ভোটের মাঠে চেনা দৃশ্য, আস্থা রাখতে পারছে না ভোটাররা
প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি
- আপডেট সময় : ৬৩ বার পড়া হয়েছে
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনীতি আবারও চাঙা হয়ে উঠেছে। মাঠে নেমে গেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থী, সম্ভাব্য প্রার্থী এবং দলীয় নেতাকর্মীরা। ভোটারদের মন জয় করতে চলছে নানা কর্মসূচি, পথসভা, গণসংযোগ ও উঠান বৈঠক। এরই সাথে জমে উঠেছে উন্নয়ন-অঙ্গীকারের বর্ণিল প্রচার-যেন প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি এলাকায়, প্রতিটি অলিতে-গলিতে। নির্বাচনী মাঠের প্রতিদিনের চেনা চিত্র-প্রার্থীরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন ভোটারদের দোরগোড়ায়, বাজারে, চায়ের দোকানে, পাড়া-মহল্লায়। নিজেদের পরিকল্পনার দীর্ঘ তালিকা পেশ করছেন তারা। আধুনিক সড়ক, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, ড্রেনেজ, বিদ্যুৎ-গ্যাস, শিক্ষা খাতে উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, যুবকদের জন্য প্রকল্প-এসব যেন এখন সর্বজনীন প্রতিশ্রুতির অংশ। ভোটের আমেজ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে প্রতিশ্রুতির ঝুড়িও।
যদিও উন্নয়নের নানা রঙিন স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে, ভোটারদের একটি বড় অংশ এরইমধ্যে প্রশ্ন তুলছেন পুরোনো প্রতিশ্রুতির বাস্তবতা নিয়ে। অনেকেই বলছেন, প্রতি নির্বাচনেই একই প্রতিশ্রুতি শুনি, কিন্তু বাস্তবে কতটা হয়? নির্বাচনে বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা যে সব প্রতিশ্রুতি দেয়, তার কতটুকু বাস্তবায়িত হয়, এই হিসাব চাইছে সাধারণ মানুষ। স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলেন, রাস্তা-ড্রেন থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের উন্নয়ন-সবই প্রতি নির্বাচনে বলা হয়। কিন্তু এগুলো কি শুধু ভোটের সময়ই মনে পড়ে?
ভোটারদের এমন প্রশ্নের মুখে প্রার্থীরা নতুন করে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন উন্নয়ন পরিকল্পনার। কেউ বলছেন দীর্ঘদিন ক্ষমতায় না থাকার কথা, কেউ বলছেন নতুন দল, আবার কেউ বলছেন যা বরাদ্দ পাবে তার সব টাকার কাজ করবেন। তবে এবার নির্বাচনের আগে উন্নয়ন-অঙ্গীকারের পরিধি আরও বাড়িয়ে কথা বলছেন প্রায় সবাই।
নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক মাঠে সবচেয়ে বেশি সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে বিএনপি, জামায়াত ও তরুণদের নতুন দল এনসিপির নেতাকর্মীদের মধ্যে। দীর্ঘ সময় ধরে রাজপথের রাজনীতি করা ও নতুন এসব দল এবার ভোটের মাঠেও শক্ত অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করছে। এলাকাজুড়ে তাদের গণসংযোগ, পথসভা ও কর্মসূচি চোখে পড়ার মতো।
স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা দাবি করছেন, জনগণ পরিবর্তন চায়, তাই তারা মাঠে আরও সক্রিয়। অন্যদিকে নতুন দল নিজেদের শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে প্রতিনিয়ত প্রচারণায় যুক্ত হচ্ছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে ততই প্রতিশ্রুতির মাত্রা বাড়বে। কারণ ভোটারদের কাছে উন্নয়নই সবচেয়ে বড় বার্তা, আর সেই কারণে প্রতিটি প্রার্থীই প্রতিশ্রুতি-নির্ভর প্রচারণা চালাতে বাধ্য। কিন্তু প্রতিশ্রুতির এই বন্যা কতটা বাস্তবায়নযোগ্য-সেটা নিয়েই জনমনে সংশয়।
বিভিন্ন এলাকায় প্রচারণায় গিয়ে প্রার্থীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, যুব উন্নয়ন, সড়ক-সংযোগ ও দারিদ্র্য দূরীকরণসহ নানা ক্ষেত্রে বড় পরিকল্পনার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। গ্রাম এলাকায় বিশেষ করে সড়ক-ঘাট আর আধুনিক সুবিধার কথা বেশি বলা হচ্ছে। শহরাঞ্চলে চাকরি, শিক্ষার মান এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রতিশ্রুতিতে বেশি উঠে আসছে। তবে অনেকেই বলছেন, আধুনিক পরিকল্পনার কথা শোনালেও এর অর্থনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা খুব কমই হচ্ছে।
এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন-ভোটার কার ওপর আস্থা রাখবে? প্রতিশ্রুতির বহুস্তরীয় লড়াইয়ের মাঝে ভোটাররা এখন সতর্ক। তারা শুনছেন, বিচার করছেন, তুলনা করছেন। এক স্থানীয় ভোটার বলেন, প্রতিশ্রুতি দেবেন, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আগের কাজের ভিত্তিতেই আমরা সিদ্ধান্ত নেব। শুধু মুখের কথা নয়-প্রমাণ চাই।
নির্বাচনী মাঠের গতিবিধি পর্যবেক্ষকদের মতে, জনগণ এবার আগের চেয়ে বেশি সচেতন। তারা প্রতিশ্রুতির আকর্ষণে নয়-বরং বাস্তবায়নের রেকর্ড, নেতৃত্বের সামর্থ্য এবং এলাকার প্রকৃত উন্নয়ন দেখে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে।
এনসিপির নেতা হাসনাথ আব্দুল্লাহ বলেন, জনগণ অনেক বছর ধরে বদলের অপেক্ষায় আছে। শুধু প্রতিশ্রুতি নয়-এই দেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা ও মানুষের অধিকার ফেরাতে আমরা মাঠে নেমেছি। উন্নয়ন হবে, কিন্তু সেটা হবে ন্যায়ভিত্তিক, সব শ্রেণির মানুষের জন্য। এবার মানুষ ভোটের মাধ্যমে তাদের আস্থা যাদের ওপর আছে, তাদেরই নির্বাচিত করবে। আমরা বিশ্বাস করি-জনগণ পরিবর্তন চায়, আর সেই পরিবর্তনের শক্তি এনসিপিই দেখাতে পারবে।
বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া এক প্রার্থী বলেন, এবারের নির্বাচন জনগণের ভোটে পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে এসেছে। বহু বছর উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের নামে সাধারণ মানুষের স্বপ্নকে অবহেলা করা হয়েছে। আমরা প্রতিশ্রুতি দিতে চাই-ক্ষমতায় এলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার বাস্তব উন্নয়ন নিশ্চিত করা হবে। মানুষ এখন পরিবর্তনের পক্ষে; আমরা শুধু সেই জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করতে চাই।
জামায়াতের একাধিক প্রার্থী বলেন, আমরা জনগণের কল্যাণ, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে নির্বাচনী মাঠে নেমেছি। মানুষ বারবার প্রতিশ্রুতি শুনেছে, কিন্তু বাস্তব পরিবর্তন দেখেনি। এবার আমরা এমন একটি উন্নয়নধারা গড়তে চাই, যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও সামাজিক নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। আমাদের বিশ্বাস-জনগণ সত্যিকারের সেবা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার রাজনীতি চায়। সেই রাজনীতি প্রতিষ্ঠার জন্যই আমরা চেষ্টা করছি।
ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে প্রতিশ্রুতির ঝুড়ি যেন আরও ভরে উঠছে। নানা উন্নয়ন-পরিকল্পনা, কর্মসংস্থানের আশ্বাস ও আধুনিকায়নের রঙিন স্বপ্ন ছড়িয়ে দিচ্ছেন প্রার্থীরা। তবে ভোটাররা এবার প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরির পাশাপাশি বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা ও দায়িত্বশীলতা-উভয়টাই দেখতে চান।























