আতঙ্ক ও হতাশায় ইসরাইলিরা

- আপডেট সময় : ১০:২৩:৩৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫ ৬ বার পড়া হয়েছে
ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় গভীর রাতে ইসরাইলের একটি আবাসিক ভবনে আঘাত হানার পর গতকাল সোমবার সকাল থেকে ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার শুরু করছেন উদ্ধারকর্মীরা। ২০ তলা ভবনের মাঝখানে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল গর্ত। এই হামলায় অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে দুইজন আশ্রয়কেন্দ্রেও অবস্থান করছিলেন।
প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, ক্ষেপণাস্ত্রটি দুটি বোমা আশ্রয়কেন্দ্রের মাঝের দেয়ালে আঘাত করে। দেয়ালটি সরাসরি বিস্ফোরণের ধাক্কা সহ্য করতে পারেনি। তৃতীয় এক বাসিন্দা উপরের তলায় ছিলেন। হামলায় আশপাশের আরও তিনটি ভবনও গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মোট প্রায় ৩০০টি ফ্ল্যাট এখন খালি। বাসিন্দারা তাদের মালপত্র সংগ্রহ করতে এলেও কেউ জানেন না কবে ফিরতে পারবেন। সকাল ৪টার দিকে এ হামলা ঘটে। এলাকাটি আবাসিক, আশেপাশে কোনও কৌশলগত স্থাপনাও নেই।
ইসরায়েল বলছে, ইরান ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক জনগণকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। দেশটির সেনাবাহিনী দাবি করেছে, ইরানি পাল্টা-হামলা ইসরায়েলের বড় পরিসরের সামরিক অভিযানের জবাব। এ ঘটনায় ইসরায়েলজুড়ে মনোভাবের পরিবর্তন স্পষ্ট। বহু ইসরায়েলি বিশ্বাস করতেন, তাদের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি নিরাপত্তা দিতে সক্ষম। কিন্তু ইরানের পাল্টা হামলার পর সেই আস্থা নড়বড়ে হয়ে গেছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের বহুস্তরীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এখনও শক্তিশালী, তবে ‘শতভাগ নিখুঁত’ নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই হামলা ইসরায়েলিদের মনস্তত্ত্বে বড় ধাক্কা দিয়েছে—কেবল ক্ষয়ক্ষতির জন্য নয়, নিরাপত্তা বোধেরও অবসানের জন্য।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার ভূগর্ভস্থ অংশে হামলা হয়নি : আইএইএ
জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা আইএইএ’র প্রধান রাফায়েল গ্রোসি বলেছেন, ইসরায়েলি হামলায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার ভূগর্ভস্থ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। হামলায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাটির নাতাঞ্জ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রের মাটির ওপরের অংশ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। খবর এএফপির। গত শুক্রবার ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাসহ বেশকিছু সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে অতর্কিত বিমান হামলা চালায়। ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে- এমন অভিযোগে হামলাটি চালানো হয়। তবে ইরান এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, শুক্রবারের হামলায় নাতাঞ্জ সাইটের ভূগর্ভের ওপরের অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। এখানে ইরান ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, যা আণবিক বোমা তৈরির জন্য যে ৯০ শতাংশ সমৃদ্ধ করার প্রক্রিয়া রয়েছে, তার চাইতে অনেক নিচে। গতকাল সোমবার আইএইএ’র প্রধান রাফায়েল গ্রোসি সংস্থাটির অভূতপূর্ব এক বোর্ড সভা শেষে জানান, শুক্রবারের পর নাতাঞ্জ কেন্দ্রে আর কোনো ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়নি। রাফায়েল গ্রোসি বলেন, নাতাঞ্জ প্লান্টের বাইরের রেডিওঅ্যাকটিভ মাত্রা পরিবর্তন হয়নি এবং তা স্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছে। লক্ষণ দেখে বোঝা যাচ্ছে, এতে বাইরের কোনো রেডিওলজিক্যাল প্রভাব পড়েনি। রাফায়েল গ্রোসি আরও বলেন, কেন্দ্রটির ভূগর্ভস্থ কাসকেড হলে যেখানে জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ প্ল্যান্ট রয়েছে, সেখানে হামলার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। তবে কাসকেড হলের শক্তি কমে যাওয়ায় সেখানে থাকা সেন্ট্রিফিউজ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
আকাশপথে ইরানকে সহায়তা করছে চীন-রাশিয়া! ঃ
তেহরান ও তেল আবিবের মধ্যে চলমান তীব্র সংঘাতের মধ্যে চীন ও রাশিয়া ইরানকে ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিমান চালান পরিবহণে সহায়তা করছে বলে দাবি করেছে ইসরায়েলি গণমাধ্যম চ্যানেল ফোরটিন। বেইজিং ও মস্কো উভয়ই ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলার কঠোর নিন্দা জানিয়েছে।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই গত শনিবার ইরানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন এবং তেহরানের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি বেইজিংয়ের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তবে চীনের এই শীর্ষ কূটনীতিক এও বলেছেন যে, ইরানের পরমাণু ইস্যু সমাধানের কূটনৈতিক উপায় এখনো শেষ হয়ে যায়নি এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের আশা রয়ে গেছে।
