কাজ নেই, তবুও নিচ্ছেন বেতন

- আপডেট সময় : ১০:২৫:১০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫ ১৪ বার পড়া হয়েছে
রাজধানীর ব্যস্ততম ফুলবাড়িয়ার বঙ্গবাজারের অদুরে সিটি করপোরেশনের খাদ্য পরীক্ষাগার। নিরাপদ খাদ্যে নিশ্চিতে পাকিস্তান শাসনামল থেকে এখানে খাদ্যের মান পরীক্ষা হয়ে আসছে। রাজধানীসহ সারাদেশের ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপদের জন্য এই পরিক্ষাগারটি একমাত্র।
গত ২০১১ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন দুভাগে বিভক্ত হলে খাদ্য পরীক্ষাগারটি দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অর্ন্তভুক্ত হয়। মাইক্রোবায়োলজিষ্টের অভাবে এখানে খাদ্যের রাসায়নিক পরীক্ষার কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক না থাকায়, হচ্ছে না খাদ্য পরীক্ষা। পাশাপাশি উত্তর সিটি করপোরেশনের নিজস্ব খাদ্য পরীক্ষাগার নেই। সব মিলিয়ে অলস পড়ে আছে কোটি কোটি টাকায় নির্মিত সংশ্লিষ্ট খাদ্য পরিক্ষাগারটি। আর ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা বসে বসে সরকারের বেতন ভোগ করছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, বঙ্গবাজার মোড়ের কাজী আলাউদ্দীন রোডের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে ধূসর রঙের পাঁচতলা ভবনে পরিক্ষাগারটি। বাইরে থেকে কিছু বুঝার উপায় নেই। সাইনবোর্ডর লেখা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। জানা যায়, নগরবাসীর নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করতে উত্তর-দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য পরিদর্শকরা খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করে একমাত্র ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্য পাঠান। এই ল্যাবরেটরি থেকে খাদ্যের নমুনাগুলোর শুধু রাসায়নিক পরীক্ষা করে সনদ দেওয়া হয়। কোটি টাকার আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও খাদ্যের মাইক্রোবায়লোজিক্যাল পরীক্ষা হচ্ছে না। গত ৫ বছর যাবত খাদ্যের রাসায়নিক পরীক্ষার কার্যক্রমও সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক না থাকায় থেমে আছে এই কার্যক্রম। নিয়ম অনুযায়ী খাদ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সনদে স্বাক্ষর দেন জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক। সম্প্রতি এই পদটি শূন্য। এতদিন ল্যাবরেটরিতে এ পদে প্রেষণে দায়িত্ব পালন করেছেন শামছুল হক। গত বছর ডিসেম্বরে তার বদলির অর্ডার হয়। সে সময় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে প্রশাসক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা না থাকায় আটকে ছিল তার বদলির আদেশ। সংস্থাটিতে প্রশাসক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ হওয়ার পর জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষককে অবমুক্ত করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এরপর থেকে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে ল্যাবরেটরির সকল কার্যক্রম।
আরো জানা যায়, বসে বসে অলস সময় কাটাচ্ছে এবং মাস মাস বেতন নিচ্ছে রাসায়নিক ল্যাবের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বাজার থেকে নমুনা সংগ্রহের কাজও বন্ধ। কর্মহীন ভাবে বসে আছে সিটি করপোরেশনের অধীনস্ত খাদ্য পরিদর্শকরাও। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনৈক স্বাস্থ্য পরিদর্শক বলেন, দাপ্তরিক কোনো চিঠির মাধ্যমে আমাদের খাদ্য নমুনা সংগ্রহ স্থগিত করা হয়নি। কিন্তু যেহেতু নমুনা সংগ্রহ করার সাত দিনের মধ্যে পরীক্ষা করার নিয়ম আছে, তবে আমাদের পরীক্ষার ফলাফলের সনদের স্বাক্ষর বা প্রত্যয়নকারী কর্মকর্তা জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক নেই। তাই আমাদের সংগ্রহ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৩ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহযোগিতায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন আরবান পাবলিক অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল হেলথ সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (ইউপিইএইচএসডিপি) অধীনে প্রায় ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার নির্মাণ করা হয়। নগরবাসীর নিরাপদ খাদ্যের জন্য জার্মান প্রযুক্তিতে উন্নত মানের যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে ল্যাবরেটরিত। ২০২০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ল্যাবরেটরিটি উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের ৫ বছরেই ভবনের নিচতলার বাইরের বিভিন্ন অংশে পলেস্তারা খসে পড়েছে। ফলে ল্যাবরেটরির কোনো কার্যক্রম নেই এখানে। রয়েছে শুধু পাহারাদার ও জেনারেটর কক্ষ। দ্বিতীয় তলায় ঘুরে দেখা গেল ভবনের একপাশে মাইক্রোবায়োলজিক্যাল ল্যাব আছে বন্ধ অবস্থায়। ল্যাব সংশ্লিষ্ট অফিস কক্ষগুলোতে ঝুলছে তালা। তবে তৃতীয় তলায় রাসায়নিক পরীক্ষার প্রাথমিক ল্যাব ও অফিস কক্ষগুলো খোলা রয়েছে। চতুর্থ তলায় অ্যাডভান্স ল্যাব। আর পঞ্চম তলায় প্রশিক্ষণ কক্ষ। তবে ৫ বছরে ফুড সেফটি নিয়ে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ হয়নি।
