আসন্ন রমজানে নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সংকটের পাঁয়তারা

- আপডেট সময় : ১২:২১:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২৫ ৭৬ বার পড়া হয়েছে
* মজুত ঠেকাতে নজরদারিতে অসাধু ব্যবসায়িরা
* সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে পুরো ফেব্রুয়ারী অভিযান
মার্চে শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান। এ সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশ কয়েকটি পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। এসব পণ্যের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে বেড়েছে বাদাম, কিশমিশ, ছোলাসহ বিভিন্ন পণ্যের আমদানি। আমদানিকৃত পণ্য বিক্রি হচ্ছে বন্দর থেকেই। এরপর যাচ্ছে ঢাকা, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। বন্দরের ব্যবসায়ীরা জানান, ভারত থেকে আমদানি করা পণ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে ট্রাকে করে। রমজান উপলক্ষে আগামী মাসের শুরু থেকে কার্যক্রম আরও বাড়বে।
বর্তমানে ব্যাংকে ডলার রেট সহনীয় থাকার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে আগামীতে বাড়বে পণ্যের আমদানি। আমদানিকারকরা বলছেন, বিগত কয়েকমাসে যে এলসি জটিলতা ও ডলার সংকট ছিল, তা বর্তমানে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বাড়বে আমদানি, কমবে পণ্যের দাম। চক ও মৌলভী বাজার ব্যবসায়িরা বলছেন, রমজানকে সামনে রেখে খেজুর, ছোলার বাজার বাড়তে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চাহিদার তুলনায় গেল ছয় মাসে পণ্য দুটির আমদানি অনেক কম। তবে ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ জানাচ্ছেন, আগের মজুত থাকায় বাজার অতটা অস্থির হবে না। এদিকে, পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট ঠেকাতে বিশেষ নজর দেয়ার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের।
এদিকে রমজানে পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে খেজুর আমদানিতে শুল্ক ও অগ্রিম কর কমানোর পাশাপাশি আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এই সুবিধা ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছে, প্রতিবছর রমজানের আগে সরকার তাদের নিয়ে বসলেও এবার সেই উদ্যোগ এখনো নেই। মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী সৈয়দ বসির উদ্দিন বলেন, এলসির মাধ্যমে পণ্য কিনে দেশে আনার পর অনেক ব্যবসায়ীই বলেন খরচ বেশি পড়েছে। এ বিষয়ে সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি অর্থনীতিবিদেরা কৃত্রিম মজুত ঠেকানোর উদ্যোগ নিতে জোর তাগিদ দিচ্ছেন। অর্থনীতিবিদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, আমদানি করা পণ্য বেশিরভাগ সময়ই ব্যবসায়ীরা মজুত করে রাখে। এতে তৈরি হয় পণ্যের সংকট। এ সব মজুতাগার নজরদারির আওতায় আনতে হবে। অর্ন্তর্বতী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য না কমায় বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর বিকল্প নেই বলে তাদের মত। রমজানে বাজারে পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখতে আমদানিকারকদের সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস কাস্টমস কর্তৃপক্ষের। হিলি কাস্টমস কর্তৃপক্ষের রাজস্ব কর্মকর্তা শফিউল ইসলাম বলেন, কাস্টমসের কার্যক্রম সম্পন্ন করে দ্রুততার সঙ্গে পণ্য খালাস দেয়া হচ্ছে। রমজানে বাজারে পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখতে আমদানিকারকদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। হিলি কাস্টমস ও বন্দরের তথ্যমতে, চলতি মাসে এখন পর্যন্ত ভারতীয় ৭৩ ট্রাকে ১ হাজার ৭২৮ মেট্রিক টন ছোলা, কিশমিশ, বাদাম ও নারিকেল আমদানি হয়েছে।
টাস্কফোর্সের একাধিক সদস্য বলেছেন, রমজানকে সামনে রেখে সিন্ডিকেট করে খেজুর, ছোলার বাজারে বাড়তে পায়ঁতারা শুরু করেছে অসাধু ব্যবসায়িরা। এরফলে বেড়ে যেতে পারে খেজুর ও ছোলার দাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চাহিদার তুলনায় গেল ছয় মাসে পণ্য দুটির আমদানি অনেক কম। তবে ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ জানাচ্ছেন, আগের মজুত থাকায় বাজার অতটা অস্থির হবে না। এদিকে, পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট ঠেকাতে বিশেষ নজর দেয়ার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের।
