তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে ধুম্রজাল
- আপডেট সময় : ৫১ বার পড়া হয়েছে
গেল কয়েক দিন ধরেই তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা ও জনমনে অস্থিরতা নতুনভাবে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতির মাঝেও ছেলে ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এখনও দেশে ফিরছেন না-এই প্রশ্ন এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে গরম ইস্যু।
বেগম জিয়া বর্তমানে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসাধীন। চিকিৎসকরা বলছেন, তাঁর অবস্থা শঙ্কামুক্ত নয়। মায়ের এমন সংকটময় মুহূর্তেও তারেক রহমানের বিদেশে অবস্থান সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিএনপি সমর্থকদের মধ্যেও হতাশা সঞ্চার করছে।
অন্যদিকে, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া বেশিরভাগ মামলাই বাতিল হয়েছে বা তিনি জামিনে আছেন। ফলে আইনগতভাবে তার দেশে ফিরতে বাধা নেই বলেই জানিয়েছে বর্তমান অন্তবর্তী সরকার। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও নিরাপত্তা ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আশ্বাস দেয়া হয়েছে বারবার। সরকারের বক্তব্য-দেশে ফিরতে চাইলে তারেক রহমানকে বাধা দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই।
তবুও প্রশ্ন-কেন তিনি ফিরছেন না? তারেক রহমান নিজেই ইঙ্গিত দিয়েছেন, দেশে ফেরা এখন শুধু তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে না। রয়েছে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিবেচনা। বিএনপি উচ্চপর্যায়ের নেতারা দীর্ঘদিন ধরে বলছেন- তিনি খুব দ্রুতই দেশে ফিরবেন। তবে সুনির্দিষ্ট সময় বা পরিকল্পনা নিয়ে তারা নিশ্চুপ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তারেক রহমানের দেশে ফেরা শুধু পারিবারিক দায়বদ্ধতার বিষয় নয়; এটি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি ও ক্ষমতার ভারসাম্যে বড় পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। তাই তাঁর প্রত্যাবর্তন নিয়ে দল ও সংশ্লিষ্ট মহলে দফায় দফায় আলোচনা চলছে। তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে-তা দূর না হলে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা গুঞ্জন, সমালোচনা ও প্রত্যাশার পারদ আরও বাড়বে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
গত ২৩ নভেম্বর রাতে বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন খালেদা জিয়া। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা জানান, তার ফুসফুসে ইনফেকশন হয়েছে। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থা সংকটাময়। পরের দিন শুক্রবার তিনি বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নেওয়ার মতো শারীরিক অবস্থা নেই খালেদা জিয়ার। খালেদা জিয়ার এমন অবস্থার মধ্যে শনিবার এক ফেইসবুক পোস্টে নিজের দেশে ফেরার বিষয়ে কথা বলেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, দেশে ফেরার বিষয়টি তার একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। তার এমন বক্তব্যের পর সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি নেই। তিনি দেশে ফিরতে চাইলে সহযোগিতার আশ্বাসও আসে একাধিক উপদেষ্টার মুখ থেকে।
তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে সরকারের তরফ থেকে কোনো বিধিনিষেধ বা আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
এদিকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে আসতে চাইলে এক দিনে তাঁকে ‘ট্রাভেল পাস’ দেওয়া সম্ভব। কাজেই এটা উনি যদি আজকে বলেন যে উনি আসবেন, আগামীকাল হয়তো আমরা এটা দিলে পরশু দিন প্লেনে উঠতে পারবেন। কোনো অসুবিধা নাই। এটা আমরা দিতে পারব।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে, দেশে কারও নিরাপত্তায় কোনো ঝুঁকি নেই। সবার জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সবার নিরাপত্তা দিতে প্রস্তুত। স্পেশালি যাদের জন্য দরকার, তাদের জন্য স্পেশাল নিরাপত্তা দিতে প্রস্তুত। সবার স্ট্যাটাস অনুযায়ী দেয়া হয়।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, তারেক রহমানের বাংলাদেশে আসার ব্যাপারে কোনো আইনি বাধা আছে বলে আমার জানা নেই। যদি কোনো বাধা থেকেও থাকে তাহলে অবশ্যই আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা করব। ওনার নিরাপত্তার ব্যাপারে আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা করব। কোনটা উপযুক্ত সময় সেটা নির্ধারণের ক্ষমতা উনার রয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি। উনি উপযুক্ত সময়ে দেশে আসবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।
সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা অনুভূতি দেখা যাচ্ছে। কিছু মানুষ মনে করেন, যদি দেশে আসা যায়, এখনই আসা দরকার। কারণ বর্তমানে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা গুরুতর। অন্যরা বলছেন- এটা শুধু পারিবারিক বিষয় নয়; রাজনৈতিক অর্থে এটা বড় সিদ্ধান্ত। এখনই ফিরলে রাজনৈতিক বড় ঝড় দেখা দিতে পারে।
বিএনপির ক্ষুদ্র-মধ্যম পর্যায়ের সমর্থকরা আশা করছেন, তার দেশে ফেরা হলে বিএনপি পুনর্জন্ম পাবে। কিন্তু আপত্তিকর্তারা বিশ্বাস করে, ফিরলে নতুনভাবে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।
তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে জনমতের ভিন্নমুখী প্রতিক্রিয়া, রাজনৈতিক অঙ্গনের উত্তাপ এবং সরকারের নমনীয় অবস্থান মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এক জটিল ও সূক্ষ্ণ বাস্তবতা। বিএনপি নেতারা ফেরার কথা বললেও বারবার সময় পরিবর্তন ও নীরব অবস্থান দলের ভেতরেই তৈরি করেছে হতাশা ও সংশয়। খালেদা জিয়ার অসুস্থতা জনমানসে আবেগের সঞ্চার করেছে ঠিকই, কিন্তু তারেক রহমানের জন্য এটি একই সঙ্গে হিসাবি ঝুঁকি। দেশে ফিরলে তাঁর নেতৃত্বের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে যা দলের সাংগঠনিক প্রস্তুতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক, নিরাপত্তা ঝুঁকি, মামলার সম্ভাব্য পুনরুজ্জীবন এসবই তাঁকে দ্বিধান্বিত করে রেখেছে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। ফলে একদিকে জনগণের প্রত্যাশা ও আবেগ, অন্যদিকে রাজনৈতিক অঙ্ক ও কৌশল তারেক রহমান অবস্থান করছেন এই দুয়ের টানাপোড়নে।
জনগণের চোখ এখন একটাই প্রশ্নে স্থির তিনি ফিরবেন তো? আর ফিরলে দেশের রাজনীতিতে কোন শক্তির উত্থান হবে, কোন শক্তির পতন? সব মিলিয়ে, তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে ধোঁয়াশা দূর না হলে গুঞ্জন ও উত্তেজনা আরও বাড়বে। আর ফিরে এলেও বদলে যাবে বর্তমান রাজনীতির চিত্র। সূচনা হতে পারে নতুন ক্ষমতার সমীকরণ, নতুন সংঘাত এবং নতুন গণ-আন্দোলনের।




