মজার বিষয় হচ্ছে, আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও খাদ্যের মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে সব ধরনের পরীক্ষা করতে পারে না প্রতিষ্ঠানটি। খাদ্য পরীক্ষায় রাসায়নিক বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ আধুনিক এই ল্যাবরেটরি। জীবাণু সংক্রমণজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি চিহ্নিত করতে পারে না। শুধু খাদ্যের অ্যাডালট্রেশন (ভেজাল মিশ্রণ) পরীক্ষা হতো। আধুনিক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও কন্টামিনেশন (পরিবেশগত কারণে খাদ্যের গুণগত মান নষ্ট হওয়া) পরীক্ষা হয় না। নেই মাইক্রোবায়োলজিস্ট। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অর্গানোগ্রামে (সাংগঠনিক কাঠামো) পদ না থাকায় মাইক্রোবায়োলজিস্ট নিয়োগও দিতে পারছে না সংস্থাটি। পাঁচ বছরেও ল্যাবরেটরির মাইক্রোবায়োলজির অংশটি চালু করতে পারেনি। অলস পড়ে থাকায় দিন দিন নষ্ট হচ্ছে অণুজীব ও ব্যাকটেরিয়া পরীক্ষার যন্ত্রপাতি। অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী শুধু কেমিস্ট্রি ল্যাব চালু আছে। এখান থেকে শুধু খাদ্যপণ্যের রাসায়নিক পরীক্ষা হতো। তাও এখন বন্ধ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, খাদ্যে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার মতো অণুজীব থাকলে বমি, ডায়রিয়া ও পেটব্যথা, আমাশয়, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, হজমের সমস্যা ও অ্যালার্জি দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া পেশি দুর্বলতা ও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, খাবার থেকে আমরা জীবনী শক্তি পাই। খাদ্য শরীরের ক্ষয় পূরণ করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। খাদ্যে ভেজাল থাকলে অসুখ-বিসুখ বাড়বে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হবে। মানুষের কর্মক্ষমতা কমতে থাকবে। খাদ্য বিশুদ্ধ না হলে শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গের কার্যকারিতা হ্রাস পাবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কার্যকারিতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। যেমন কিডনি-লিভার অকেজো হতে পারে। পাকস্থলীর ক্ষয় বা বিষক্রিয়া হতে পারে। বাজারের প্রচলিত প্রতিটি খাদ্যের পরীক্ষা হওয়া দরকার।
এবিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, আমি আজকেই জানতে পারলাম। দেখতে হবে কী অবস্থায় রয়েছে। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেব। অর্গানোগ্রামে পদ না থাকায় মাইক্রোবায়োলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত মাইক্রোবায়োলজিস্ট পদ সৃষ্টির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে রশি টানাটানি চলছে।
এদিকে সিটি করপোরেশনের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে জানিয়েছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসেন। তিনি বলেন, নিয়মিত জীবাণু পরীক্ষা ছাড়া খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। অনেক দেশেই খাদ্যের রাসায়নিক ও মাইক্রোবায়োলজিক্যাল পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। সিটি করপোরেশনে খাদ্য পরীক্ষাগার বন্ধ রাখা উচিত হয়নি। অর্গানোগ্রামে পদ না থাকায় মাইক্রোবায়োলজিস্ট নিয়োগ দিতে পারছে না। এই কথা শুধু অজুহাত।
এদিকে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে সংস্থাটির প্রশাসক বলেন, নগরবাসীর জন্য নিরাপদ খাদ্য গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের একটি পরামর্শক কমিটি রয়েছে। সেখানে এ বিষয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তাদের পরামর্শ নিয়ে আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার আমরাও নির্মাণ করব। এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (বিএফএসএ) চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের পরীক্ষা চলমান। আমরা রোজার মাস উপলক্ষে মুড়ি-সেমাই, বেসনসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের পরীক্ষা করছি। আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা তো শতভাগ পরীক্ষা করতে পারি না। যতটুকু সামর্থের ভিতরে আমরা ততটুকু করি। সিটি করপোরেশনের খাদ্য পরীক্ষার সঙ্গে আমাদের কোনো যোগসূত্র নেই।