বিকল্প শ্রমবাজারের সুযোগ ইউরোপে

- আপডেট সময় : ১২:৪১:২৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২৫ ৯৪ বার পড়া হয়েছে
দক্ষতার অভাবে ইউরোপের শ্রমবাজারে যেতে পারছেন না বাংলাদেশি কর্মীরা। ফলে প্রতি বছর যে পরিমাণ শ্রমিক অভিবাসী হচ্ছেন তার প্রায় ৯০ শতাংশই যাচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়ার দেশগুলোতে। অন্যদিকে দক্ষ কর্মীর ঘাটতি রয়েছে পুরো ইউরোপে। তাদের চাহিদা থাকলেও বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে পারছে না। এ পরিস্থিতি বদলাতে বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) চালু করছে ট্যালেন্ট পার্টনারশিপ প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় তিন হাজার বাংলাদেশিকে ইউরোপীয় মানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এরপরে তারা যেতে পারবেন ইউরোপে। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে তিন মিলিয়ন ইউরো দেবে ইইউ, বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩৮ কোটি। প্রকল্পের আওতায় তিন হাজার বাংলাদেশি শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ইউরোপে ন্যায্য নিয়োগ এবং অভিবাসন পরিচালনায় নিরাপদ ও বৈধ গতিশীলতার পথ তৈরি হবে। অভিবাসন খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের শ্রমবাজারে প্রবেশের হার একেবারে নগণ্য।
বিএমইটি থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্য ও রামরুর এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে ৯৭ শতাংশ কর্মী গেছে এশিয়ার ১০টি দেশে। সর্বশেষ পাঁচ বছরে ইউরোপের ২৮টি দেশে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা মাত্র ৭৫ হাজার ৬৬৮ জন। ২০২৪ সালে কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে গেছেন ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৬৯ জন। এরমধ্যে ইউরোপের ২৮টি দেশে গেছে মাত্র ১৬ হাজার ৭৭ জন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষতার অভাব ও কর্মী পাঠানোর বৈধ চ্যানেল না থাকাই মূল কারণ। এ নিয়ে অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের দেশ থেকে ইউরোপে জনশক্তি পাঠানোর দরজা মোটামুটি বন্ধ। গ্রিস, ইতালি ও রোমানিয়ার সঙ্গে সম্ভবত আমাদের সমঝোতা স্মারক আছে। কিন্তু এগুলোর তেমন প্রভাব নেই। সেটা ইউরোপে শ্রমবাজারের অবস্থা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। তাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্কিল মাইগ্রেশনের প্রচেষ্টা আমাদের জন্য ভালো সুযোগ। তাদের দেশেও জনশক্তির ঘাটতি রয়েছে। এখন আমরা কতটুকু দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারি সেটাই দেখার বিষয়। এ প্রকল্পের অংশীদার হিসেবে আছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ; জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি), বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর এবং নিয়োগকর্তা ও শ্রমিক সংগঠনগুলো।
প্রকল্পের আওতায় যে পাঁচটি সেক্টরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে সেগুলো হলো- কেয়ারগিভার, ট্রান্সপোর্ট, হোটেল ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি, কন্সট্রাকশন এবং আইসিটি ও টেকনোলজি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) সূত্রে জানা গেছে, সেক্টরগুলো থেকে ১২টি ভাগে প্রশিক্ষণ হতে পারে। যেমন, ট্রান্সপোর্ট সেক্টরে ড্রাইভার, টেকনিশিয়ান ও ইঞ্জিন অপারেটরসহ তিনটি ভাগে প্রশিক্ষণ হতে পারে। একইভাবে বাকি সেক্টরগুলো থেকে বিভিন্ন পেশায় কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইএলও বাংলাদেশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এই ট্রেনিংটা হায়ার লেভেলের। এখানে মিনিমাম এইচএসসি পাস ক্রাইটেরিয়া থাকবে। বিশেষ করে মিনিমাম একটা স্কিল থাকতে হবে। সাধারণত আমাদের দেশে লেভেল ১-২ ট্রেনিং হয়। ইউরোপের মার্কেটের জন্য লেভেল ৩-৪ থাকতে হবে। এজন্য সিলেকশন ক্রাইটেরিয়া সেভাবে হবে। বিএমইটি ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে। ট্রেনিং শুরু হতে আরও তিন-চার মাস সময় লাগতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ট্রেনিং কিছুটা ডুয়েল ট্রেনিংয়ের মতো হবে। কিছু প্রশিক্ষণ ইউরোপের দেশগুলোতে হবে। আমাদের দেশে গ্র্যাজুয়েশন চলাকালীন যেভাবে ইন্টার্নশিপ করে, সেখানেও এমন প্রশিক্ষণ হতে পারে। একজন কর্মী সেখানে গিয়ে কাজের ক্ষেত্র অনুযায়ী ‘শিক্ষানবিশ’ হিসেবে প্রশিক্ষণ নেবেন। এ প্রকল্পের আওতায় বাছাইকৃতদের ১০ থেকে ১৫টি ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এতে দেশের স্বাস্থ্য সংস্থা, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ও ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট অথোরিটি সংযুক্ত থাকার কথা রয়েছে।
এ বিষয়ে বিএমইটির মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফর বলেন, ‘ট্রেনিং সেন্টার নির্ধারণের কাজ চলছে। তবে শুধু টিটিসিতে হবে না। যেমন, কেয়ারগিভার কাজের জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের স্পেশালাইজড ট্রেনিং সেন্টার আছে। সেখানে অনেক নার্স ট্রেনিং নিয়েছেন। প্রশিক্ষণটা আমরা স্বাস্থ্য বিভাগের এই ট্রেনিং সেন্টারের মাধ্যমে করাবো। অর্থাৎ যেখানে ভালো কিছু শেখা যাবে সেখানেই আমরা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করবো। আগামী একমাসের মধ্যে আশা করি আমাদের ট্রেনিং সেন্টার সিলেকশন হয়ে যাবে। প্রশিক্ষণ কারিকুলামের ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএমইটির মহাপরিচালক বলেন, ‘এখন আমাদের যে কারিকুলাম আছে, এটা ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ড নয়। তাই ইউরোপের কারিকুলাম সংগ্রহ করে, আমরা একটা কারিকুলাম তৈরি করছি। ওই কারিকুলাম অনুযায়ী ট্রেনিং হবে। এটার কাজ চলছে। তিনি বলেন, এ প্রকল্পের জন্য আমাদের একটি কমিটি হয়েছে। সামনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটা টিম আসবে। তারা ট্রেনিং সেন্টারগুলো পর্যবেক্ষণ করবে।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রশিক্ষকরাই প্রশিক্ষণ দেবেন। তবে বিভিন্ন দেশের ট্রেইনার রিপ্রেজেন্টেটিভ আনা হতে পারে। বিশেষ করে ভাষা শেখানোর ক্ষেত্রে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ১০০ জন প্রশিক্ষক এবং মূল্যায়নকারীর আপস্কেলিং করা হবে, যাতে প্রশিক্ষকরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের যোগ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রশিক্ষণ দিতে পারেন।
আইএলও বাংলাদেশের এক কর্মকর্তা বলেন, কর্মী নিয়োগটা হবে প্রতিটি দেশের এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সির মাধ্যমে। আমরা ইতালির লেবার মিনিস্ট্রির সঙ্গে কথা বলেছি। দেশগুলোর এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সির প্রতিনিধির মাধ্যমে তারা লোক নেবে। তারা ট্রেনিংপ্রাপ্তদের অনলাইনে ট্রেনিংটা দেখবে, ইন্টারভিউ নিতে পারে। তিনি আরও বলেন, প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া শেষ হবে ২০২৭ সালের মধ্যে। তবে চেষ্টা করা হবে ২০২৬ সালের মধ্যে যাতে শেষ হয়। এর মধ্যে রিক্রুটিং কার্যক্রম চলতে হবে। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সরকারের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হতে হবে। চুক্তি অনুযায়ী কর্মী পাঠানো হবে। এ তথ্যগুলো বিএমইটি ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে জানা যাবে। ট্যালেন্ট পার্টনারশিপ প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, প্রজেক্টের মাধ্যমে কর্মীরা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দক্ষতার মাধ্যমে ইউরোপে প্রবেশ করতে পারবেন। এর মাধ্যমে নিরাপদ এবং আরও লাভজনক কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন তারা। এছাড়া বাংলাদেশ বৈশ্বিক শ্রমবাজারের সঙ্গে অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠা, দক্ষতা উন্নয়ন বৃদ্ধির সুযোগ পাবে। পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলোতে দক্ষ শ্রমশক্তির ঘাটতি পূরণ হবে।
এ নিয়ে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ‘আমি মনে করি ট্রেইনাররা বিদেশের হলে ভালো হয়। টোটাল প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ হতে হবে। প্রকল্প সফল হলে বিএমইটির সব ট্রেনিং সেন্টারে একই ধরনের ট্রেনিং করানো যায় কি না সেটা ভাবা যেতে পারে। পাশাপাশি শুধু ডোনারের ওপর নির্ভর না করে প্রশিক্ষণের জন্য সরকারের ফান্ডিং বাড়াতে হবে। শুধু ইউরোপ নয়, অন্যান্য দেশের জন্যও পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ চালু করতে হবে। প্রকল্প সফল হলে ভালো একটা প্রচার হবে। তখন অনেক মানুষ দক্ষতা অর্জনের জন্য আগ্রহী হবেন। সার্বিক বিষয়ে বিএমইটির মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফর বলেন, ‘আমরা যদি এ প্রকল্পে সফল হই, তাহলে ইউরোপের দেশগুলো আমাদের থেকে আরও বেশি লোক নিতে আগ্রহী হবে। আমাদের যে দক্ষ লোক আছে, বা দিতে পারবো, এ প্রজেক্টটা ব্র্যান্ডিং করার এক সুবর্ণ সুযোগ। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রস্তুতিটা ভালো করে নিতে চাই। কারণ বিদেশি নিয়োগকর্তারা এসে দেখবেন আমাদের কর্মীরা কোথায় ট্রেনিং করছে। আমরা যা শেখাচ্ছি, এটা তাদের দেশে কাভার করবে কি না। সেজন্য আমাদের ট্রেনিং সেন্টার, যন্ত্রপাতি ও কারিকুলাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই যেসব প্রতিষ্ঠানের ভালো যন্ত্রপাতি আছে, তাদেরই আমরা ট্রেনিং অফার করবো। বিএমইটি মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘আমরা কাজটা শুরু করেছি গত মাসে। এখন আমাদের একটা কমিটি হয়েছে, তারা কাজ করছে। প্রশিক্ষণের পর কেউ যদি ইউরোপে যেতে নাও পারেন, তিনি অন্য যে কোনো দেশে গিয়ে তারা কাজ করতে পারবেন। সেভাবে যোগ্য করে তোলা হবে।