আবারও ভাঙনের মুখে জাপা

- আপডেট সময় : ১১:০০:০৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫ ১৬ বার পড়া হয়েছে
একা হয়ে যাচ্ছেন জিএম কাদের, রওশনসহ বাকিদের নেতৃত্বে আসছে নতুন জাপা
সপ্তমবারের মতো ভাঙনের মুখে প্রয়াত স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি (জাপা)। দলের গঠনতন্ত্রের ‘বিতর্কিত’ ২০(ক) ধারাকে কেন্দ্র করে ফের ভাঙতে যাচ্ছে জাপা। একইসঙ্গে দলের বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদেরকে শীর্ষপদ থেকে সরাতে জোট বেঁধেছে বর্তমান কমিটির শীর্ষ নেতাদের একাংশ। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন দল থেকে ২০(ক) ধারার ক্ষমতাবলে ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বহিষ্কার হওয়া নেতারা। তবে জিএম কাদেরপন্থি নেতাদের অভিযোগ, এই ভাঙনের পেছনে অতীতের মতো সরকারি ইন্ধন রয়েছে।
জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন, দলের গঠনতন্ত্রের ২০(ক) ধারা অনুযায়ী জাপা চেয়ারম্যান কারণ দর্শানো ছাড়াই দলের যে কাউকে পদ থেকে সরাতে পারেন, বহিষ্কার করতে পারেন। যে কাউকে যেকোনো পদ দিতে পারেন। এজন্য তাকে জবাবদিহিতা করতে হয় না। যে কারণে দলের বর্তমান কমিটির সিনিয়র নেতাদের বড় একটি অংশ বর্তমান চেয়ারম্যানকে এই ধারা সংশোধন করার অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি তা পরিবর্তন করতে আগ্রহী নন। তাই এই অংশটি যেকোনো সময় পদ হারানোর ভয়ে এখন জিএম কাদেরকে একঘরে করে ২৮ জুন সম্মেলন করতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন জাতীয় পার্টি থেকে বিভিন্ন সময় পদ হারানো নেতারা। গত ২০ মে জাপার প্রেসিডিয়াম সভায় সিদ্ধান্ত হয় ২৮ জুন দলের সম্মেলন হবে। এজন্য জাপা চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র ভাড়া করে। কিন্তু গত ১৬ জুন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জিএম কাদের বলেন, চীন মৈত্রী কর্তৃপক্ষ হল বরাদ্দ বাতিল করায় ২৮ তারিখের সম্মেলন হচ্ছে না। হল পাওয়া গেলে সম্মেলনের পরবর্তী তারিখ জানিয়ে দেওয়া হবে। তার এই বিবৃতির পর পাল্টা বিবৃতি দিয়ে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, সম্মেলন স্থগিতের সিদ্ধান্ত অগণতান্ত্রিক ও অনভিপ্রেত। সম্মেলনের মাধ্যমে চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করা গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, প্রেসিডিয়াম সভায় সর্বসম্মতিতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল কোনো কারণবশত সম্মেলনের জন্য মাঠ বা হল পাওয়া না গেলে রাজধানীর কাকরাইলে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সম্মেলন হবে। এ সিদ্ধান্ত এখনো বহাল আছে। এ সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানিয়ে দলের চেয়ারম্যান ২৮ জুন দলীয় কার্যালয়ের সামনেই সম্মেলনের আয়োজন নিশ্চিত করবেন বলে আশা করি।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, আগামী ২৮ জুন কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলের কাউন্সিল হবে। দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের তো ২৮ তারিখের সম্মেলন স্থগিত করেছেন এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, উনি একক সিদ্ধান্তে এটা স্থগিত করতে পারেন না। কারণ প্রেসিডিয়ামের সভায় এই তারিখ ঠিক হয়েছিল। উনাকে স্থগিত করতে হলে প্রেসিডিয়ামের মিটিংয়ে করতে হবে। সুতরাং ওইদিন দলের কাউন্সিল হবে। জিএম কাদেরকে বাদ দিয়েই কি জাতীয় পার্টি হচ্ছে জানতে চাইলে এ নেতা বলেন, তিনি সম্মেলনে না এলে তো দলের চেয়ারম্যান পদ থেকে বাদ পড়বেন। কারণ উপস্থিত না থাকলে প্রার্থী হতে পারবেন না। তবে দল থেকে বাদ পড়ছেন না।
অন্যদিকে কাউন্সিল স্থগিত করতে হলে দলের চেয়ারম্যানকে প্রেসিডিয়ামের মিটিং ডেকে অনুমতি নিতে হবে এমনটি জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের কোথাও নেই উল্লেখ করে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, এখানে যেটা ব্যাখ্যা আসতে পারে যে, নতুন করে আবার কোনো তারিখ ঘোষণা করতে হলে আবার প্রেসিডিয়ামের মিটিং ডাকতে হবে। এটা হতে পারে। আবার এখানে বাস্তবতা হচ্ছে কোনো হলরুম পাওয়া যাচ্ছিল না। রাস্তায় তো একটা দলের কাউন্সিল হতে পারে না। তিনি আরও বলেন, উনাদের যে ২০(ক) ধারা নিয়ে আপত্তি সেটার তো সমাধান আছে। আমাদের গঠনতন্ত্র সংশোধনের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটি এখানে কোনো সংশোধন আনার প্রয়োজন মনে করলে বিষয়টি তুলে ধরবে। তারপর পার্টিতে আলোচনার মাধ্যমে একটা সমাধান করা যাবে। তবে আমি মনে করি এরকম মুখোমুখি কাউন্সিল করে কোনো সমাধান হবে না। দলের সিনিয়র নেতাদের হঠাৎ করে বিদ্রোহের কারণে হতবাক হয়ে পড়েছেন জিএম কাদেরপন্থি জাতীয় পার্টির নেতারা। তারা বলছেন, এবারের বিদ্রোহী গ্রুপে জাতীয় পার্টির বড় বড় নেতারা যুক্ত আছেন। দলের বর্তমান মহাসচিবও এই বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
জিএম কাদের অনুসারী জাতীয় পার্টির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, এবারের বিদ্রোহী অংশে জাতীয় পার্টির অনেক বড় বড় নেতা আছেন। এটা হঠাৎ করে হওয়ায় আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেছি। বিদ্রোহী কাউন্সিল হবে, এ ধরনের ভাবনা আমাদের মধ্যে ছিল না। সেটাতে আসলে আমরা কিছুটা নার্ভাস। চেয়ারম্যান নিজেও এবারের বিদ্রোহের বিষয়টি আগে থেকে অনুমান করতে পারেননি।
জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, দলের প্রেসিডিয়াম মিটিং করে ২৮ জুন দলের সম্মেলন তারিখ ঘোষণা করেছি। কিন্তু চেয়ারম্যান জিএম কাদের একটা অজুহাত তুলে তা স্থগিত করেছেন। কিন্তু তিনি এককভাবে সম্মেলন স্থগিত করতে পারেন না দলের প্রেসিডিয়ামের বৈঠক ছাড়া। আনিসুল ইসলাম ও রুহুল আমিন হাওলাদার আহ্বান জানিয়েছেন যে, আপনি (জিএম কাদের) এককভাবে এটা স্থগিত করতে পারেন না। ২৮ তারিখে যেন সম্মেলন করা হয়, সে ব্যাপারে তারা অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রেসিডিয়ামের মিটিংয়ে আমিসহ অনেকে দলের গঠনতন্ত্রের ২০(ক) ধারা সংশোধন করার প্রস্তাব দিয়েছি। কিন্তু কাদের সাহেব গণতন্ত্রের কথা বললেও গঠনতন্ত্রের ২০(ক) স্বৈরতন্ত্র। সেটা গণতন্ত্র বা আধুনিকায়ন করার প্রস্তাব দিলেও তিনি মানছেন না। তিনি এটাও বলেছেন যে, সব (নেতা) চলে গেলেও কিছু আসে যায় না।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আমি যতটুকু জানি আনিসুল ভাই (আনিসুল ইসলাম) ও হাওলাদার সাহেব (রুহুল আমিন হাওলাদার) এই সম্মেলনে যারা আগে জাতীয় পার্টি ছেড়ে চলে গেছেন সবাইকে নিয়ে আসছেন। বেগম রওশন এরশাদও পার্টির একটা অংশের চেয়ারম্যান আছেন। তার সঙ্গে আছেন সৈয়দ আবুল হোসেন বাবলা, কাজী ফিরোজ রশীদ, শফিকুল ইসলাম সেন্টুসহ অন্যরা। এর বাইরে বিভিন্ন সময় যারা জাতীয় পার্টি ছেড়ে গিয়ে নিজেরা দল গঠন করেছেন সেই রকম আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, শেখ শহীদুল ইসলামসহ যারা আছেন, সবাই এই কাউন্সিলে আসছে। তাদেরকে নিয়ে একটা ঐক্য করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু কাদের সাহেব (জিএম কাদের) এই ঐক্যটা চান না।
রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো চেয়ারম্যান সৈয়দ আবুল বাবলা বলেন, আনিস ভাই আমাদেরকে সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তখন বলেছি, আমরা বৃহত্তর ঐক্য চাই, আপনাদের কাউন্সিলে যাব। আমরা যদি মনে করি, এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হচ্ছে, তাহলে আমরা বৃহত্তর ঐক্যের মধ্যে থাকব। রওশন এরশাদ সম্মেলনে আসবেন কি না জানতে চাইলে আবুল হোসেন বাবলা বলেন, উনার শারীরিক অবস্থা ভালো থাকলে আসবেন। না হয় বার্তা দিতে পারেন। না হলে উনার দোয়া থাকবে। দলের কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমদুসহ অন্যদের নেতৃত্বে হওয়া ২৮ জুনের সম্মেলনে তৃণমূলের জাতীয় পার্টির নেতাদের অংশ না নিতে জেলা-উপজেলা কমিটিকে চিঠি দিয়েছেন জিএম কাদের।