ইসরায়েলি মিডিয়ার প্রতিবেদন অনুসারে, গত ৬ জুন যুক্তরাষ্ট্র দশজন ব্যক্তি এবং সাতটি প্রতিষ্ঠানের ওপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ওয়াশিংটন জানিয়েছে, এসব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান ইরানের সঙ্গে ব্যবসায় জড়িত। এগুলোর মধ্যে হংকং-ভিত্তিক হিরো কম্পেনিয়ন লিমিটেড, প্লজকম লিমিটেড এবং কিনলার ট্রেডিং লিমিটেডের মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ওয়াল স্ট্রীট জার্নালের খবর অনুযায়ী, ইরান চীন থেকে হাজার হাজার টন ব্যালিস্টিক মিসাইলের উপাদান অর্ডার করেছে। লেনদেনের সঙ্গে পরিচিত সূত্রকে উদ্ধৃত করে পত্রিকাটি দাবি করেছিল, তেহরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু কর্মসূচির ভবিষ্যৎ আলোচনা করার সময় ‘সামরিক সক্ষমতা পুনর্গঠন’ করতে চাইছে।
তেহরানের আকাশসীমা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের দাবি ইসরাইলের ঃ ইসরাইলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা ইরানের রাজধানী তেহরানের আকাশে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফরিন বলেন, আমরা তেহরানের আকাশ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছি। ইরানের এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার ধ্বংস করে দিয়েছি। খবর বিবিসির। তিনি আরও জানান, ইসরাইলি যুদ্ধবিমান ও ড্রোন বর্তমানে কোনো বাধা ছাড়াই তেহরান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে এবং ইরানের সামরিক সক্ষমতা চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এদিকে এ ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরই ইরানের পশ্চিমাঞ্চলে নতুন করে ইসরাইলি হামলার খবর পাওয়া গেছে। ইরানি সংবাদমাধ্যম তাসনিম জানিয়েছে, ইরাক সীমান্তবর্তী ইলাম প্রদেশের মুসিয়ান শহরের পৌরসভার ফায়ার সার্ভিস ভবনে বর্বর হামলা চালানো হয়েছে। অন্যদিকে ফার্স নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, ওই অঞ্চলের একটি হাসপাতালেও বোমাবর্ষণ করা হয়েছে। দু’টি সংবাদমাধ্যমই ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী -এর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।
প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়েছে, ইসরাইলের বেশ কয়েকটি ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করেছে ইরানি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলায় সংঘাত আরও চরমে উঠছে। তেহরান ও পশ্চিম ইরানজুড়ে বোমা হামলা এবং ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতে নাগরিক অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।এই মুহূর্তে পশ্চিমা গণমাধ্যম, বিশেষ করে বিবিসি সাংবাদিকরা ইরানের ভেতর সরাসরি রিপোর্টিং করতে পারছেন না সরকারিভাবে আরোপিত সীমাবদ্ধতার কারণে, ফলে নিরপেক্ষ তথ্য যাচাই করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
ইসরায়েলের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে ইরানে একজনের মৃত্যুদণ্ড ঃ ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ইরানে ইমাঈল ফেকরি নামে এক ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। ২০২৩ সালে গ্রেপ্তার হওয়া ফেকরি অর্থের বিনিময়ে গোপন তথ্য পাচারের চেষ্টা করেছিলেন বলে দেশটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এটি নিয়ে ইরানে এ ধরনের তৃতীয় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলো বলে ধারণা করা হচ্ছে। গতকাল সোমবার ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের বরাতে এ তথ্য জানায় সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, গত রোববার ইসরায়েলেও ইরানের গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির সন্দেহে দুই ইসরায়েলিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে গত সপ্তাহে তেল আবিবে একই ধরনের অভিযোগে ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
এদিকে ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, দেশটির বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, স্থানীয় সময় গতকাল সোমবার দিনগত রাত ২টা (বাংলাদেশ সময় সোমবার রাত ১১টা ৩০) পর্যন্ত ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। গত সপ্তাহ থেকে ইরানের আকাশসীমা বাণিজ্যিক ফ্লাইটের জন্য বন্ধ রয়েছে। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, তারা ‘তেহরানের ওপর সম্পূর্ণ আকাশ নিয়ন্ত্রণ’ অর্জন করেছে এবং ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ইরানের আকাশসীমা ব্যবহার করে দেশটির অভ্যন্তরে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানছে।