অস্বাভাবিক মৃত্যু বেড়েছে প্রবাসে

- আপডেট সময় : ০৯:২১:৪৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫ ১৮ বার পড়া হয়েছে
প্রবাসীদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে বিদেশে। আর্থিক অস্বচ্ছলতা, পারিবারিক অশান্তি, ডিপ্রেশন অথবা দুর্ঘটনা জনিত কারণেই এ সকল মৃত্যুর কারণ বলে জানা গেছে একাধিক মানবাধিকার সংস্থার জরিপে। মানবাধিকার রির্পোটে বলা হয়েছে, বিদেশে কর্মরত অবস্থায় গত ২০২৪ সালের মৃত্যুও সর্ব্বোচ রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। দীর্ঘ গত ত্রিশ বছরেও বিদেশে এত প্রবাসীর মৃত্যুও ঘটনা ঘটেনি। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিদেশে একাকী জীবন, আর্থিক অনটন, পারিবারের দুশ্চিন্তা এবং ডিপ্রেশনে দুর্ঘটনাজনিত কারণেই এত প্রবাসীর মৃত্যু ঘটেছে। একটু ভালো থাকার আশায় প্রতিদিন হাজারো মানুষ পাড়ি জমান বিদেশে। কিন্তু বিমানবন্দর দিয়ে এমন বহু বাংলাদেশির মরদেহ আসছে রোজ। শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য বলছে, প্রতিদিন মধ্যপ্রাচ্য থেকে দেশে আসছে ১৫ থেকে ২০ প্রবাসীর মরদেহ।
জরিপে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে বিদেশে রেকর্ড বাংলাদেশি শ্রমিকের মৃত্যু ঞটেছে। তারমধ্যে ৩১ ভাগই ‘অস্বাভাবিক’ বলে জানা গেছে। ২০২৪ সালে ৪ হাজার ৮শ’ ১৩ জন বাংলাদেশি শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে প্রবাসে। যা এ যাবত কালের সর্বোচ্চ। একে অস্বাভাবিক বলছে গবেষণা সংস্থা রামরু। সংস্থাটি জানায়, মারা যাওয়াদের গড় বয়স ৩৮ বছর। চিকিৎসকরা বলছেন, শারীরিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন নন প্রবাসীরা। উদাসীনতা আছে সরকারেরও।
এদিকে গত বছরে বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর সংখ্যা রেকর্ড ছুঁয়েছে। ওই বছর ৪,৮১৩ জন অভিবাসীর মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৫.৭% বেশি। এ তথ্য প্রকাশ করেছে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (আরএমএমআরইউ)। রাজধানীর একটি হোটেলে ‘প্রবাসে মৃত শ্রমিকদের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিতকরণ’ শীর্ষক সংলাপে এই তথ্য তুলে ধরা হয়। সংস্থাটির ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, এতো তরুণ মানুষ কেন মারা যাচ্ছে? সরকারের উচিত প্রতিটি মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ধারণে পোস্টমর্টেম নিশ্চিত করা। কিন্তু বর্তমানে তা করা হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, অনেক সময় মৃতদেহে আঘাতের চিহ্ন থাকলেও, মৃত্যুর সনদে একে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, যা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
জরিপে দেখা গেছে, মৃতদের গড় বয়স মাত্র ৩৮ বছর। ২০২৪ সালে যেসব প্রবাসী মারা গেছেন, তাদের গড় বয়স ছিল মাত্র ৩৮ বছর। বিশেষ করে, যারা আরব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শ্রমবাজারনির্ভর দেশে কাজ করতেন, তাদের মধ্যে নারীদের মৃত্যুর গড় বয়স ইউরোপ, আমেরিকা বা অন্যান্য উন্নত দেশের নারীদের চেয়ে অন্তত ১০ বছর কম।
২০১৭ থেকে ২০২১ সালের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রবাসী নারীদের মধ্যে ৩২% মৃত্যুই ‘অস্বাভাবিক’। যার মধ্যে দুর্ঘটনা, খুন ও আত্মহত্যা অন্তর্ভুক্ত। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, অনেকেই বিদেশে কাজ শুরু করার অল্প সময়ের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করছেন।
দোহারের রোকেয়া বেগমের আহাজারি সন্তানের জন্য। যিনি আট মাসের প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরছেন নিথর দেহে। পরিবারের আর্থিক কষ্ট ঘোচাতে রফিক গিয়েছিলেন সৌদি আরবে। সেখানে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর পর পাহাড়সম দুঃখ হয়ে এলো পরিবারের কাছে।
অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা রামরুর গবেষণা তথ্য বলছে, এসব মৃত্যুর ৩১ ভাগই ‘অস্বাভাবিক’। আর শুধু সৌদি আরবে বাংলাদেশিদের আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর হার ২৪ শতাংশ। রামরুর তথ্যে জানা যায়, ২০২৩ সালে বিদেশ থেকে এসেছে ৪ হাজার ৫৫২ প্রবাসীর মরদেহ। আর গেলো বছর সেই সংখ্যা ৪ হাজার ৮শ’ ১৩ যা এ যাবত কালের রেকর্ড। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, প্রবাসীদের মৃত্যুর কারনগুলো স্পষ্ট নয়।
সৌদি আরবের মক্কায় হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন ডা. এনাম খান। প্রবাসীদের রহস্যজনক এতো মৃত্যু নিয়ে তিনি বলছেন, স্বাস্থ্য সচেতনতার ঘাটতি ও বাংলাদেশ সরকারের উদাসীনতার কথা। প্রবাসে যাদের অস্বাভিক মৃত্যু হচ্ছে তাদের গড় বয়স ৩৮ বছর, এমনকি মৃতদেহে আঘাতের চিহ্ন থাকলেও সনদে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ লেখা থাকে।
অপরদিকে মানবাধিকার তথ্য বলছে, গত বছর রেকর্ড ৪৮১৩ প্রবাসী কর্মীর মরদেহ দেশে এসেছে। গত বছর রেকর্ড ৪ হাজার ৮১৩ প্রবাসী কর্মীর মরদেহ দেশে। এর আগে, ২০২৩ সালে দেশে এসেছিল ৪ হাজার ৫৫২ প্রবাসকর্মীর মরদেহ। ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডের সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য জানা গেছে। তবে পরিসংখ্যানে কোন দেশ থেকে কতজনের মরদেহ এসেছে তা আলাদা করা হয়নি।
এদিকে ২০২১ সালে ৩ হাজার ৮১৮ এবং ২০২২ সালে ৩ হাজার ৯০৪ বাংলাদেশি অভিবাসীর মরদেহ দেশে এসেছিল। ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডের ওয়েবসাইটে গত ১৪ জানুয়ারী এই পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়। প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে যান। তাদের অনেকেই বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে মারা যান। তবে, তাদের সবার মৃত্যুর সঠিক কারণ জানানো হয়নি পরিসংখ্যানে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৯৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মোট ৫৬ হাজার ৭৬৯ প্রবাসীকর্মীর মরদেহ দেশে এসেছে।
অপরদিকে বাংলাদেশী অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা ওয়্যারবী ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক জাছিয়া খাতুন বলেন, ‘বিদেশে অনেক বাংলাদেশি কর্মী অল্প বয়সে কাজ করতে গিয়ে মারা যান। তাদের মৃত্যুর পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। ‘কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তাজনিত সমস্যা আছে, কারণ শ্রমিকদের আবাসন হয় নিম্নমানের। তাছাড়া, বিদেশে যাওয়ার খরচ উঠাতে তারা ব্যাপক চাপ নেন, অতিরিক্ত কাজ করেন এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার খান না, বলেন তিনি।
জাছিয়া খাতুন আরও বলেন, ‘মৃত্যু সনদে সাধারণত “হার্ট অ্যাটাক” উল্লেখ থাকে। তবে মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে জানার জন্য আরও পরীক্ষা করা উচিত।’ এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘বিদেশে বাংলাদেশি মিশনগুলো এ ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা থাকতে পারে। ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ড প্রবাসীকর্মীদের মৃত্যুর পরিসংখ্যান রাখে এবং কল্যাণমূলক কর্মকান্ডের অংশ হিসেবে দাফন ও পরিবহন খরচ হিসেবে প্রতি মরদেহের জন্য ৩৫ হাজার টাকা দেয়া হচ্ছে।
এদিকে প্রবাসীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর তথ্য শুধুমাত্র শ্রমবাজার নির্ভর দেশগুলো থেকে পাওয়া যায়। বিপরীতে, এশিয়ার যেসব দেশে শ্রমের জন্য মানুষ যায় না বা উন্নত দেশগুলো, সেসব জায়গা থেকে এ ধরনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় না। একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো—প্রায় ৪৮% পরিবারের সদস্য বিশ্বাস করেন না যে মৃত্যুর সনদে উল্লেখিত কারণটি সঠিক।
কেন এতো মৃত্যু, কেন এত মানুষ, বিশেষ করে এত তরুণ, অল্প সময়েই বিদেশে গিয়ে মারা যাচ্ছেন। এই প্রশ্নের উত্তর আমরা পাচ্ছি না,” বলেন তাসনিম সিদ্দিকী। তিনি আরও বলেন, মৃত্যুর কারণ নিরূপণের জন্য যথাযথ তদন্ত ও সম্মানজনক ব্যবস্থাপনা ছাড়া এই সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। এই প্রতিবেদনটি প্রবাসী শ্রমিকদের জীবন ও মৃত্যুর গল্প তুলে ধরছে—যাদের পরিশ্রমে দেশের অর্থনীতি সচল থাকে, অথচ তাদের মৃত্যুর পরও অনেক সময় সম্মানটুকু নিশ্চিত হয় না। এখনই সময়, রাষ্ট্র ও সমাজের পক্ষ থেকে প্রবাসীদের অধিকারের বিষয়ে আরও সংবেদনশীল হওয়ার।
এছাড়া ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রতিটি মৃত্যুর জন্য ৩ লাখ টাকা দিয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। ওয়েজ আর্নার্স বোর্ডের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই ২০১৬ থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত দেশে মোট ১৭ হাজার ৮৭১ মরদেহ এসেছে যার ৬৭ দশমিক ৪ শতাংশ এসেছে উপসাগরীয় সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েত, কাতার ও বাহরাইন থেকে। এর মধ্যে সৌদি থেকে ৫ হাজার ৬৬৬ জন, আমিরাত থেকে ১ হাজার ৯১৩ জন ও ওমান থেকে ১ হাজার ৮৯৩ মরদেহ এসেছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিদেশ গেছেন মোট ১ কোটি ৬০ লাখ কর্মী, যাদের ৭৬ দশমিক ৩ শতাংশই গেছেন উপসাগরীয় ৬ দেশে।