ছিঁচকে চোর থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক!
- আপডেট সময় : ১০:৫৬:৫৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২৫ ৫৭৯ বার পড়া হয়েছে
-
ডিবি হারুনের ম্যানেজার সোনা মোল্লার একাল-সেকাল
-
কৃষকদল নেতার শেল্টারে থাকায় গ্রেফতার হচ্ছে না
ছিঁচকে চোর থেকে ডিএমপির গোয়েন্দা প্রধান (ডিবি) হারুন-অর-রশীদের (বর্তমানে পলাতক) হাত ধরে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন তারই কথিত ম্যানেজার মিজানুর রহমান ওরফে সোনা মোল্লা (সোনা মিয়া)। হারুনের ম্যানেজার হিসেবে এই সোনা মোল্লার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার রুপাপাত এলাকায়। রুপাপাত ইউনিয়নের একাধিক প্রবীন ব্যাক্তি বলেছেন, গত ৯০ দশকে বোয়ালমারী গ্রামে বখাটে যুবক হিসেবে কুখ্যাতি ছিল। গ্রামের শাহাদাত নামে এক ব্যক্তিকে মারধর টাকা ছিনিয়ে নেয়। মারধওে শাহাদাতের দুটি দাঁত ভেঙ্গে যায়। এই চুরি ছিনতাই ও মাস্তানীর অপরাধের সালিশে গ্রামের মোড়ল ও মাতাব্বরগন সোনা মোল্লাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।
এরপরই সোনা মোল্লা রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকার বনানী চেয়ারম্যান বাড়ী এসে রাজীব চৌধুরীর একটি আবাসিক হোটেলে বয়ের চাকরি নেয়। সেখানে ওই হোটেলে সোনা পাচারকারী ধরার অভিযানে ডিবি হারুনের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। এসময় হারুর গাজীপুরের পুলিশ সুপার। এসময় হোটেলের চাকুরি ছেড়ে হারুনের সকল চাঁদার টাকা সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। গাজীপুর জেলা এসপি থাকাকালে সোনা মোল্লাকে দিয়ে সকল শিল্পপতি ও গার্মেন্টস জুট ব্যবসায়ি এবং ডেপেলপার ব্যবসায়িদের ধরে এনে জিম্মী করে সোনা মোল্লার মাধ্যমে লাখ লাখ কোটি টাকা আদায় করতো। বর্তমানে সোনা মোল্লার বিরুদ্ধে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে নিহত শিক্ষাথীর স্বজন হত্যা মামলা দায়ের করেছেন মিরপুর মডেল থানায়। এছাড়া পল্টন ও যাত্রাবাড়ি থানায় তার বিরুদ্ধে আরো ২টি মামলা রয়েছে। এ সকল মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলেও স্থানীয় কৃষক দলের নেতার ছত্রছায়ায় থেকে গ্রেফতার হচ্ছে না।
হারুন যখন যেখানে চাকরি করেছেন, সেখানেই জড়িয়েছেন নানা অপকর্মে। গাজীপুরের এসপি থাকাকালে ২০১৫ সালের ১৯ নভেম্বর গভীর রাতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক সংলগ্ন এমসি বাজারের পাশে তাহের অ্যান্ড সন্স ফিলিং স্টেশনের ৭ কোটি টাকার ১ বিঘা জমি একটি গ্রুপকে দখল করে দেন হারুন। এ ছাড়া গাজীপুরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা রাকিব সরকারকে সাড়ে ১৭ শতক জমি দখল নিতে পুলিশি সহায়তা দেন হারুন। ২০১৬ সালের ৯ নভেম্বর গাজীপুর মহানগরের মাধবপুর এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা কফিল উদ্দিনের দুই বিঘা জমি একই কায়দায় দখলে নেওয়া হয়। গাজীপুরের ১০০ কোটি টাকা মূল্যের একখ- জমি আমমোক্তারনামা জোর করে রেজিস্ট্রি করে দিতে সহযোগিতা করার অভিযোগে হারুনসহ আরও কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়। গাজীপুরের দায়িত্বে থাকাকালে হারুনের বিরুদ্ধে সব মিলিয়ে তিন শতাধিক মানুষকে হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রায় সবার কাছ থেকেই তিনি ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন। যারা টাকা দেননি তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন।
গাজীপুর থেকে নারায়ণগঞ্জে বদলি করা হলে সেখানে নানা অপকর্মে জড়ান হারুন। ওই সময় ১৪ লাখ করে টাকা সোনা মোল্লার মাধ্যমে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় হারন। কিন্তু জালিয়াতির মাধ্যমে ১৮ জন পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের প্রমাণ পায় পুলিশ সদর দপ্তর। পরে ওই কনস্টেবলরা চাকরি হারালেও সোনা মোল্লা ও হারুনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, সোনা মোল্লা লম্বা এবং সুদর্শন হওয়ায় সে ডিবির টীমের সঙ্গে অভিযানে যেত। সোনা মোল্লা ও হারুনের টীম বেশ কয়েকজন শিল্পপতিকে তুলে নিয়ে সাজানো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায় ছিল কাজ। দাবি অনুযায়ী তার ম্যানেজার সোনা মোল্লার কাছে চাঁদা টাকা না দেয়ায় পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাসেমের ছেলে, আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজের স্ত্রী-পুত্রকে তুলে নিয়ে যান হারুনের টীম। ওই ঘটনায় তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
এছাড়া উত্তরার জাতীয় পার্টি নেতা আলমগীর কবির পাওনা ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা চাইতে গিয়ে হারুনের রোষানলে পড়েন। হারুনের কথিত মামা পিএম এর বাবুর্চী জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে হারুনের দখল করা তিনটি প্লটে মাটি ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ করেন আলমগীর কবির। এ কাজের জন্য ৪০ লাখ টাকা পরিশোধ করলেও ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা বাকি রয়ে যায়। সেই টাকা চাইতে যাওয়ায় সোনা মোল্লার ডিবি টীম দিয়ে আলমগীর কবিরসহ তার তিন সহযোগীকে তুলে নিয়ে যান হারুন। পাঁচ দিন ডিবি অফিসে আটকে রেখে চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। এরপর কোনো টাকা পাবে না মর্মে লিখিত দেওয়ার পর আলমগীর কবির ও তার সহযোগীদের চাঁদাবাজির মামলায় আদালতে পাঠানো হয়।
আলমগীর কবির বলেন, ৩ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর বাসায় দীর্ঘদিন সস্ত্রীক বসবাস করতেন ৭৫ বছর বয়সী এনায়েত উল্লাহ খোরাসানি। এক দিন সকালে হারুনই নিজে এসে ওই প্লটটি দখল করেন। ওই সময় আমরা সঙ্গে ছিলাম। বয়স্ক স্বামী-স্ত্রীকে মালপত্রসহ কাভার্ডভ্যানে তুলে সদরঘাট নিয়ে ফেলে আসা হয়। আব্দুল আলিম নামে উত্তরার বাসিন্দা বলেন, উত্তরার অধিকাংশ প্লট হারুনের দখল করা। যেই প্লটটি তার পছন্দ হতো, তার মালিককে ডিবি অফিসে তুলে নিয়ে যেতেন। এরপর বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে জমি দখল করতেন। হরুনের দখলবাজি ও চাঁদাবাজির অন্যতম সহযোগী ছিলেন সোনা মোল্লা। ডিজে সানি নামে থাইল্যান্ড প্রবাসী এক ব্যক্তি বলেন, সোনা মোল্লাকে দিয়ে আমাকে ডিবি অফিসে ডেকে নিয়ে হারুন ২০ লাখ টাকা চায়। পরে আমি মামলার ভয়ে ১০ লাখ টাকা দিই। আমার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়েও আমার বিরুদ্ধে এক নারীকে দিয়ে মিথ্যা মামলা দেয়ায়। সেই মামলায় আমি ২১ দিন জেল খেটেছি। গাজীপুরের একাধিক জুট ব্যবসায়ী বলেছেন, ডিবি হারুনের ছত্রছায়ায় মিজান ওরফে সোনা মোল্লা হারুনের পরিবারের সদস্য ছিল। সে সকল টাকা পয়সা লেন দেন, দাওয়াত, কালেকশন, বিচার সালিশীর দিনক্ষন ঠিক করতো। হারুন ঢাকা মহানগর ডিবি প্রধান হওয়ার সোনা মোল্লার পোয়া বারো হয়ে উঠে। হারুনের ম্যানেজার থাকার সুবাদে আওয়ামীলীগের নেতা সোনা মোল্লা তৎকালিন এমপি, মন্ত্রী আবদুর রহমান, নিক্সন চৌধুরী ও ফারুক খানের আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিল।
পাশাপাশি হারুনের শেল্টারে থেকে পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে রুপাপাত ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তার দুর্নীতির কারণে আওয়ামীলীগের এই বর্ষিয়ান নেতাদের সঙ্গে থেকে হারুনের শেল্টারে বনে যান হাজার কোটিপতি। তাদের সঙ্গে মিশে বোয়ালমারী এলাকারবিপুল টাকা থরচ করে এমপি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। দেখা করেন ফারুক থান, নিক্সন চৌধুরী ও আবদুর রহমানের সঙ্গে। কিন্তু বিধিবাম। ৫ আগষ্ট আওয়ামী ফ্যাসিষ্ট সরকারের পতন এবং পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার সময় সোনা মোল্লা গা ঢাকা দেয়। ভাতের হোটেলের হারুনও পালিয়ে যায়।
বোয়ালমারী এলাকার সামাজিক সংগঠনের কর্মকর্তারা জানান, খোলস পাল্টে এখন সোনা মোল্লা এলাকায় এসে নিজেকে বিএনপির নেতা দাবি করছেন। তিনি এখন কেন্দ্রিয় কৃষক দলের সহ-সভাপতি এবং বিএনপির স্থানীয় এমপি প্রাথী নাসির উদ্দিনের শেল্টারে রয়েছেন। পাশাপাশি ফরিদপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেনের সান্নিধ্যে এলাকায় চলাফেরা করছেন।
গত ২৩ সালে দুর্নীতির কারণে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার রুপাপাত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান সোনা মোল্লাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোশারেফ হোসাইন সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের ইউনিয়ন পরিষদ-১ শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব জেসমীন প্রধান সই করা প্রজ্ঞাপনে বিষয়টি জানানো হয়। বোয়ালমারী উপজেলাধীন রুপাপাত ইউপির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মোল্লার বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর দুদক মামলা করে। আদালত আমলে নিয়ে বিচারকার্য শুরু করায় স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছেন। ওই মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) আদালত কর্তৃক গৃহীত হওয়ায় তার দ্বারা ইউপির ক্ষমতা প্রয়োগ প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণে সমীচীন নয় মর্মে সরকার মনে করে। ওই চেয়ারম্যানের সংঘটিত অপরাধমূলক কার্যক্রম ইউপিসহ জনস্বার্থের পরিপন্থি বিবেচনায় স্থানীয় সরকার (ইউপি) আইন অনুযায়ী তাকে পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। ওই সময়ে হারুন এ মামলায় কার্যক্রম চাপা দিয়ে রেখেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এবিষয়ে মিজানুর রহমান ওরফে সোনা মোল্লাকে মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, তার বিরুদ্ধে একটি চক্র ষড়যন্ত্র করছে। তিনি এসকল অনৈতিক কাজে জড়িত নয়।