ওষুধের দামে পিষ্ট রোগীরা
- আপডেট সময় : ০৯:২০:২৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫ ৯ বার পড়া হয়েছে
- ১ বছরে ওষুধ ভেদে বেড়েছে ৯০ শতাংশ
- ১১৭টি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে ঔষধ প্রশাসন
- ২৭ হাজারেরও বেশি নামে উৎপাদন করে কোম্পানিগুলো
- ক্রেতার চেয়ে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যস্ত অধিদপ্তর
- অসুস্থ মার্কেটিং প্রতিযোগিতা দায় দিচ্ছে বিশেষজ্ঞরা
খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে লাগামহীনভাবে বেড়েছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম। গত বছর খুচরা পর্যায়ে কয়েক দফায় বিভিন্ন ওষুধের দাম বাড়িয়েছে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। সর্বশেষ সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ওষুধভেদে ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়েছে। এবার সরকার ওষুধের ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়াল। স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাড়তি এই ভ্যাটও যাবে ক্রেতার পকেট থেকে। ওষুধের দামও আরেক দফা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। গত ৯ জানুয়ারি যে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে, তার মধ্যে ওষুধও রয়েছে। অধ্যাদেশে স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ওষুধের ওপর ভ্যাট ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ ভ্যাট বেড়েছে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ, যা ৯ জানুয়ারি থেকেই কার্যকর হয়েছে।
দেশের চলমান পরিস্থিতির মধ্যেও গত কয়েক মাসের মধ্যে বেশ কিছু ওষুধের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। এর মধ্যে বাজারে শীর্ষস্থানীয় এক কোম্পানির এক ওষুধের দাম বেড়েছে প্রায় ৮৪ শতাংশ। এ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক, বিভিন্ন ধরনের ইনজেকশন, ব্যথানাশক ট্যাবলেট, ভিটামিন, গ্যাস্ট্রিক ও ডায়াবেটিসের ওষুধের দামও বেড়েছে।
ফার্মেসিগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যথানাশক ট্যাবলেট, অ্যান্টিবায়োটিক, ডায়াবেটিস, ভিটামিন, গ্যাস্ট্রিকসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধের এক পাতার দাম ১২০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যারা দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন, তাদের অবস্থা শোচনীয়।
পাইকারি ও খুচরা ওষুধ বিক্রেতাদের অভিযোগ, এক শ্রেণির অতি মুনাফালোভী ওষুধ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে বছরের পর বছর ওষুধের দাম বাড়াচ্ছে। আর ওষুধের মূল্য নির্ধারণে সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। ফলে সে সুযোগে যে যার মতো দাম বাড়ায়। আর ওষুধের দাম বাড়ার কারণে দোকানদারদেরও বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অনেক সময় কাস্টমারদের সঙ্গে দাম নিয়ে তাদের তর্ক-বিতর্কও করতে হয় ও দোকানদারদের কৈফিয়ত দিতে হয়।
দেখা যায়, সরকার তথা ঔষধ প্রশাসন মাত্র ১১৭টি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে থাকে। অথচ দেশে দেড় হাজারের বেশি জীবনরক্ষাকারী ওষুধ ২৭ হাজারেরও বেশি নামে (ব্র্যান্ড নামে) উৎপাদন করে থাকে ওষুধ কোম্পানিগুলো। ১১৭টি ওষুধের বাহিরে যত ঔষুধ বাজারে রয়েছে, বেশির ভাগ উৎপাদক কোম্পানির ঠিক করা দামে বিক্রি হচ্ছে। অভিযোগ আছে, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখার চেয়েও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যস্ত এবং এ কারণেই ওষুধ শিল্পে জড়িত ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ালেও ঔষধ প্রশাসন সে বিষয়ে অধিকাংশ সময়ই নীরব থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ কোম্পানিগুলোর উচ্চাভিলাষী বিপণন নীতি এবং বেশি মুনাফা করার প্রবণতা। কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের নানা উপহারসামগ্রী দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানিগুলো নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে। উন্নত বিশ্বের মতো ট্রেড নামের পরিবর্তে জেনেরিক নাম (সব কোম্পানির ওষুধের একই নাম হবে) প্রেসক্রিপশনে লেখার নিয়ম চালু করা হলে অসুস্থ মার্কেটিং প্রতিযোগিতা বন্ধ হবে এবং বিভিন্ন ওষুধের দাম অনেকাংশে কমে যাবে।