ঊ্যাংক কর্মকর্তা জানান, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয় সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এর মাঝে মার্চে শুরু হতে যাওয়া রমজানে, পণ্যের দাম কেমন হতে পারে এ নিয়ে শঙ্কিত তারা। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা জানান, যেভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, তাতে সামনের দিনগুলোতে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। রোজায় এ অবস্থা কি হয় কে জানে! বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, রমজানকে সামনে রেখে সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকা খেজুরের আমদানি অনেক কম। রমজানে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টনের বিপরীতে গত জুলাই-ডিসেম্বরে আমদানি হয়েছে মাত্র ৪ হাজার ২৩৩ টন। সরকার এই পণ্যে ভ্যাট ট্যাক্স কমালেও বাজারে দাম না কমার কথা আগে ভাগেই বলছেন ব্যবসায়ীরা। নওশীন ফ্রুটস ইন্টারন্যাশনালের প্রোপ্রাইটার মো. রায়হান তালুকদার বলেন, ২৫ শতাংশ শুল্ক কমানো হলেও এর প্রভাব জনগণের ওপর পড়বে না। শুল্ক আরও কমানো উচিত।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ডলারের ঊর্ধ্বমুখী দাম ও শুল্ক কমানোর প্রভাব কিছুটা হলেও পড়বে খেজুরের বাজারে। অবশ্য ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ জানাচ্ছেন, ছাত্র-জনতার বিপ্লবের জেরে আমদানি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে আমদানি বাড়ার পাশাপাশি আগের থাকা পণ্যের মজুত চাহিদা পূরণে সাহায্য করবে।
কোল্ড স্টোরেজ সমিতির পরিচালক গোলাম সরওয়ার বলেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অনেক ব্যবসায়ীই খেজুর আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। চাহিদা বাড়ায় আগামী দিনগুলোতে বাড়তে পারে আমদানিও।
গত ২১ নভেম্বর এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের সই করা প্রজ্ঞাপন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এতে বলা হয়, নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের বাজারমূল্য সর্বসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে সরকার আমদানি-নির্ভর খাদ্যপণ্যের শুল্ক-কর হ্রাস এবং ক্ষেত্র বিশেষে সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেছে। খেজুর একটি আমদানি-নির্ভর ফল, যা সবশ্রেণির মানুষের ইফতারের অপরিহার্য উপাদান। পবিত্র রমজান মাসে খেজুরকে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য খেজুর আমদানির ওপর বিদ্যমান কাস্টমস ডিউটি ও অগ্রিম আয়কর হ্রাস এবং আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এদিকে ইফতারির আরেক অনুষঙ্গ ছোলার আমদানি হয়েছে ৩৯ হাজার ৬২৩ টন। রমজানে চাহিদা প্রায় ১ লাখ টন। আর, চিনি আমদানির পরিমাণ প্রায় ৫ লাখ ৬২ হাজার টন এবং ভোজ্যতেল ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন।
এছাড়া প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, খেজুর আমদানির ওপর বিদ্যমান কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশ হতে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ এবং বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। অর্থাৎ মোট করভার ৬৩ দশমিক ৬০ শতাংশ হতে কমিয়ে ৩৮ দশমিক ৭০ শতাংশ করা হয়েছে। এই সুবিধা ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
খেজুর আমদানিতে বিদ্যমান শুল্ক-কর কমানোর ফলে মানভেদে প্রতি কেজি খেজুরের আমদানি ব্যয় প্রায় ৬০ টাকা হতে ১০০ টাকা কমতে পারে। আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-কর কমানোর ফলে খেজুরের আমদানি বৃদ্ধি পাবে, বাজারে খেজুরের সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে। এতে খেজুরের বিক্রয়মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে বলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড মনে করে। এর আগে ১৭ নভেম্বর রমজানে খেজুরের মূল্য স্থিতিশীল করার জন্য খেজুর আমদানিতে গত বছরের মতো বিদ্যমান কাস্টম ডিউটি ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ নির্ধারণ ও সমুদয় আগাম কর ৫ শতাংশ অব্যাহতি দেয়ার সুপারিশ করেছিল বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন।