গাজী টায়ার্সে লুটপাটেও কসুর করেনি যুবলীগ-ছাত্রলীগ
- আপডেট সময় : ১২:০০:৫০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩০ অগাস্ট ২০২৪ ২৪৩ বার পড়া হয়েছে
বিশেষ প্রতিনিধি
দলীয় সাবেক এমপির কারখানাও রক্ষা পায়নি যুবলীগ-ছাত্রলীগের কবল থেকে। পতিত হাসিনা সরকারের লুটপাট, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি কতটা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালে এমন নজির গড়া যায়! তার প্রমাণ রাখতে কসুর করেনি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। দলের সাবেক মন্ত্রী-এমপির কারখানা রক্ষার পরিবর্তে চালিয়েছে লুটপাট।
হাসিনার ১৫ বছরের অধিক ক্ষমতায় থাকাকালীন দেশজুড়ে এমনি লুটপাট যে চালিয়েছে লীগ এণ্ড কোম্পানী সেই বিষয় এখন মানুষের মুখে মুখে। তারা বলছেন, রূপগঞ্জের সাবেক এমপি বর্তমানে পুলিশের কব্জায় থাকা গাজী গোলাম দস্তগীর গাজী। তার রূপগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে কলকারখানা রয়েছে। ক্ষমতায় থাকাকালীন ছাত্রলীগ-যুবলীগ-শ্রমিক লীগ নেতাকর্মীদের তিনি লালন পালন করেছেন। ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন অবৈধকাজে। কোন সময় জমি দখল, ভোট দখল ইত্যাদি কাজগুলো করিয়েছেন গাজী।
ডাকাতরা যে কোনকালেই এক সর্দারের হয়ে কাজ করে না, তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ ভারতের চম্বল। এই চম্বল ডাকাতদের চারণ ভূমি। পাহাড়-জঙ্গল আর নদী বেষ্টিত চম্বল ডাকাতদের আশ্রয়ের জন্য এক আদর্শ স্থান। ভারতের আলোচিত ডাকাত সর্দার ফুলন দেবী। সেও অত্যাচারিত এবং ডাকাতদের অপহরণের শিকার। এক পর্যায়ে ফুলনই হয়ে ওঠে দুধর্ষ ডাকাত সর্দার। এই ফুলন দেবী আত্মসমর্থন করে কারাগারে কয়েক বছর থাকার পর তার অভিষেক ঘটে ভারতের রাজনীতিতে। ফুলন বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ভারতের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। অর্থাৎ জন্মের ঋণশোধ, মৃত্যু দিয়ে।
তিপান্ন বছরের বাংলাদেশের বেশ কতগুলো বছর কেটে গেছে স্বৈরশাসকের কবলে পড়ে। সর্বশেষ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসন-শোষণ ছাড়াও বাকস্বাধীনতা হরণে নজির গড়েছে। অবৈধ অর্থের পাচার, ঋণের নামে হাজারো কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া, প্রকল্পে কমিশন বাণিজ্য, এমপি-মন্ত্রী পদের জন্য মোটাদাগের টাকা গ্রহণ, পরিবারের সদস্যদের অঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণক বানানো, লীগকে এদেশের উর্বর মাটিতে লুটপাট চালানোর লাইসেন্স দিয়েছিলো পতিত হাসিনা সরকার। ফ্রি স্টাইল লুটপাট কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেছিলো তারই প্রমাণ দিদে মোটেও পিছ পা হয়নি রূপগঞ্জ যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
হাসিনার পতনের পর হত্যা-গুম, লুটপাট-ব্যাংক লুট ইত্যাদি অপরাধে গ্রেপ্তার হতে থাকে একের পর এক মন্ত্রী-এমপিরা। এই তালিকায় ওঠে আসে রূপগঞ্জের সাবেক এমপি গোলাম দস্তগীর গাজী। তার গ্রেপ্তারের খবর নির্বাচনি এলাকায় মাইকে প্রচার করা হয়। এর পর রূপগঞ্জ উপজেলার খাদুন এলাকায় তার টায়ার কারখানায় শুরু হয় লুটপাট। গত রোববার দুপুরে শুরু হওয়া লুটপাটকে কেন্দ্র করে একপর্যায়ে দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষের জেরে রাতে কারখানার একটি ভবনে আগুন দেওয়া হয়।
সহকর্মী তুষারও রূপগঞ্জ খাদুন এলাকা ঘুরে এসেছেন। তার চোখের সামনে ভাসছে লুটপাট আর সংঘর্ষের দৃশ্য। দেখেছেন হাজারো মানুষের সামনে আকাশমুখো আগুনের লেলিহান শিখা। আগুন না নিভিয়ে সবাই মত্ত লুটপাটে। তুষার বললেন, আগুনের লেলিহান শিখার মতোই দেশের মানুষের মনের অবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে গাজীর কারখানার আগুন যেন এলাকাবাসীর বঞ্চিত মানুষে ঘৃণার আগুন। লুটপাট, মারামারি, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়াও প্রত্যক্ষ করেন তুষার।