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের আগে পর্যন্ত কয়েক দফায় বিভিন্ন ওষুধের দাম বাড়ায় উৎপাদকেরা। এরপর সেপ্টেম্বর থেকে হঠাৎ জীবনরক্ষাকারী প্রায় অর্ধশত ওষুধের দাম ১০ থেকে ৫০ শতাংশের বেশি বাড়ানো হয়। ভোক্তার স্বার্থকে গুরুত্ব না দিয়ে ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা অনুযায়ী ওই দাম বাড়ানোর অনুমোদন দেয় সরকারের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। অধিদপ্তর তখন বলেছিল, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একই পণ্যের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। এই পদক্ষেপে কোনো কোনো ওষুধের দাম ৫ থেকে ১০ শতাংশ বাড়তে পারে। ৯ জানুয়ারি বাড়ানো ভ্যাট আদায় নিয়ে জটিলতা দেখা দিতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তিনি জানান, যেসব ওষুধের দোকানে (ফার্মেসি) বিক্রির তথ্য সংরক্ষিত থাকে, তারা সহজেই বর্ধিত ভ্যাট দিতে পারবে।
অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, সরকার অর্থ সংকটে রয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য সাধারণত কর বাড়ানো, অতিরিক্ত টাকা ছাপানো, ঋণ নেওয়া ও ভ্যাট বাড়ানো হয়। কিন্তু সরকার কর বাড়াতে পারছে না। জরুরি মুহূর্ত ছাড়া অতিরিক্ত টাকা ছাপালে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। আগের সরকার যে অবস্থানে রেখে গেছে, তাতে দাতা সংস্থার কাছ থেকে এই সরকার ঋণও পাবে না। সর্বশেষ উপায় হিসেবে সরকারকে ভ্যাট বাড়াতে হচ্ছে। ওষুধে বর্ধিত ভ্যাট ক্রেতার কাছ থেকে আদায় করা হবে বলে চিকিৎসার ব্যয় বাড়ায় বেশি চাপে পড়বে নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ।
ওষুধের ওপর বর্ধিত ভ্যাট কীভাবে আদায় হবে তা মূলত ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর নির্ধারণ করবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির সভাপতি ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মুক্তাদির। তিনি বলেন, অধ্যাদেশ গত বৃহস্পতিবার জারি হয়েছে। এখন এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে পারছি না। হয়তো ওষুধের মোড়কে আলাদা সিল দিয়ে এই ভ্যাট যুক্ত করা হবে। ভ্যাট ক্রেতাদের কাছ থেকেই নেওয়া হয়। তবে কীভাবে এই ভ্যাট যুক্ত করা হবে, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর তা আমাদের জানাবে। ভ্যাট বাড়ানোর বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের আগে কিছু জানানো হয়নি।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশীয় চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষুধ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ ইউরোপ, আমেরিকা অঞ্চলসহ বিশ্বের ১৫৭টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুমোদিত রপ্তানি আয় ৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বেশি। দেশে ২২৯টি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানসহ ইউনানি, আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথিক ও হারবাল ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৭৩৩টি। অ্যালোপ্যাথিকের প্রায় ৩ হাজার জেনেরিকের ৩৭ হাজার ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে দেশে। রপ্তানি ও স্থানীয় মিলিয়ে দেশীয় ওষুধের বাজার প্রায় ৪০ কোটি টাকার।
স্থানীয় ওষুধ ব্যবসায়ীদের ওপর নতুন ভ্যাট হার বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আসরাফ হোসেন ও ডা. মো. আকতার হোসেন। তাঁরা এ বিষয়ে আর কিছু জানাতে অপারগতা জানান।
দাম বৃদ্ধি হওয়া ওষুধের মধ্যে রয়েছে ব্যথানাশক, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ভিটামিন ও চর্মরোগের। ঘরে ঘরে এ ধরনের রোগের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। অসচ্ছল পরিবারগুলো ওষুধের দাম বৃদ্ধির ফলে চিকিৎসাসেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। চাল-ডাল কিনতেই তাদের নাভিশ্বাস। এর ওপর ওষুধের মূল্যবৃদ্ধিতে কেনার সামর্থ্য হারিয়েছেন তারা।