কিট অপচয়ের ভয়ে পরীক্ষা বন্ধ…

- আপডেট সময় : ১০:৫৮:৪৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫ ১১ বার পড়া হয়েছে
সরকারি হাসপাতালগুলোতে গত ৮ বছর ধরে চিকুনগুনিয়ার পরীক্ষা প্রায় বন্ধ বলা যায়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর,বি জানিয়েছে, চলতি জুন মাসের প্রথম তিন সপ্তাহে রাজধানীতে জ্বর ও উপসর্গ নিয়ে পরীক্ষা করাতে আসা ১৭১ জন রোগীর মধ্যে ১৪০ জনের শরীরে চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার প্রায় ৮২ শতাংশ। সংস্থাটি একে উচ্চ সংক্রমণের স্পষ্ট ইঙ্গিত হিসেবে চিহ্নিত করে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
২০১৭ সালে ঢাকায় প্রথম বড় আকারে চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। আইসিডিডিআরের হিসাবে সে বছর অন্তত ১৩ হাজার রোগী শনাক্ত হলেও বাস্তবে সংখ্যাটি লাখ ছাড়িয়েছে বলে ধারণা গবেষকদের। এরপর একে ‘কম গুরুত্বের রোগ’ ঘোষণা করে সরকারি হাসপাতালগুলোতে এর পরীক্ষার কিট সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দাবি করছেন মৃত্যু প্রায় নেই বলে কিট কেনার প্রয়োজনীয়তা আর দেখা দেয়নি। ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকায় চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
আইসিডিডিআর,বি, কিল ইউনিভার্সিটি (যুক্তরাজ্য) এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল এই জরিপে ৩৯৪ জন উপসর্গধারী রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে, যাদের মধ্যে ১৩৮ জনের (৩৫ শতাংশ) রিপোর্ট পজিটিভ আসে। এই ১৩৮ জনের মধ্যে— ৯৮.৫ শতাংশ রোগী ঢাকার বাসিন্দা, যার মধ্যে ৫২ শতাংশ রোগী ঢাকা দক্ষিণে এবং ৪৬ শতাংশ ঢাকা উত্তরের। বাকি দুজন নারায়ণগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জের। আক্রান্ত এসব রোগীদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ পুরুষ ও ৩৫ শতাংশ নারী। এমনকি আক্রান্ত প্রায় ৮৩ শতাংশ রোগীর বয়স ৩০ বছরের বেশি।
জরিপে দেখা গেছে, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ৯৬ শতাংশ ভুগেছেন জয়েন্ট পেইনে। এ ছাড়া, ২৯.৪ শতাংশ রোগী ক্লান্তিতে ভুগেছেন, ১৯ শতাংশ রোগীর অস্থিসন্ধি ফুলে গিয়েছে। এমনকি আক্রান্ত প্রায় ৮১ শতাংশ রোগীর ২৮ দিন পরও উপসর্গ বিদ্যমান ছিল বলে গবেষণায় বলা হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, এই রোগের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো— দীর্ঘমেয়াদী গিঁট ব্যথা, যা বহুদিন স্থায়ী হয় এবং কর্মক্ষমতা হ্রাস করে। জরিপের তথ্য বলছে, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তদের গড়ে একজন রোগী ১০ দশমিক ৫ কর্মদিবস হারাচ্ছেন, যার ফলে প্রতিজনের অর্থনৈতিক ক্ষতি গড়ে ৭৩ দশমিক ৩ মার্কিন ডলার (প্রায় ৮ হাজার টাকা)।
গবেষকদের মতে, ঢাকায় বর্তমানে এডিস মশার বিস্তার ও আবহাওয়ার অনুকূল পরিবেশের কারণে সংক্রমণের ঝুঁকি মারাত্মক হারে বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে গবেষণা কার্যক্রমের প্রধান সদস্য ও আইসিডিডিআর,বির বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মো. আব্দুল্লাহ ওমর নাসিফ বলেন, এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে আমরা নিয়মিতভাবে পজিটিভ কেস পাচ্ছি। সামনের মাসগুলোতে, বিশেষ করে ডেঙ্গু মৌসুমে চিকুনগুনিয়াও বড় আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঈদে মানুষের দেশব্যাপী চলাচলের ফলে এটি সারা দেশে ছড়াতে পারে।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত থাকা ভাইরাস জ্বরগুলো আবারও ফিরে এসেছে এবং এদের অনেকগুলো রোগীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু। বাংলাদেশ মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির (বিএমইউ) মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবেদ হোসেন খান এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ২০১৭ সালের পর দেশে আবারও চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। ১৯ অক্টোবর ২০২৪ থেকে ২২ এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত সময়কালে দেশে মোট ৫২০ জন সন্দেহভাজন রোগীর মধ্যে ১৬১ জনের দেহে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। যদিও এই ভাইরাসে মৃত্যুহার তুলনামূলকভাবে কম, তবে রোগ পরবর্তী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো— বিশেষ করে গিঁটে তীব্র ব্যথা, ত্বকে র্যাশ, দীর্ঘস্থায়ী দুর্বলতা— রোগীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় দীর্ঘমেয়াদে গভীর প্রভাব ফেলছে। তাই এটি কেবল সাধারণ ভাইরাস জ্বর হিসেবে বিবেচনা করে অবহেলা করা বিপজ্জনক।
ডা. আবেদ আরও বলেন, ডেঙ্গুও একইভাবে আবারও বড় হুমকির রূপ নিচ্ছে। প্রতিবছরের মতো এবারও বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ব্যাপকহারে বাড়ছে। আগের বছরগুলোতে মূলত ঢাকা শহরে ডেঙ্গু বেশি দেখা গেলেও বর্তমানে তা ছড়িয়ে পড়েছে বরিশাল, বরগুনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। চলতি মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত অন্তত ১ হাজার ৮৭৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যার মধ্যে শুধুমাত্র বরিশাল জেলাতেই ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এবার তিনটি ভিন্ন সেরোটাইপ (উঊঘ-১, উঊঘ-২, উঊঘ-৩) দ্বারা সংক্রমণ হচ্ছে বলে জানা গেছে, যা রোগীদের জটিলতায় ফেলছে। তিনি বলেন, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া— উভয়েরই মূল বাহক এডিস মশা। অপরিকল্পিত নগরায়ন, জলাবদ্ধতা এবং মশা নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী উদ্যোগের অভাব— এই রোগগুলোর বিস্তারের প্রধান কারণ। শুধুমাত্র চিকিৎসায় এই সমস্যা সমাধান হবে না। প্রয়োজন যথাযথ নগর পরিকল্পনা, পরিচ্ছন্নতা এবং প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বিতভাবে জনসচেতনতা বৃদ্ধি।
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো এডিস মশাবাহিত ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ঢাকায় ব্যবহৃত কীটনাশক (ইনসেকটিসাইড) কতটা কার্যকর তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. গোলাম ছারোয়ার বলেন, আপনার হাতে যদি বন্দুক থাকে, কিন্তু গুলি হয় খেলনার, তাহলে সেই গুলিতে কি আপনি শত্রু মারতে পারবেন? তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনগুলো ইনসেকটিসাইড ছিটালেও সেটি কতটুকু কার্যকর, সেখানে অ্যাকটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট (সক্রিয় উপাদান) সঠিক মাত্রায় আছে কি না— তা নিয়ে এখনো কোনো বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ নেই। অথচ এটাই হচ্ছে ভাইরাসবাহিত রোগ দমন ব্যবস্থার মেরুদণ্ড। একটি সিটি কর্পোরেশনের কর্মীদের আমি জিজ্ঞেস করেছি, তারা ইনসেকটিসাইড কোথায় ছিটায়। তারা বলছে, বাড়ির পাশে জমে থাকা পানিতে। প্রশ্ন হলো সেই পানিতে প্রাপ্তবয়স্ক (এডাল্ট) মশা থাকে নাকি কেবল লার্ভা থাকে? কারণ, লার্ভা ধ্বংসের জন্য ‘লার্ভিসাইড’ দরকার, আর এডাল্ট মশা নিয়ন্ত্রণে ‘এডাল্টিসাইড’। অথচ আমরা জানিই না কোন পর্যায়ে কী প্রয়োগ করা হচ্ছে।
ওষুধের মান নয়, এর প্রয়োগ পদ্ধতিও সমান গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে ডা. ছারোয়ার বলেন, যে দূরত্ব থেকে ইনসেকটিসাইড ছিটানো উচিত, সে মানদণ্ডও আমরা অনুসরণ করছি না। ভুল দূরত্ব ও কোণে স্প্রে করলে কার্যকারিতা শূন্যে গিয়ে ঠেকে। এই অবস্থায় পুরো প্রক্রিয়াই অর্থহীন হয়ে যায়। বাহকভিত্তিক কৌশলের অভাব উল্লেখ করে ডা. ছারোয়ার আরও বলেন, বর্তমানে এডিস মশার দুই প্রজাতি— এডিস ইজিপ্টাই ও এডিস অ্যালবোপিকটাস বাংলাদেশে বিস্তৃত। এদের মধ্যে একটি ছায়াযুক্ত আবাসস্থলে বেশি থাকে, অপরটি খোলা জায়গায়। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা— তিনটি ভাইরাসই এই মশা দ্বারা সংক্রমিত হলেও বাহকের আচরণ আলাদা হওয়ায় প্রতিরোধ কৌশলও আলাদা হওয়া প্রয়োজন।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, চিকুনগুনিয়ায় মৃত্যুহার তুলনামূলকভাবে কম হলেও রোগীর শারীরিক ও সামাজিক জীবনে দীর্ঘমেয়াদি ভোগান্তি তৈরি করে। এই ভাইরাসজনিত সংক্রমণে হঠাৎ করে জ্বর ওঠে, তারপর গিঁটে অসহনীয় ব্যথা দেখা দেয়, যা অনেক সময় মাসের পর মাস থেকে যায়। অনেক রোগীই স্বাভাবিক চলাফেরা ও কর্মক্ষমতা হারান। এমনকি হালকা কাজ করতেও সমস্যায় পড়েন।
তিনি আরও বলেন, চিকুনগুনিয়ার এখন পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। তাই চিকিৎসা বলতে মূলত লক্ষণ-উপসর্গের ওপরই নির্ভর করতে হয়। ব্যথানাশক ওষুধ, বিশ্রাম, পর্যাপ্ত তরল গ্রহণ ও শরীরের পরিচর্যার মাধ্যমে চিকিৎসা করতে হয়। কিন্তু এই লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসার জন্য আগে রোগ নির্ভুলভাবে শনাক্ত করতে হয়। রোগ শনাক্ত না হওয়ায় ভুল চিকিৎসার ঝুঁকি তৈরি হয়, রোগী আরও বিপদে পড়ে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, চিকুনগুনিয়ার জন্য এখন সরকারি হাসপাতালগুলোতে নিয়মিত পরীক্ষা হচ্ছে না। তবে আইইডিডিআর ও রেফারেন্স ল্যাবরেটরিতে এই পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। যেসব রোগীকে সন্দেহভাজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী স্যাম্পল পাঠিয়ে পরীক্ষা করা হয়। তিনি বলেন, চিকুনগুনিয়ায় সাধারণত ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস বেশি কার্যকর। সব রোগীর ক্ষেত্রে আলাদা করে রক্ত পরীক্ষা করার দরকার পড়ে না। যদি সবকিছুই টেস্টের ওপর নির্ভর করে, তাহলে তো চিকিৎসকদের ভূমিকা থাকছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ কনসালটেন্টরা রোগীর উপসর্গ দেখে রোগ নির্ণয় করতে পারেন।