সোমবার সকাল থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন সময় কারখানা এলাকায় আশপাশের বাসিন্দা, কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী, সাবেক জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের অভিমত গাজী টায়ার্সের কারখানায় লুটপাটকে কেন্দ্র করে শহিদুল ইসলাম ও রবিন হোসাইন ওরফে রাফির নেতৃত্বে সংঘর্ষে জড়ায় দুই পক্ষ।
শহিদুল কোনো পদে না থাকলেও তারাব পৌরসভার যুবলীগের নেতা হিসেবে পরিচিত। রবিন তারাব পৌর ছাত্রলীগের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। সংঘর্ষের কথা স্বীকার করলেও দুইপক্ষই লুটপাট ঠেকাতে গিয়ে হামলার শিকার হওয়ার দাবি করেন।
কারখানার লোকজন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ২৪ আগস্ট রাতে ঢাকার শান্তিনগর এলাকা থেকে কারখানা মালিক সাবেক এমপি গোলাম দস্তগীর গাজী গ্রেপ্তার হওয়ার পর রোববার সকাল থেকেই খাদুন এলাকার বিভিন্ন রাজনৈতিক লোকজন কারখানায় আসতে শুরু করেন। তারা কারখানার নিরাপত্তায় এলাকাবাসীকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য কর্মকর্তাদের চাপ দেন। কেউ কেউ কারখানায় পাহারার জন্য জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবি করেন। কারখানা কর্তৃপক্ষ তাতে রাজি না হলে বেলা ১১টা নাগাদ তারা হুমকি-ধমকি দিয়ে কারখানা ত্যাগ করে।
বেলা সাড়ে ১১টায় খাদুন উত্তরপাড়া জামে মসজিদসহ অন্তত দুটি মসজিদ থেকে গোলাম দস্তগীরের গ্রেপ্তারের খবর মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ছাড়া গোলাম দস্তগীরের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধ আছে এমন লোকজনকে রূপসী মোড় ও খাদুন মোড়ে জড়ো হতে বলা হয়। তার পরই বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন কারখানার আশপাশে জড়ো হতে থাকেন এবং ভেতরে ঢুকে লুটপাট শুরু করে।
খাদুন উত্তরপাড়া জামে মসজিদের ইমাম লুৎফর রহমান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কে বা কারা এসে মসজিদের মাইকে ঘোষণা করেছেন তা তিনি জানেন না। মাইকে ঘোষণার পরই লোকজন জড়ো হতে থাকে।
কারখানার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রবিন ও তার ভাই বাবুর লোকজন লুটের শুরু করে। শহিদুলের লোকজন পরে লুট করতে এলে দুই পক্ষে সংঘর্ষ হয়। লুটপাটের খবর ছড়িয়ে পড়লে বিকেল পাঁচটা নাগাদ বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার লোক লুটপাটে জড়িয়ে পড়ে। এরই মধ্যে কে বা কারা রাত নয়টার দিকে ছয়তলা ভবনটির নিচতলায় আগুন দেয়। এ ঘটনায় বহু মানুষ নিখোঁজ বলে দাবি করছেন এলাকার অনেকেই।
খাদুন এলাকার গুলজার হোসেনের ছেলে মো. বাবুকে ঘটনার বিষয়ে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, বাবু বলেন, বরপা এলাকার যুবলীগ নেতা শহীদুল ইসলাম লোকজনসহ মোটরসাইকেলে করে কারখানা লুট করতে আসে। এ সময় এলাকাবাসীকে নিয়ে তাদের বাধা দেওয়া হলে, শহীদুল আমার মাথায় ও তার এক সহযোগী আমার কোমরে পিস্তল ধরে। পরে আমাদের ধাওয়ায় তারা এলাকা ছেড়ে চলে যায়।
গাজী টায়ার্সের পুড়ে যাওয়া ভবনটি বৃহস্পতিবার সকালে পরিদর্শন করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক রাকিব আহসান। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ছয়তলা ভবনটিতে প্রবেশ করে উদ্ধার কার্যক্রম চালানো অত্যন্ত বিপজ্জনক।
এখনই হতাহতের খোঁজে সম্পূর্ণ ভবনে অনুসন্ধান চালাচ্ছে না ফায়ার সার্ভিস। তারা ভবনটির বেজমেন্টে অনুসন্ধান চালিয়ে জানিয়েছে, বেজমেন্টে আগুন পৌঁছায়নি। সেখানে যেসব মেশিন ছিল, সেগুলোও অক্ষত রয়েছে। সেখানে কোনো হতাহত মানুষ পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনার তদন্তে গঠিত তদন্ত দলের প্রধান নারায়ণগঞ্জের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এ ঘটনায় অবশ্যই মামলা হবে। ঘটনায় জড়িতদের ৃআইনের আওতায় আনা হবে।