যকর্মী আছেন, তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। অভিভাবকদেরও সতর্ক থাকতে হবে। শিশুদের এমন কোনো পোশাক পরানো যাবে না, যাতে সে ঘেমে যায় এবং ঘাম শুকায় না। তাপমাত্রার সঙ্গে মানানসই পোশাক পরাতে হবে। শিশুদের শরীরে ইয়েলো ভ্যাট থাকে, যা শরীর গরম করে। তাই তাদের গরম বেশি শীত কম। আলো-বাতাসময় পরিবেশে বাস করতে হবে।
এ ব্যাপারে কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঠান্ডাজনিত রোগ বিশেষ করে নিউমোনিয়ার অন্যতম প্রধান কারণ বায়ুদূষণ। শীত এলেই বেড়ে যায় নিউমোনিয়ার সমস্যা। শীতকালে আর্দ্রতা কমে যায় এবং ধূলিকণার মাত্রা বেড়ে যায়। এ সময় সঠিক সুরক্ষার অভাবে শিশু থেকে বয়স্ক সবাই নিউমোনিয়ার সমস্যায় ভুগতে পারে। তবে শিশুদের শ্বাসতন্ত্র অন্যান্য বয়সের তুলনায় কম বিকশিত হয় এবং তারা বেশিরভাগই বাতাসে আসা ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে আক্রান্ত হয়। ফলে আক্রান্তের হিসেবে তাদের সংখ্যাই বেশি। আসলে ফুসফুসের সংক্রমণের কারণেই এই রোগ হয়। ফুসফুসে পানি জমেও হতে পারে নিউমোনিয়া। অল্প থেকে ক্রমশ গুরুতর আকার ধারণ করে এই রোগ। ঠান্ডা লেগে বুকে শ্লেষ্মা জমে থাকার কারণেই মূলত এই রোগের বিস্তার ঘটে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তারাই এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়।
তিনি বলেন, যাদের অ্যালার্জি আছে তাদের হাঁচি এবং অন্যান্য অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া বেড়ে যায় ও পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। ধুলাবালির পাশাপাশি ভাইরাসের বিস্তারও তীব্র হয়, ফলে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। গুরুত্বপূর্ণ হলো নিউমোনিয়া থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা। এজন্য মেনে চলতে হবে কয়েকটি নিয়ম। ঝুঁকি এড়াতে নিউমোনিয়ার টিকা নিতে হবে। বারবার হাত ধুতে হবে, গরম পোশাক পরতে হবে, প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে, স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে এবং ঠান্ডা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে।
চিকিৎসক বলেন, নিউমোনিয়ার আবার কিছু সাধারণ প্রকার রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে, অর্জিত নিউমোনিয়া (ঈঅচ), হাসপাতাল-অর্জিত নিউমোনিয়া (ঐঅচ), ভেন্টিলেটর-অ্যাসোসিয়েটেড নিউমোনিয়া (ঠঅচ), ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া ভাইরাল নিউমোনিয়া, মাইকোপ্লাজমা নিউমোনিয়া, ছত্রাক নিউমোনিয়া, শ্বাসাঘাত নিউমোনিয়া, অ্যাটিপিকাল নিউমোনিয়া, হাঁটা নিউমোনিয়া ইত্যাদি। এর সবগুলোই গুরুতর, যদি সময়মতো চিহ্নিত না হয় আর চিকিৎসা না পায়।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মাহবুবুল হক জানান, তাদের এখানে প্রতিদিনই ঠান্ডাজনিত শিশু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এসব রোগে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুরা বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। দূষিত বাতাসের সঙ্গে ঠান্ডা আবহাওয়ায় অ্যালার্জিজনিত সমস্যা বাড়িয়ে তুলছে।